পোশাক পরিচ্ছদে পিন লাগানোর চল হালফিলের নয় মোটেই। বিশেষ করে সেলাইবিহীন টিউনিক জাতীয় পোশাক সামলানোর জন্য পিনের বিকল্প ব্যবস্থা স্বয়ং প্লেটোও ভেবে উঠতে পারেননি। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। ঘটনাচক্রে পিন বিষয়টাকে কাঠামোগতভাবেই তেমন নিরীহ বলা চলে না। হেরোডোটাসের ঐতিহাসিক জবানিতেই যেমন জানা যাচ্ছে, এথেন্সে একবার একদল মহিলা রাগের চোটে স্রেফ নিজেদের ‘বাতাসের মতো ফুরফুরে জলের মতো চিকন’ টিউনিক থেকে পিন খুলে এক সেনাধ্যক্ষকে শুধু ঘায়েল নয়, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেই ফেলেছিলেন! হালফিলের সিনেম্যাটিক ভাষায় যার ‘অরিজিন স্টোরি’-তেই এমন রক্তের ছিটে, সে বস্তু যতই সহজলভ্য ও আপাত সাধারণ হোক না কেন, তার ইতিহাস যে খুব একটা সাদামাঠা পথে এগোবে না, তা বলাই যায়!
“অতঃপর আন্তিনাউস বললেন– ‘হে ইকারিয়াস দুহিতা, রানি পেনেলোপ, প্রেরক যেই হোন না কেন আপনি সানন্দে সকল উপহার গ্রহণ করুন, কারণ উপহার প্রত্যাখ্যান করা শোভন নয়, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের মধ্যে থেকে স্বামী হিসেবে সর্বোত্তম এক পুরুষকে মনোনীত না করছেন ততক্ষণ আমরা কেউই এই স্থান ত্যাগ করব না।’
একথা শুনে বাকিরা করতালি সহযোগে সম্মতি জানাল এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ ভৃত্যের হাতে রানির জন্য উৎকৃষ্ট সব উপহার পাঠাল। আন্তিনাউস তার নিজের ভৃত্যের হাতে রানির জন্য অনন্য সূচিকর্ম সমাদৃত এক অপূর্ব পোশাক পাঠালেন। সঙ্গে পোশাকটিকে স্বস্থানে সুরক্ষিত করার জন্য বারোটি সোনার পিনও পাঠানো হল, যা সূর্যালোকের মতোই ঝলমল করছিল।”
–হোমার, ওডিসি
অর্থাৎ, কি না পোশাক পরিচ্ছদে পিন লাগানোর চল হালফিলের নয় মোটেই। বিশেষ করে সেলাইবিহীন টিউনিক জাতীয় পোশাক সামলানোর জন্য পিনের বিকল্প ব্যবস্থা স্বয়ং প্লেটোও ভেবে উঠতে পারেননি।
কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। ঘটনাচক্রে পিন বিষয়টাকে কাঠামোগতভাবেই তেমন নিরীহ বলা চলে না। হেরোডোটাসের ঐতিহাসিক জবানিতেই যেমন জানা যাচ্ছে, এথেন্সে একবার একদল মহিলা রাগের চোটে স্রেফ নিজেদের ‘বাতাসের মতো ফুরফুরে জলের মতো চিকন’ টিউনিক থেকে পিন খুলে এক সেনাধ্যক্ষকে শুধু ঘায়েল নয়, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেই ফেলেছিলেন! হালফিলের সিনেম্যাটিক ভাষায় যার ‘অরিজিন স্টোরি’-তেই এমন রক্তের ছিটে, সে বস্তু যতই সহজলভ্য ও আপাত সাধারণ হোক না কেন, তার ইতিহাস যে খুব একটা সাদামাঠা পথে এগোবে না, তা বলাই যায়!
