একদিন বিকেলে জমি জরিপের জন্য সিন্ধু নদ দিয়ে নৌকা করে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই চোখে পড়ে এক বিশাল সুউচ্চ ঢিপির। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন জায়গাটির নাম মহেঞ্জোদারো। এখান থেকে প্রায়ই উদ্ধার হয় পোড়া মাটি, পাথরের নানান বস্তু, পশুর হাড়গোড়। স্থানীয় মানুষজন ভয়ে বড় একটা এদিকে আসেন না। উৎসুক রাখালদাস ঠিক করলেন এখানে খনন কার্য চালাবেন। খননকারী দলের একটি অংশ ভগ্নাবশেষের উপরিভাগে অবস্থিত বৌদ্ধ স্তূপে এবং অন্যদল নিচের ইটের প্রাচীরে উৎখনন চালানো শুরু করলেন। খননকারীদের একজন খুঁজে পেলেন একটি সিলমোহর। রাখালদাস সিলমোহর দেখেই বুঝতে পারেন, কয়েক দশক আগে হরপ্পা থেকে পাওয়া আলেকজান্ডার ক্যানিংহামের সিলমোহরটির সঙ্গে মহেঞ্জোদারোর সিলমোহরের সাদৃশ্য।
৩১ ডিসেম্বর, ১৯২২। বর্ষশেষের রাত্রি। ঘড়ির কাঁটায় তখন ন’টা।
প্রিন্সেপ ঘাটে বসেছে প্রিন্সেপ ক্লাবের বর্ষসেরা প্রাইজ প্রদানের আসর। উপস্থিত সদস্য সবাই ইউরোপীয়। পুরস্কার পাবেন ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র ডিরেক্টর জেনারেল জন মার্শাল। তাঁর কৃতিত্ব ৫০০০ বছরের পুরনো সভ্যতার খোঁজ দিয়েছেন তিনি। ঘোষণা করা হল, যে সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে তার সঙ্গে মিল রয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয়, অর্থাৎ আর্য সভ্যতার। হাত তুলে প্রতিবাদ জানালেন একমাত্র বাঙালি এবং ভারতীয় সদস্য। তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন– এটা আর্য সভ্যতা নয়, নিজস্ব ভারতীয় সভ্যতা, যার যোগ রয়েছে মিশর, পারস্য, মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সূত্রে। প্রতিবাদ হল। কিছু সদস্য সমর্থন করলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিছু মার্শালকে। শেষপর্যন্ত হল ভোট। এক ভোটের ব্যবধানে জন মার্শালকে পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হল।
আসলে ভারতীয় সভ্যতাকে তুলে ধরতে ব্রিটিশদের বরাবরই অনীহা। বিদেশি সভ্যতার আলোতেই ভারতীয়রা আলোকিত– এই কথাই তারা বারবার মনে করাতে চেয়েছে। তাই, ‘কালা নেটিভ’ হওয়ার কারণে, পাঁচ হাজার বছরের সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কর্তা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ঘৃণ্য চক্রান্ত এবং তার বিরুদ্ধে রাখালদাসের মরণপণ সংগ্রাম।
পুরাতাত্ত্বিক রাখালাদাস সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ রমাপ্রসাদ চন্দ লিখছেন, “একটি ল্যাটিন প্রবাদ আছে যাহার অর্থ – ‘Poet is born, not made’. কবি তৈয়ারি করা যায় না, কবিত্ব জন্মগত। প্রকৃত পুরাতাত্ত্বিক কোনো শিক্ষাদীক্ষার দ্বারা তৈয়ারি করা যায় না, শিক্ষাদীক্ষার মূলে জন্মগত প্রবৃত্তি, জন্মগত প্রতিভা থাকা চাই। রাখালদাস এইরূপ প্রবৃত্তি, এইরূপ প্রতিভা লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন”। শুধু প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রসমীক্ষক নন, রাখালদাসের পরিচয় তিনি হস্তলিপিবিজ্ঞান বিশারদ, মুদ্রাতাত্ত্বিক, উৎকীর্ণ লিপিতত্ত্ব বিশারদ, আঞ্চলিক ইতিহাসের রচয়িতা, ঔপন্যাসিক।
১৮৮৫ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ১৯৩০ সালের ২৩ মে– রাখালদাসের মাত্র ৪৫ বছরের জীবন।
