মনোজ মিত্রর সঙ্গে আমার আলাপ বহুদিনের। সেই ১৯৬০ সালের দোরগোড়া থেকেই। তখনই মনোজের নাম তরুণ নাট্যকার হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর কত নাটক, কত মঞ্চ, কত আইরে-বাইরে যাওয়া, কত কৌতুকময় বিষাদ। আজ শুধু বিষাদটুকু পড়ে আছে। কৌতুক নিয়ে হাওয়া হয়েছে আমার বন্ধু মনোজ, বাংলা নাটকের একান্ত আপনজন মনোজ মিত্র।
মনোজ মিত্রর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব দীর্ঘ দীর্ঘ দিনের। ধাপে ধাপে সেই বন্ধুত্ব নাটক থেকে ক্রমে ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়েছে। প্রথম যৌবনে যখন থিয়েটারে পা দিয়েছি, তখন থেকেই তখন থেকেই মনোজের কথা জানতাম। আমি ছিলাম প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র আর মনোজবাবু স্কটিশ চার্চ কলেজের। আমার থেকে মনোজ একটু সিনিয়র। সময়টা ১৯৬০ সালের আশপাশে। তখনই মনোজ ‘মৃত্যুর চোখে জল’ নামে একটি নাটক লেখে ও তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। আমরা অন্য কলেজে থাকলেও তার নাটকের খবর পেতাম বরাবর।
পরে, যখন নাটকের দল করি– আমি, বিভাস চক্রবর্তী যখন নাটকের দলে যোগ দিই, তখন মনোজ মিত্র, পার্থপ্রতিম চৌধুরী ‘সুন্দরম’ নামের দল করছে। তখন মনোজের সঙ্গে আলাপ আরও বাড়ল। সে আলাপ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হল ১৯৭২ সালে, ‘চাকভাঙা মধু’ দিয়ে। এই নাটক মনোজ আমাদের প্রযোজনা করতে দিল। ওর লেখা নাটক আমরা ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ থেকে করলাম। বিভাস চক্রবর্তী, আমি এবং মায়া ঘোষ অভিনয় করলাম প্রধান চরিত্রে। সেই নাটক আমাদের যেমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, নতুন নাট্যকার হিসেবেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল মনোজ মিত্রকেও।
’৭৪ সালে আমরা মনোজের ‘অশ্বত্থামা’ করি, ’৭৬ সালে ‘নরক গুলজার’। সমসময়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাটকও আমরা করে চলেছিলাম। আমাদের সময়ের দু’জন সেরা নাট্যকার– মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং মনোজ মিত্র– দু’জনেরই নাটক তখন থিয়েটার ওয়ার্কশপে হচ্ছে। বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় আমরা তখন অভিনয় করছি। এই সময়টায় আমাদের সখ্য আরও বাড়ে।
এই বন্ধুত্ব আরেকটা স্তরে পৌঁছয় নয়ের দশকের গোড়ায়, আমি যখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিভাগে পড়াতে গেলাম। আগে, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ইংরেজি পড়াতাম। পবিত্র সরকার যখন রবীন্দ্রভারতীর ভিসি হন তখন আমাকে নাটক পড়ানোর জন্য নিয়ে যান। মনোজ কয়েক বছর আগে থেকেই ওই বিভাগে ছিল। সেখানে আরেক মনোজকে আমি আবিষ্কার করি– সেই মনোজ– নাটকের শিক্ষক মনোজ। তার অনবদ্য সব ক্লাস, বিশেষ করে অভিনেতার মনস্তত্ত্ব নিয়ে। তা যেমন স্মরণীয় ছাত্রছাত্রীদের কাছে, তেমনই আমাদের মতো সহকর্মীদের কাছেও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