গ্রিকরা অবশ্য এ জাতীয় আদি ‘ফেমিনিন রেজ’ দেখে পিন-টিন নিয়ে বিশেষ মাথা না ঘামিয়ে মহিলাদের ওমন অলুক্ষুণে পোশাক পরাই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু রোমানদের কথা আলাদা। কেননা সাম্রাজ্য বিস্তার আর গ্ল্যাডিয়েটরদের খুনে খেলাধুলো দেখা ছাড়াও রোমানদের তৃতীয় প্রিয়তম নেশা ছিল ‘টোগা’। আর টোগা সামলাতে পিনের উপস্থিতি অপরিহার্য। কিন্তু সম্ভবত উত্তেজিত কূটনীতি চর্চার আসরে খেপে উঠে নিজেই নিজের টোগার পিনে খোঁচা খাওয়াটা মহান সভ্যতায় মানায় না। কাজেই ক্লাস্প-সহ সূচাগ্রটিকে নিরাপদে ঢেকে রাখা যাবে, এমন এক পিনের প্রচলন ঘটে যার পোশাকি নাম ‘ফিবিউলা’, যাকে আদি ‘সেফটি’-পিন বললেও অত্যুক্তি হবে না।
তবে আধুনিক সেফটিপিন বলতে যা বোঝায়, তার জনক বা আবিষ্কারক জনৈক ওয়াল্টার হান্ট। উনিশ শতকের নিউ ইয়র্কের এই কারিগরের নাম যে সর্বজনবিদিত নয়, তার কারণ হয়তো ভদ্রলোকের ব্যবসায়িক বুদ্ধি তাঁর কারিগরি উদ্ভাবনী-ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না মোটেই। কাজেই ঝুলিতে একাধিক নিত্যপ্রয়োজনীয় আবশ্যিক যন্ত্রপাতির পেটেন্ট থাকা সত্ত্বেও ভদ্রলোককে হামেশাই অর্থকষ্টে দিন কাটাতে হত। এমনকী, ১৮৪৯ সালের সেই দৈবাধীন দিনটিতেও, নিজের ওয়ার্কশপে হাতে একখানি ইস্পাতের তার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেও তিনি ভাবছিলেন জনৈক বন্ধুর থেকে ধার নেওয়া ১৫ ডলার কীভাবে শোধ করবেন! ‘ইউরেকা’ মুহূর্ত সাধারণত এরকম পটভূমিকাতেই জন্মায়। মোদ্দা কথা, তার নিয়ে কসরৎ করতে করতেই ওয়াল্টার হান্ট আবিষ্কার করে ফেলেন যে সামান্য পেঁচিয়েই সাধারণ একটা পিনকে আরও বেশি ব্যবহারিক আর নিরাপদ একটা রূপ দেওয়া যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: রোজকার অসুখের বিরুদ্ধে বিনীত প্রতিরোধ ছিল হোমিওপ্যাথি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রাথমিক প্রোটোটাইপের নকশা স্থির করেই ১৮৪৯ সালের ১০ এপ্রিল ওয়াল্টার হান্ট তাঁর ‘ড্রেসিং পিন’-এর পেটেন্ট নেন এবং মাত্র ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সদ্যপ্রাপ্ত স্বত্বখানি ‘ডব্লিউ আর গ্রেস অ্যান্ড কোম্পানি’-কে বিক্রি করে দেন। বন্ধুর ধার শোধ হয়। হান্টের আবিষ্কৃত ‘ড্রেসিং পিন’, যা কি না শিশুদের ডায়পারেও ব্যবহার করার মতো ‘সেফ’, লোকমুখে হয়ে দাঁড়ায় ‘সেফটিপিন’। এবং সেফটিপিনের বদান্যতায় ‘গ্রেস অ্যান্ড কোম্পানি’ কয়েক লাখ ডলার কামিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠে। আধুনিক সেফটি পিন আর হান্টের প্রোটোটাইপের নকশা এই অ্যাদ্দিনেও প্রায় পুরোটাই অপরিবর্তিত। কাজেই সেফটিপিন হিট করলেও ব্যক্তি হান্ট বিস্মৃতিতে তলিয়ে যান। জনপ্রিয়তার নিরিখে তার আবিষ্কার এতটাই সর্বজনগ্রাহ্য আর প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে জনশ্রুতি, গ্রেট ডিপ্রেশনের আমলে ডলারের বদলে নাকি অনেক ক্ষেত্রেই সেই ‘সামান্য’ সেফটিপিন ব্যবসায়িক লেনদেনের চালু একক হয়ে দাঁড়িয়েছিল!