জন্মভূমি বহরমপুর থেকেই ইতিহাসের প্রতি প্রাথমিক ভালবাসা তৈরি হয় তাঁর, যে শহরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। এই ইতিহাসের মধ্যেই বেড়ে ওঠা রাখালদাসের। শৈশবেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন ইতিহাসের চিহ্নগুলো ছুঁয়ে দেখাতেই তাঁর আনন্দ। সুতরাং লক্ষ্য স্থির হতে দেরি হয়নি। ইতিহাসকে আশ্রয় করেই শুরু হল তাঁর পথচলা। কাছ থেকে দেখলেন রামদাস সেন, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, পূর্ণচন্দ্র নাহারের মতো এমন কিছু মানুষজন। প্রাণিত হলেন। ইতিহাস হয়ে উঠল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ১৯০৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করলেন। সেই বছরেই বাবা মতিলালের মৃত্যু। সাময়িক ছেদ পড়ল পড়াশোনায়। সব বাধা অতিক্রম করে আবার পড়াশোনায় ফিরে এলেন অচিরেই। ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করলেন। ১৯০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে ‘বঙ্গরাজ লক্ষ্মণ সেনের মাধাইনগর তাম্রশাসন’ নিয়ে তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হতে থাকল তাঁর প্রাচীন লেখ ও মুদ্রা সম্পর্কিত লেখা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করলেন ১৯১০-এ।
রাখালদাসের মনোজগৎ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে স্বাদেশিকতার আদর্শে প্রাণিত পূর্বজ এইসব ইতিহাসবিদ ও মনীষীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। রাখালদাস প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে সংগ্রহ করতে চাইলেন সেই প্রাণরস, যা জাতীয় চেতনার নবোদিত অঙ্কুরকে মহীরুহে পরিণত করতে পারে। এই প্রাণরসেরই অনুষঙ্গ হিসেবে তিনি উন্মোচিত করলেন ভারতশিল্পের ইতিহাস চর্চা। এই ইতিহাস চর্চার আদিপর্বে অন্যদের সঙ্গে রাখালদাসও এগিয়ে এসেছেন তাঁর সন্ধানী দৃষ্টি, বিশ্লেষণী মন ও কুশলী কলম নিয়ে। আবিষ্কার করেছেন মধ্যপ্রদেশের ভূমারার শিবমন্দির, বিহারের রাজাওনা আর উত্তরপ্রদেশের কোসাম অঞ্চল। এগুলির ভাস্কর্য নিদর্শন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন, লিখেছেন তাঁর শিল্পকলা বিষয়ক দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত গবেষণার ফসল ‘Eastern Indian School of Mediaeval Sculpture’. গ্রন্থটি রাখালদাস-এর শিল্প-প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের সারস্বত অভিজ্ঞান।
১৯১০ সালে রাখালদাস ভারতীয় জাদুঘরের ‘প্রত্নতাত্ত্বিক সহকারী’ হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরে কাজ করার সময়ে সেখানকার সংগৃহীত অসংখ্য মূর্তি ও ভাস্কর্যের সংগ্রহ থেকে তিনি প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এখানেই তিনি থিয়োডোর ব্লখের সংস্পর্শে আসেন তাঁরই শিল্পগুরু প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সৌজন্যে। থিয়োডোর ব্লখের অনুপ্রেরণায় ১৯০৪ সাল থেকে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংগৃহীত ভাস্কর্যগুলি নিয়ে তিনি অধ্যয়ন শুরু করেন। ফলশ্রুতি, বাংলা-বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া লেখযুক্ত মূর্তিগুলি নিয়ে গবেষণালব্ধ ফলাফল যা প্রতিফলিত হয়েছে শিল্পকলা বিষয়ক বিভিন্ন লেখায়।
শিল্পকলা বিষয়ক লেখালিখিতে রাখালদাসের প্রধান কৃতিত্ব এই যে, তিনি একটি নতুন শিল্প-ঘরানাকে বিশেষজ্ঞ মহলে পরিচিত করান। স্বীকৃত হল এক নতুন শিল্প ঘরানা– ‘গৌড়ীয় শিল্প-ঘরানা’। রাখালদাস গৌড়ীয় শিল্প নিয়ে সাতটি নিবন্ধ রচনা করেন– ‘শিল্পের আদর্শ’, ‘গৌড়ীয় শিল্পের ইতিহাস’, ‘গৌড়ীয় শিল্পের আদিযুগ’, ‘দশম শতকে গৌড়ীয় শিল্প’, ‘গৌড়ীয় শিল্পের পুনরুত্থান’, ‘গৌড়ীয় শিল্পে দাক্ষিণাত্য প্রভাব’, ‘দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের শিল্প’। বৈদগ্ধে উজ্জ্বল, বিশ্লেষণে নতুন দিশামথিত প্রবন্ধগুলি প্রকাশ কালেই বিশিষ্টজনদের কাছে সমাদৃত হয়।
