জনমানসে ১৯০২ সালের আজকের দিনে যে ছবিটি সবচেয়ে বেশি ঘোরাফেরা করে, তা হল– রাত নটা বেজে দুই মিনিটে অস্ফুট কান্নার আওয়াজ, মাথার এক পাশে হেলে পড়া, শ্বাস থেমে যাওয়া, এবং দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়া– ‘যোগবলে মহাসমাধি প্রাপ্ত হয়েছেন স্বামীজী।’ এই ঐতিহাসিক ঘটনার রূপটি সরিয়ে যদি দেখা যায়, দেখব– মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেহাবসানের ঘটনাকে নিতান্তই তুচ্ছজ্ঞান করতেন বিবেকানন্দ। জাগতিক, ক্ষণজীবী একটি দেহের ‘নেই’ হয়ে যাওয়াই কেবল মৃত্যু? এত বিরাট ধারণার এত সহজ উত্তর? মৃত্যুকে বিবেকানন্দ খুঁজেছিলেন জীবন দিয়ে; সংজ্ঞায়িত করেছিলেন অন্য ভাবে।
প্রচ্ছদের ছবি: সোমোশ্রী দাস
চৌঠা জুলাই তো না হয় বুঝলাম, কিন্তু মৃত্যু কি স্বামী বিবেকানন্দকে কোনও দিন স্পর্শ করতে পেরেছিল আদৌ? আধুনিক কালে অদ্বৈতজ্ঞানের চলমান প্রকাশ তিনি– এক বই দুই নেই যার, তাঁর কীসের জন্ম? কীসেরই বা মৃত্যু? অন্তত আচার্য শঙ্কর তাঁর নির্বাণষটকম্-এ তাইই বলছেন।
কিন্তু বৈপরীত্যে ভরা বিবেকানন্দের জীবন। একদিকে তিনি যেমন জেনেছিলেন ‘জীবন মরণের সীমানা’র পারে দাঁড়িয়ে থাকা চৈতন্যকে, উপলব্ধি করেছিলেন স্বরূপ, তেমনই কেবল সেটুকু নিয়েই নিজের খ্যাতি ও বৈভবের ‘আইভরি টাওয়ার’-এ বসে কাটিয়ে দিতে পারেননি গোটা জীবন। মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করেছিল আলবাত– আক্ষরিক ভাবে ও দ্যোতনায়।
জনমানসে ১৯০২ সালের আজকের দিনে যে ছবিটি সবচেয়ে বেশি ঘোরাফেরা করে, তা হল– রাত নটা বেজে দুই মিনিটে অস্ফুট কান্নার আওয়াজ, মাথার এক পাশে হেলে পড়া, শ্বাস থেমে যাওয়া, এবং দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়া– ‘যোগবলে মহাসমাধি প্রাপ্ত হয়েছেন স্বামীজী।’ এই ঐতিহাসিক ঘটনার রূপটি সরিয়ে যদি দেখা যায়, দেখব– মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেহাবসানের ঘটনাকে নিতান্তই তুচ্ছজ্ঞান করতেন বিবেকানন্দ। জাগতিক, ক্ষণজীবী একটি দেহের ‘নেই’ হয়ে যাওয়াই কেবল মৃত্যু? এত বিরাট ধারণার এত সহজ উত্তর? মৃত্যুকে বিবেকানন্দ খুঁজেছিলেন জীবন দিয়ে; সংজ্ঞায়িত করেছিলেন অন্য ভাবে।
প্রথম জীবনে পিতা বিশ্বনাথ দত্তের দেহাবসানে সংসারে চরম দারিদ্র ও অনটন দেখেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। দেখেছিলেন, সুসময় পেরিয়ে গেলে আত্মীয়ও কেমন হয়ে উঠতে পারে পর! কাজেই, শরীরী মৃত্যু যে তাঁকে কিছুই দেয়নি, এমন বলা হয়তো অনুচিত হবে। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর যখন গুরুভায়েরা মিলে বরাহনগরের পোড়ো বাড়িতে থাকা শুরু করেছেন, নিরন্তর সাধনায় মত্ত সবাই। খাওয়া, ঘুম তো ছার, জগৎ ভুল হয়ে যায়– এমন অবস্থা। ভবিষ্যৎ কী? তা কতটা অনিশ্চিত? এইসব ভাবতে ভাবতে নরেন্দ্রনাথ টের পেতেন, নিশ্চিত বলে জেনে আসা এতদিনের জগৎটার সঙ্গে তাঁর যে মায়ার বন্ধন, যেন আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। পিতৃবিয়োগ ও গুরুবিয়োগ সামলে ওঠা ২৪ বছর বয়সি ছেলেটি বাগবাজার পুলের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনে বিড়বিড় করতেন প্রায়শই, ‘আমার মায়া মরে গেছে!’ গিরিশ ঘোষের ভাই অতুল ঘোষ একবার সেকথা শুনে ফেলেছিলেন। প্রিয়তম দুই মানুষের দেহাবসানের আঘাত ও পরবর্তী ঘটনাক্রম আরও বড় এক মৃত্যুর মঞ্চ সাজিয়েছিল নরেন্দ্রের মনে– মায়ার মৃত্যু! ‘পরকে আপন’ করার পথে, ‘আপনারে পর’ করে যে মরণ, তাকে আলিঙ্গন করেছিলেন সেই যুবক।