ওয়াল্টার হান্টকে যদিও ‘ইনিভেন্টর্স হল অফ ফেম’-এ জায়গা পেতে অপেক্ষা করতে হয় ২০০৬ সাল পর্যন্ত। আর তাঁর পেটেন্টপ্রাপ্তির দিনটিকে ‘বিশ্ব সেফটিপিন দিবস’ হিসেবে পালন করার চল নেহাতই ২০১৭ সাল নাগাদ।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অন্দরমহলে, সেলাইয়ের বাক্সে, এমনকী কখনও-সখনও ভারতীয় মহিলাদের হাতের চুড়িগোছাতেও তার অনিবার্যতার জলজ্যান্ত বিজ্ঞাপন হয়ে উপস্থিতি যে সেফটিপিনের, তার ‘ক্লেম টু ফেম’-এর কাহিনিও কম চমকপ্রদ নয়!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আধুনিক সেফটিপিন বলতে যা বোঝায়, তার জনক বা আবিষ্কারক জনৈক ওয়াল্টার হান্ট। উনিশ শতকের নিউ ইয়র্কের এই কারিগরের নাম যে সর্বজনবিদিত নয় তার কারণ হয়তো ভদ্রলোকের ব্যবসায়িক বুদ্ধি তাঁর কারিগরি উদ্ভাবনী-ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না মোটেই। কাজেই ঝুলিতে একাধিক নিত্যপ্রয়োজনীয় আবশ্যিক যন্ত্রপাতির পেটেন্ট থাকা সত্ত্বেও ভদ্রলোককে হামেশাই অর্থকষ্টে দিন কাটাতে হত। এমনকী, ১৮৪৯ সালের সেই দৈবাধীন দিনটিতেও, নিজের ওয়ার্কশপে হাতে একখানি ইস্পাতের তার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেও তিনি ভাবছিলেন জনৈক বন্ধুর থেকে ধার নেওয়া ১৫ ডলার কীভাবে শোধ করবেন!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সময়টা ’৭০-এর গোড়ার দিক। নিউ ইয়র্কের সিবিজিবি ক্লাবে এক সন্ধেবেলা টেলিভিশন ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট রিচার্ড হেল যখন একখানা ছেঁড়া টি-শার্টে গোটা কয়েক সেফটিপিনের জোরাতাপ্পি মেরে স্টেজে উঠলেন, তখন একটা বেশ উচ্চকিত গুঞ্জনই উঠল বটে।
আসলে সে এক আশ্চর্য সময়। ছয়ের দশকের কাউন্টার-কালচার স্তিমিত হয়ে এসেছে। হিপি যুগের ‘সামার অফ লাভ’ ও তার ‘টার্ন অন টিউন ইন ড্রপ আউট’-এর চমকপ্রদ দর্শন শতচেষ্টাতেও ভিয়েতনাম যুদ্ধ থামাতে পারেনি। উল্টে রাজনৈতিকভাবে ‘বিপজ্জনক’ সংগঠনগুলো হয় নিষিদ্ধ, নয়তো পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ। সিআই-এর হাতে খুন হয়েছেন ‘ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি’-র অসংখ্য নেতা। এমনকী, গোটা ইউরোপ তোলপাড় করা প্রবাদপ্রতিম সব ছাত্র আন্দোলনও আখেরে ব্যর্থ। ঠান্ডাযুদ্ধের পারদ চড়তে চড়তে প্রায় পুরোদস্তুর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার অবস্থা। আয়রন কার্টেনের উল্টোদিকের ‘মুক্ত দুনিয়া’, ‘সমাজতান্ত্রিক সংঘবদ্ধতা’-র