শিল্প ও সংস্কৃতির ইতিহাস ছাড়া বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস অসম্পূর্ণ। আবার বাংলার স্থানিক ইতিহাসের মতো ছোট ইতিহাসকে বাদ দিয়ে বৃহৎ ভারতের সম্পূর্ণ ইতিহাসের ভাবনা অকল্পনীয়। তাই রাখালদাস গৌড়ীয় শিল্পকে ভারতীয় ইতিহাসের গোত্রভুক্ত করলেন নির্দ্বিধায়।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের ডিরেক্টর জেনারেল স্যর জন মার্শাল রাখালদাসের কাজকর্মে একেবারে মুগ্ধ। ১৯১১ সালে পদোন্নতি হল রাখালদাসের, হলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট। বছর তিনেক পরই ফের প্রমোশন। ওয়েস্টার্ন সার্কেলের সুপার হয়ে কলকাতা থেকে বদলি হয়ে চলে এলেন পুনেতে। এখান থেকেই পরের ছয় বছর বোম্বাই প্রেসিডেন্সির দূরদুরান্তে তাঁর নেতৃত্বে চলে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান। এই পর্বেই ১৯২২ সালে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার করেন রাখালদাস ওরফে ‘আর. ডি ব্যানার্জি’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শিল্পকলা বিষয়ক লেখালিখিতে রাখালদাসের প্রধান কৃতিত্ব এই যে, তিনি একটি নতুন শিল্প-ঘরানাকে বিশেষজ্ঞ মহলে পরিচিত করান। স্বীকৃত হল এক নতুন শিল্প ঘরানা– ‘গৌড়ীয় শিল্প-ঘরানা’। রাখালদাস গৌড়ীয় শিল্প নিয়ে সাতটি নিবন্ধ রচনা করেন– ‘শিল্পের আদর্শ’, ‘গৌড়ীয় শিল্পের ইতিহাস’, ‘গৌড়ীয় শিল্পের আদিযুগ’, ‘দশম শতকে গৌড়ীয় শিল্প’, ‘গৌড়ীয় শিল্পের পুনরুত্থান’, ‘গৌড়ীয় শিল্পে দাক্ষিণাত্য প্রভাব’, ‘দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের শিল্প’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একদিন বিকেলে জমি জরিপের জন্য সিন্ধু নদ দিয়ে নৌকা করে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই চোখে পড়ে এক বিশাল সুউচ্চ ঢিপির। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন জায়গাটির নাম মহেঞ্জোদারো। এখান থেকে প্রায়ই উদ্ধার হয় পোড়া মাটি, পাথরের নানান বস্তু, পশুর হাড়গোড়। স্থানীয় মানুষজন ভয়ে বড় একটা এদিকে আসেন না। উৎসুক রাখালদাস ঠিক করলেন এখানে খনন কার্য চালাবেন। ভগ্নাবশেষের উচ্চতম স্তরে তাঁর দলকে দু’-ভাগে বিভক্ত করলেন। খননকারী দলের একটি অংশ ভগ্নাবশেষের উপরিভাগে অবস্থিত বৌদ্ধ স্তূপে এবং অন্যদল নিচের ইটের প্রাচীরে উৎখনন চালানো শুরু করলেন। খননকারীদের একজন খুঁজে পেলেন একটি সিলমোহর। রাখালদাস সিলমোহর দেখেই বুঝতে পারেন, কয়েক দশক আগে হরপ্পা থেকে পাওয়া আলেকজান্ডার ক্যানিংহামের সিলমোহরটির সঙ্গে মহেঞ্জোদারোর সিলমোহরের সাদৃশ্য। কয়েকশো মাইলের ব্যবধানে দুটো প্রাচীন নগরের ভগ্নাবশেষ যে একই সভ্যতার প্রতিনিধি, তা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ই সর্বপ্রথম অনুধাবন করেন।
১৯২৩-এর প্রথমদিকে রাখালদাস মহেঞ্জোদারোর প্রথম ধাপের প্রাথমিক পর্যায়ের খনন শেষ করেন এবং চিহ্নিত ঢিবিগুলোকে পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের অধীনে নিয়ে আসেন। সিন্ধুপ্রদেশের শুষ্ক মরু অঞ্চলের আবহাওয়ায় রাখালদাসের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। অবশেষে ১৯২৪ সালে রাখালদাসকে বাদ দিয়েই জন মার্শাল মহেঞ্জোদারোয় দ্বিতীয় পর্বের খনন কাজ শুরু করেন। রাখালদাসকে স্থায়ীভাবে ASI-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান হিসেবে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘রাখালের যে আশা ছিল, এই আবিষ্কার নিজে সম্পূর্ণ করবেন, সেটার যোগাযোগ হল না– তিনি পশ্চিম ভারত থেকে পূর্ব ভারতে বদলি হলেন…ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ম ছিল যে কর্তৃপক্ষের হুকুম না হলে কোনো অধস্তন কর্মচারী কোনো আবিষ্কার বা গবেষণা তাঁর নিজের কৃতিত্ব হলেও প্রকাশ করতে পারতেন না। সুতরাং এই নিয়মে রাখালদাসের মুখ বন্ধ হল; এই গবেষণা সম্বন্ধে তাঁর যা বক্তব্য তা বলবারও পথ রইল না।’