পরবর্তী সময়ে, পরিব্রাজক রূপে সমগ্র ভারত পরিক্রমার সময়ে বিবেকানন্দ একেবারে কাছ থেকে দেখেছিলেন দারিদ্রের অক্ষিকোটর, শোষণ ও নিপীড়নের হিংস্র দাঁতনখ। কীভাবে অনাহারে, অবহেলায়, সামান্য বস্ত্র বা অন্নের অভাবে মরে যাচ্ছে দুঃস্থ ভারতবাসী, অসহায় ভাবে দেখেছিলেন বিবেকানন্দ ও কেঁদেছিলেন প্রতিকার খুঁজে না পেয়ে। নিজসাধনে লাভ করা যে ব্রহ্মজ্ঞান, কেবল তা নিয়েই কি খুশি থাকতে পারতেন তিনি? বিদেশে, ধর্মমহাসভায় গিয়েছেন যখন, একদিকে যেমন হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে প্রচার করতে গিয়েছেন বেদান্তের আলোকময় বার্তা, তেমনই অন্যদিকে খোঁজ নিতে গিয়েছেন পাশ্চাত্যের প্রযুক্তি, শিল্প, প্রভৃতির। তাদের মধ্য দিয়েই নিজের দেশের জন্য নিয়ে আসতে হবে রুজিরুটির সন্ধান, রুখতে হবে মৃত্যুর বুভুক্ষু মিছিল। ওই যে বলছিলাম, মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করেছিল আলবাত, তবে ঠিক সেভাবে নয় যেভাবে আমাদের সে ধরে।
উনিশ শতাব্দীর শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে কলকাতায় প্লেগে অসংখ্য মানুষকে মরতে দেখে ছটফট করে ওঠেন বিবেকানন্দ– বাঁচা-মরার তোয়াক্কা না করে নেমে পড়েন প্লেগ-নিবারণের কাজে। সেবার অর্থ ফুরিয়ে আসে; নির্দ্বিধায় বেচে দিতেও প্রস্তুত ছিলেন সদ্য-প্রতিষ্ঠিত মঠ ও জমি। সে অবশ্য করতে হয়নি শেষ অবধি। তবে প্লেগের প্রাদুর্ভাবে বিবেকানন্দের সেবা এখনও মঠ ও মিশনের ইতিহাসে প্রবাদপ্রতিম।
শরীরী মৃত্যুর ভয়, আশঙ্কা, হাতছানি বারবার এসেছে বিবেকানন্দের চৌকাঠে। তিনি জীবনভর খুঁজতেন ‘মানুষ’কে; আর সেই ‘মানুষের’ অপমৃত্যু তাঁকে দর্শনের ‘এলিটিজম’ থেকে জীবনযুদ্ধে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বারবার। তাঁর কাছে মৃত্যু যেন জীবনকে বারবার খুঁজে পাওয়ার পথে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ!
তবে, এই দেহের অবসান, অবসানের আশঙ্কা, বা আঘাত– সবকিছুর অন্য পারে বিবেকানন্দ মৃত্যুকে নতুন করে চিনেছিলেন মানবমনের অসারতার মধ্য দিয়ে। তাঁর লেখায়, বক্তৃতায় বারবার উঠে আসে হৃদয়হীন, অনুদার, সংকীর্ণ মনের সঙ্গে মৃত্যুর তুলনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ১৯ নভেম্বর, ১৮৯৪ সালে আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠিতে বিবেকানন্দের ভাস্বর অক্ষরগুলি জেগে থাকে– “প্রেমই জীবন– উহাই জীবনের একমাত্র গতিনিয়ামক; স্বার্থপরতাই মৃত্যু, জীবন থাকিতেও ইহা মৃত্যু, আর দেহাবসানেও এই স্বার্থপরতাই প্রকৃত মৃত্যুস্বরূপ।… পরোপকারই জীবন, পরহিতচেষ্টার অভাবই মৃত্যু। শতকরা নব্বই জন নরপশুই মৃত, প্রেততুল্য, কারণ হে যুবকবৃন্দ, যাহার হৃদয়ে প্রেম নাই, সে মৃত ছাড়া আর কি?”
এই জীবন্মৃত অবস্থাকেই সর্বান্তকরণে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন স্বামীজী– ‘by fight, or by flight’, তাঁর নিজের ভাষায়। সম্ভবত এইই ছিল তাঁর কাছে মৃত্যুর উপযুক্ত সংজ্ঞা। আত্মম্ভরী, সুবিধাবাদী, পরাশ্রয়ী, পরজীবী যাপনকে তিনি ভেবেছেন দেহাবসানের চেয়েও ভয়ানক মৃত্যু। তাই বারবার মনে করাতেন উপনিষদের অভয়বাণী– “অভীঃ” –নির্ভয়ে এগিয়ে চলো জীবনসংগ্রামে। আমাদের অসীম চৈতন্যসাগরে জন্ম আর মৃত্যু অগুনতি ছোট ছোট ঢেউ ছাড়া আর কী! একটি উঠলে অপরটি পড়বে। ওঠা, বা পড়া– কোনওটাই হাতে নেই যখন, মরার আগে যেন মরে না যায় মানুষ, এইই ছিল তাঁর চাওয়া। আজও, তাঁর প্রয়াণদিবসে যদি মৃত্যুর খোঁজে ‘বাণী ও রচনা’র একটি পাতাও ওলটাই, দেখব– প্রাণ, শুধু প্রাণ পড়ে আছে!
বীরভূমের লেখক-গবেষকেরা মনে করেন, বীরভূমের লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরাতেই সেই পীঠের অধিষ্ঠান আবার বর্ধমানের গবেষকেরা দাবি করেন, ঈশানী নদীর বাঁকে বর্ধমানের দক্ষিণডিহিতেই দেবীর ওষ্ঠপাত ঘটেছিল। তবে ভক্তদের কাছে দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র এবং অলৌকিক শক্তি দুই জায়গাতেই বর্তমান।