জোরদার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র’ নামক এক অলীক অথচ আকর্ষণীয় ধারণাকে। একটা নতুন প্রজন্ম হঠাৎই আবিষ্কার করে ফেলছে যে, তাদের পূর্বসূরিরা হেরে গেছে। হেরে গেছে তাদের যূথবদ্ধ লড়াই। আর মহাদেশ পরিব্যাপ্ত এক অবশ্যম্ভাবী নিউক্লিয়ার মাশরুম ক্লাউডের খাঁড়ার নিচে দাঁড়িয়ে তারা দেখছে ‘দূর শালা! নিকুচি করেছে!’ বলে চিৎকার করে ওঠা ছাড়া তাদের আর অন্য কিচ্ছুটি করার নেই।
ইতিহাস সে সময়কে চিনবে পাঙ্ক সংগীতের জন্মলগ্ন হিসেবে। আর এ ঘরানার প্রাসঙ্গিকতা আর সম্ভাবনাকে সেদিন আর কেউ না চিনলেও ভিড়ে দাঁড়ানো ম্যালকম ম্যাকলরেন ঠিকই চিনে নেবেন। আর্ট স্কুলের ছাত্র ম্যালকম এরপর যখন নিজের শহর লন্ডনে ফিরবেন তখন মাথায় ভরে নিয়ে আসবেন এক সম্পূর্ণ অভিনব ভাবনার বীজ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: জুতোর ঘুম থেকে জাগে পেরেক
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পাঙ্ক রক অথবা ‘পাঙ্ক ফিলোজফি’-র উৎপত্তি ও বিবর্তনে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও লন্ডন শহরেই যে ‘পাঙ্ক’ প্রকৃতপ্রস্তাবে একটি ‘ফেনোমেনা’ হিসেবে দেখা দেয়, সে বিষয়ে সব্বাই একমত। আমেরিকার ঘোরতর বাণিজ্যিক মিউজিক সিনে যা ছিল নিতান্তই এক বিচ্ছিন্ন ধারা, সাতের দশকের ইংল্যান্ডে সে ধারার যেন বিস্ফোরণ ঘটল! তথাকথিত যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কক্ষনও সূর্যাস্ত হয় না, একের পর এক কলোনি হাতছাড়া হওয়ার পর সে সাম্রাজ্যের কঙ্কালসার চেহারা পুরোটাই উন্মুক্ত। দেশে চাকরি নেই। ঘোরতর অর্থনৈতিক মন্দা। প্রতিনিয়ত জাতিভিত্তিক দাঙ্গা ও কারফিউ। অথচ সেই হাড্ডিসার চেহারার ওপর ধোপদুরস্থ ইংলিশ এটিকেট আর ভদ্রতার মুখোশ যেন তরুণ প্রজন্ম আর সহ্য করতে পারছিল না! ম্যালকম ম্যাকলরেন্স-এর তৎকালীন প্রেমিকা, ভিভিয়ান ওয়েস্টউড চেলসির কিংগস রোডে নিজের ডিজাইনার পোশাকের একটা বুটিক খুলে ফেলবেন। আর ‘অ্যান্টি ফ্যাশন’ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়ে তিনি যে প্রথম কালেকশন তৈরি করবেন, তার নাম দেবেন ‘সিডিশনারিজ’। রাষ্ট্রদ্রোহিতার জ্যান্ত উৎযাপনে ছেঁড়া, তাপ্পি মারা, অসংখ্য সেফটিপিনে সজ্জিত টি শার্ট আর ডিসট্রেসড ডেনিম নিয়ে লন্ডনের তরুণ প্রজন্ম কাড়াকাড়ি শুরু করে দেবে। ম্যালকম ম্যাকলরেন্স নিজে ম্যানেজার হয়ে বসবেন পাশ্চাত্য সংগীতের সবচেয়ে কুখ্যাত ব্যান্ডটির, যার নাম ‘সেক্স পিস্তলস’। আর সে ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট জনি রটেন যখন কানে সেফটিপিন গেঁথে স্টেজে উঠে চিৎকার করবেন ‘আই অ্যাম অ্যান আন্টিক্রাইস্ট/ আই অ্যাম অ্যান অ্যানার্কিস্ট’, তখন স্যুট-টাই শোভিত ব্রিটিশ মধ্যবিত্ত আঁতকে উঠবে! আর ১৯৭৪-এ যখন সেই বিষম ব্যান্ড তাদের ‘গড সেভ দ্য ক্যুইন’-এর প্যারোডি রিলিজ করবে তখন ভিভিয়ান ওয়েস্টউডও তার প্রবাদপ্রতিম টি-শার্টটি ডিজাইন করবেন, যার বুক জুড়ে থাকবেন রানি এলিজাবেথ আর তাঁর ঠোঁটে গাঁথা থাকবে একটি সেফটিপিন! সামান্য সেই সেফটিপিন সেদিন গোটা একটা প্রজন্মের কাছে রাষ্ট্র আর সমাজের প্রতি একটি অনবদ্য মধ্যাঙ্গুল হয়ে, বকলমে একটা পুরোদস্তুর আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে।
‘সেক্স পিস্তলস’, ‘র্যামোনস’ প্রভৃতি ব্যান্ডের দেখাদেখি তরুণ-তরুণীরা নিজেদের সর্বাঙ্গে গর্বিত নিশানের মতো সেফটিপিন গেঁথে রাখবে। স্রেফ চমক, স্রেফ চালু ব্যবস্থাকে নাকানিচোবানি খাওয়ানোর জন্য হলেও, সত্তরের পৃথিবীতে সে এক অকল্পনীয় বিষয়! সেফটিপিন শোভিত জনি রটেন লাইভ টিভি ইন্টারভিউতে বলবেন ‘গানবাজনা কে চায় গুরু? আমরা স্রেফ নৈরাজ্য চাই!’ আর তারপর চোপাদুরস্থ ব্রিটিশ অ্যাঙ্করকে ‘ফাক ইউ বাস্টার্ড’ বলে চেপে যাবেন।
তবে সংঘ যা করে উঠতে পারেনি, নৈরাজ্য যে সে জিনিস ঘটিয়ে ফেলবে এমনটা ইতিহাসে নজির নেই। আটের দশক পড়তে না পড়তেই পাঙ্ক (অ)সভ্যতারও সন্ধে গড়িয়ে আসবে। মার্গারেট থ্যাচার বলবেন ‘ওয়ান ক্যান নট বি আ সফটি।’ বলবেন পুঁজিবাদের আগল খুলে দেওয়ার কথা। নয়াউদারনীতিবাদ বলবে বাজারের ওপর রাষ্ট্রের দখলদারির প্রয়োজন নেই। পুঁজিকে উড়তে দাও। আর উড়তে উড়তেই মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনগুলো মানব অস্তিত্বের প্রতিটি আঙ্গিককে, তার সব বিদ্রোহ আর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রবণতা সমেত গিলে নেবে।
তারপর সোভিয়েত-টোভিয়েত ভেঙে একসা হয়ে, লাগামহীন ভোগবাদ যখন ‘নিউ নর্মাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই নব্বইয়ে যখন এলিজাবেথ হারলে নামক স্বল্পপরিচিতা এক নায়িকা হলিউড হার্টথ্রব হিউ গ্রান্টের কণ্ঠলগ্না হয়ে অস্কারের রেড কার্পেটে উপস্থিত হবেন ক্যামেরা হাঁ করে দেখবে তার পরনে ডনাটেলা ভারসাচের ডিজাইন করা এক আঁটোসাঁটো কালো পোশাক, যাকে শরীরের বিভঙ্গের ভিতর পোষ মানিয়ে রাখছে বারোটি সোনালি সেফটিপিন, তখন নৈরাজ্যের চিহ্ন কাউন্টারকালচার, সাবকালচারের হাত ঘুরে অবশেষে ‘কালচার’-এ উন্নীত হইবেন!