এককভাবে, না স্যর জন মার্শালের সঙ্গে যুগ্মভাবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহেঞ্জাদারোর আবিষ্কারক, তা বিতর্কিত। পি. কে. মিশ্র তাঁর ‘Rakhal Das Banerji: The Forgotten Archaelogist’ বইয়ে দাবি করেছেন, ১৯২৪ সালের আগে মার্শাল সেভাবে মহেঞ্জাদারোর কথা জানতেনই না। পি. কে. মিশ্রের মতে, ‘Marshall took direct charge of the excavation from winter 1925-26. By that time Banerjee had done all the work a discoverer should have done.’ পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতীয়দের কৃতিত্বকে চেপে দেওয়ার ঘটনা কম নেই। কিন্তু এরপরে যা হল, তা অবিশ্বাস্য। যিনি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কাজকর্মে এত সাফল্য এনে দিলেন, সেই কাজকর্ম থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে ১৯২৬ সালে। মূর্তি চুরির মিথ্যা অভিযোগে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সৃজা মণ্ডল-এর লেখা: মন্দির দর্শনের আগ্রহ বেশি, মন্দির সম্বন্ধে জানার উৎসাহ কম, বুঝেছিলেন নির্মলকুমার বসু
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রাখালদাস আসলে হিরাপুরের চৌষাট বা চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরটির প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করেছিলেন। ৬৪টি যোগিনী মূর্তি ছাড়াও বেশ কিছু দেবদেবীর মূর্তি এই মন্দিরটিতে ছিল। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত গ্রানাইট পাথরের যোগিনী মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল নবম শতকে। রাখালদাসের জীবনীকার অশোককুমার ভট্টাচার্যর লেখা থেকে জানা যায় যে, ভেড়াঘাটের এই মন্দিরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালেই মূর্তি চুরির ঘটনাটি ঘটেছিল। ঘটনার দায় অন্যায়ভাবে রাখালদাসের ওপর চাপিয়েছিল তৎকালীন ঈর্ষান্বিত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ আধিকারিকরা।
কর্মচ্যুতিতে রাখালদাস আর্থিক প্রতিকূলতায় পড়লেন। বিষয়সম্পত্তি কম ছিল না, বেতনও পেতেন প্রচুর। কিন্তু এসবের সঙ্গে তাঁর খরচের বহরও ছিল দেখার মতো। চালচলনে তো ছোটবেলা থেকেই নবাবিয়ানা। জমিদারি আদবকায়দা বজায় রাখতে প্রচুর টাকা খরচ করতেন। নিজের হাতে গ্রামবাসীদের বস্ত্রদান করতেন। দরিদ্র ভোজন করাতেন। আশপাশের গ্রাম থেকে বহু মানুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো দেখতে আসতেন তাঁদের তদারকি করতেন রাখালদাস। পুজোর দিনগুলোতে প্রতিদিন নিজে হাতে ভক্তদের প্রসাদ বিতরণ করতেন, তারপর নিজে খেতেন। বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন রাখালদাস। যে সময় টাকায় এক মণ চাল, সেসময় রেলস্টেশনে কুলিকে তিনি অবলীলায় দশ টাকা বকশিস দিতেন। নবাবসুলভ চালচলন এবং বেপরোয়া স্বভাব তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে, সমস্যাতেও ফেলেছে বারবার।
আর্থিক অসুবিধার সঙ্গে যুক্ত হল শারীরিক প্রতিকূলতাও। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এবার তা একেবারে কাহিল করে দিল। এই অবস্থায় ওড়িশার ইতিহাস লেখার কাজ পেয়ে কিছুটা আর্থিক সুরাহা হল। এরপরে ১৯২৮ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রফেসর’ হিসাবে তিনি নিযুক্ত হলেন। তবে এই কাজে সম্মান যতটা ছিল, অর্থ ততটা ছিল না। এরই পাশাপাশি তিনি চালিয়ে গেছেন গবেষণামূলক লেখালিখি এবং উপন্যাস রচনা।