১৯৯৬ সালে আমি মনোজের লেখা নাটক ‘পালিয়ে বেড়ায়’-এর ডিরেকশন দিই। নাটকটা বেশ জনপ্রিয় হয়।
পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সুবাদে অনেক নাটকের শিবিরে আমরা একসঙ্গে গিয়েছি। প্রশিক্ষণ শিবির। মনে পড়ে, সাগরদ্বীপে নাটক রচনার কর্মশালায় ৭-৮ দিন আমরা ছিলাম একসঙ্গে। তাছাড়া, ত্রিপুরাতে সরকারি আমন্ত্রণে রবীন্দ্রভারতী থেকে একটা দল নিয়ে ওয়ার্কশপ করেছিলাম। এইরকম সব কাজের মধ্যে দিয়ে মনোজের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছিল। ফলে অনেক ব্যক্তিগত স্মৃতিও মনে পড়ছে।
তখন ভেবেছি ‘চাকভাঙা মধু’ করব। গল্পটা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক ওঝা পরিবারের গল্প। সাপুড়ে কীভাবে সাপ ধরে, ওঝারা ঝাড়ফুঁক করে রোগী সারায়– তা দেখার জন্য ভাবা হল স্টাডি টুর করা হবে। আমি, বিভাস, মনোজ এবং আমাদের মিউজিক ডিরেক্টর দেবাশিস দাশগুপ্ত– আমরা টাকি-হাসনাবাদ অঞ্চলে দু’-তিনদিনের স্টাডি টুর করি। পুরনো এক জমিদার বাড়িতে গিয়ে আমরা একদিন ছিলাম সেসময়টায়। সে বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই মনোজ নানা রকম গল্প তৈরি করে চলেছিল। ওর বানানো গল্পের সঙ্গে বাড়ির নানা রকম চরিত্র মিলিয়েও দিচ্ছিল আশ্চর্যজনকভাবে। যিনি দেখাশোনা করছেন, তাঁকে পুরনো কর্তা বলে ঠাওর করছিল। এবং বলছিল, ওই জমিদার বাড়িতে এমনকী, ভূতও আছে! এইসব বলে এমন একটা রহস্যের হাওয়া মনোজ বানিয়ে তুলতে পেরেছিল যে, ঘণ্টা ৪-৫ বাদে আমাদের হতে লাগল, এটা সত্যিই কি না!
আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ত্রিপুরায় যখন যাই, ফেরার সময় ফ্লাইটে একজন মানসিক রোগীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁকে মাঝেমধ্যেই ইঞ্জেকশন দিয়ে তোলা হয়েছিল, এবং মাঝেমধ্যেই ঘোর কেটে গেলে তিনি চিৎকার করছিলেন। মনোজের সিটের কাছাকাছিই ঘটছিল ব্যাপারটা। সেখান থেকে উঠে মনোজ আমাদের সিটের কাছে এসে বসে। এবং বলতে থাকে, যে লোকটি অসুস্থ হয়ে শুয়ে রয়েছেন তাঁর অসুখের কারণ কী কী হতে পারে! এই করতে করতেই ও বাকি ফ্লাইটটা কাটিয়ে দিল। ওর বলার মধ্যেই ছিল বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার আশ্চর্য মিশেল– তা ছিল বলেই দুরন্ত সব নাটক মনোজ লিখতে পেরেছে।
ওর চলে যাওয়ায় বাংলা নাটকের, আমার মতো এক বন্ধুর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। এতটাই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল মনোজ, যে কত বড় শিল্পী ছিল, কত বড় নাট্যকার, অভিনেতা, তা আমার পক্ষে এখন, এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব। তবে বলতে পারি, বড় মাপের মানুষ ছিল ও। সহজেই আপন করতে পারত যে-কাউকে। অন্যরকম একটা রসবোধ ছিল, কৌতুকের বোধ– যা ওর নাটকে, লেখায়, চলায়-ফেরায় পাওয়া যায়। সেই কৌতুকের মধ্যে মিশে থাকত একরকমের বিষাদও।
জানি না, কবে আবার এইরকম বড় মাপের একজন মানুষ আসবেন!