এরপর থেকে অবশ্য হাই ফ্যাশনের র্যাম্পে সেফটিপিন বারবারই ফিরে আসবে। এমনকী ২০২৪-এর গ্র্যামি অনুষ্ঠানে মাইলি সাইরাস যখন রেড কার্পেটে শুধুমাত্র সেফটিপিন দিয়ে গাঁথা একটি পোশাক পরে আসেন, তখন কেউই নিজের ভুরুদ্বয়কে জিজ্ঞাসাচিহ্ন করে তোলেন না। ভারসাচের সেফটিফিন লাগানো র্যাপ স্কার্টটির চালু বাজারমূল্য মাত্র ৩১ হাজার ভারতীয় টাকা। প্রাডার সেফটিপিন সম্বলিত মিডি ড্রেস মাত্র এক লাখ পঁচাত্তর। আর শ্যানেলের গোল্ড প্লেটেড সেফটিপিন তো মাত্র দশ হাজার টাকাতেই জোগাড় করে ফেলা যায়!
তবু সে তো আখেরে নিতান্তই সেফটিপিন। সে স্বভাবতই নম্র। সে ধর্মেও আছে, জিরাফেও। খানিক মধ্যবিত্ত, বোকা স্বভাবের। সেফটি পিনের আবিষ্কারক ওয়াল্টার হান্টও যেমন। ভদ্রলোক ঘটনাচক্রে আধুনিক সেলাই মেশিনেরও আবিষ্কারক! কিন্তু ওই যে, খানিক আনস্মার্ট। মেয়ে ক্যাথরিন সেলাইয়ের দোকান চালাতেন। বাবাকে বললেন, মেশিন এলে আমার গরিব কর্মচারীরা খাবে কী? বাবাও ভুলে গেলেন! পেটেন্ট করার কথা দ্বিতীয়বার চিন্তাতেও আনলেন না।
২০১৬ সালে বেশ ঘটা করেই লন্ডনে পাঙ্ক রক সপ্তাহ উৎযাপন হয়ে গেল। অমন গুরুগম্ভীর ব্রিটিশ লাইব্রেরি অবধি পাঙ্ক ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী করে-টরে একসা! ভিভিয়ান ওয়েস্টউডের ছেলে জোফেফ কোরিকে ইন্টারভিউতে দৃশ্যতই বিরক্ত দেখায়। সব রকম প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতাই যার চরিত্র, প্রতিষ্ঠানই যখন তাকে বিক্রি করতে বসে তখন সুস্থ মানুষের বিরক্তিই আসে। তিক্ত স্বরে জানান, ‘ধারেকাছে রাজপরিবারের কোনও বিয়ে-টিয়ে নেই তো, তাই পাঙ্ক নিয়ে ব্যবসা ফেঁদেছে। মায়ের প্রথম দিকের সব ডিজাইন এখনও আমার কাছে। রোজ লোভ দেখাচ্ছে। করব না বিক্রি। আগামী বসন্তে প্রকাশ্যে জ্বালিয়ে দেব সবকিছু। পাঙ্কের প্রতি এটাই আমার ট্রিবিউট।’
কাজেই তোমার, আমার, সবার সেফটিপিন আজও ঠিক ততটাই যৌথ। ইউরোপের বহু দেশে নাকি এখনও সেফটিপিন খুঁজে পাওয়াকে সৌভাগ্যের প্রতীক ভাবা হয়। আমরা যারা কালেভদ্রে শাড়ি পরি, আঁচল বসানোর সময় এ ভাবনার যৌক্তিকতা বিলক্ষণ টের পাই!