রাখালদাস ৯টি উপন্যাস লিখেছিলেন। তার মধ্যে অধিকাংশই ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই বিশেষ গোত্রের সাহিত্যে রাখালদাসের কলম ছিল বেশ বলিষ্ঠ। তাঁর প্রথম রচনা ‘পাষাণের কথা’ প্রকাশ পায় ১৩২১ বঙ্গাব্দে। একই বছর প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শশাঙ্ক’। এই বইটি রাখালদাস উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর গুরু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে। রাখালদাসের পরবর্তী উপন্যাস ‘ধর্মপাল’ (১৩২২ বঙ্গাব্দ) বাঙালির এক গৌরবময় সময়ের নায়ক, পালযুগের শ্রেষ্ঠ রাজাকে নিয়ে রচিত। চতুর্থ উপন্যাস ‘করুণা’-য় রাখালদাস বিষয় করলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরাক্রমশালী সম্রাট স্কন্দগুপ্তকে। ‘উপাসনা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের পর এই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল ১৯১৮ সালে। ডঃ সুকুমার সেনের কথায়, ‘শশাঙ্ক’, ‘ধর্মপাল’ ও ‘করুণা’– এই তিনটি উপন্যাসে উত্তরাপথের ইতিহাসের জের টানা হয়েছে পঞ্চম শতাব্দী থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত। কোথাও কোথাও তথ্যগত সামান্য কিছু ত্রুটি থাকলেও বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারায় এই উপন্যাসত্রয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও আরও দু’টি ঐতিহাসিক উপন্যাস তিনি লিখেছিলেন। সম্রাট শাহ্জাহানের সময়কাল নিয়ে লিখিত ‘ময়ূখ’ ও বাংলার নবাবী আমলের প্রেক্ষাপটে লিখিত ‘অসীম’। বাংলা ভাষায় তাঁর গবেষণামূলক কাজের মধ্যে দু’খণ্ডে রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও রাখালদাসের ‘উড়িষ্যার ইতিহাস’ গ্রন্থটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে ২২টি অধ্যয়ে প্রাচীন কাল থেকে সূর্যবংশীয় গজপতিরাজগণের শাসনের অবসান পর্যন্ত দীর্ঘকালের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ছয়টি অধ্যয়ে তিনি ওড়িশার মুসলমান, মারাঠা এবং ব্রিটিশ অধিকারকালের ইতিহাস আলোচনা করেছেন। এই অংশের অপর দু’টি অধ্যায়ে দেশে ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সৃজা মণ্ডল-এর লেখা: যেসব জীবন জড়িয়ে রয়েছে মহুয়া গাছের ফুলে-বাকলে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যে সময়ে ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যকীর্তি সংক্রান্ত মূল্যবান গ্রন্থ ও নিবন্ধ রচনা করেছেন, সেই সময় ভারতীয় শিল্প গৌরবের ইতিহাসচর্চা স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। আনন্দ কুমারস্বামী-র মতো প্রথিতযশা যে ক’জন শিল্প-প্রাজ্ঞ ভারতবর্ষ ও ভারতকৃষ্টির প্রভাবাধীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আনুপূর্বিক শিল্প ইতিহাস রচনার কাজ করেছেন, তাঁরাও রাখালদাসের কাছে ভীষণভাবে ঋণী। রাখালদাসের গবেষণা ও আবিষ্কারের ফসল তাঁদের পাথেয় ছিল।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে মহেঞ্জোদরোর পুরাকীর্তি আবিষ্কার আজ প্রায় সমার্থক। গোটা দুনিয়ায় এই আবিষ্কার তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
ইতিহাসে মাস্টার্স করতে করতে কলম ধরেছিলেন রাখালদাস, যা থামেনি আমৃত্যু। রেখে গেছেন অনেক অসমাপ্ত কাজ। তবে যা করে গিয়েছেন, তার বিস্তারও কম নয়। তাঁর অসাধারণ গবেষণামূলক গ্রন্থগুলি ছাড়াও বেশ কিছু উৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক ও সামাজিক কাহিনির প্রণেতা রাখালদাস, সে কথা আজ বাঙালির কাছে বিস্মৃত।
গবেষণার প্রয়োজন ছাড়া এসব উলটে দেখার আর সময় কই বাঙালির? ক্রমশই বিবর্ণ হতে থাকে তাঁর বইয়ের পাতায় ধুলো জমে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিন চলে যায় নীরবে।