মিষ্টির দোকানে প্রায়ই থেমে যেত একটা অস্টিন গাড়ি। রাস্তায় নেমে আসতেন বসন্ত চৌধুরী। তারপর কোন দোকানের কী মিষ্টি ভালো, সে নিয়ে প্রায় গবেষণা। তা অবশ্যই খাতায়-কলমে নয়, জিভ দিয়ে। আলুর প্রতি প্রভূত বিরক্তি ও মিষ্টির প্রতি অতি আসক্তি, এমনই ছিলেন বসন্ত চৌধুরী। ২০০০ সালের ২০ জুন প্রয়াত হন তিনি। বসন্ত চৌধুরীর প্রয়াণের ২৫ বছরে, তাঁকে স্মরণ করলেন তাঁর পুত্র সঞ্জীত চৌধুরী। লেখায় ব্যবহৃত প্রতিটি ছবির জন্যই রোববার.ইন-এর ঋণ রইল তাঁর কাছে।
আমার তখন ১২-১৩ বছর বয়স। বাড়ি থেকে ছাড়া পেয়েছি সদ্য। ফলে একা একা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানোরও স্বাধীনতাও জুটেছে। আমার বাবা– বসন্ত চৌধুরীর মামার বাড়ি ছিল শ্যামবাজারে ‘বিশ্বরূপা’ থিয়েটার হলের কাছেই। বহু পুরনো বড় বাড়ি। উঠোন একখানা নয়, দু’খানা। সে বাড়িতে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। ওদিকে বিশ্বরূপায় বাবা অভিনয় করতেন, আমি মামাবাড়িতে হুল্লোড় করতাম। শো শেষ হলে আমাকে জমা করা হত বাবার কাছে। মামাবাড়ি ভারি মজা তো বটেই, তবে আসল মজাটা শুরু হত এই ফেরার পথে।
বাবা ‘বিশ্বরূপা’য় আসার পথেই নিজের অস্টিন গাড়িটা শ্যামবাজারের এক পবিত্র স্থানে থামাত। সেই পবিত্র স্থান কোনও মন্দির, মসজিদ, চার্চ, গির্জা নয়– উত্তর কলকাতার এক মিষ্টির দোকান– গিরিশ চন্দ্র দে এবং নকুড় চন্দ্র নন্দীর দোকান। নকুড়ের মিষ্টির দোকানের মালিকের কাছে গিয়ে তখনই বাবা জানাত, সেদিন ঠিক কী কী এবং কতগুলো মিষ্টি লাগবে। আজকের ভাষায় যাকে বলে ‘অ্যাডভান্স বুকিং’, ব্যাপারটা ছিল তাই। বাড়িতে গোটা চারেক লোক, কতই বা মিষ্টি লাগতে পারে! ফলে একটা মাঝারি বাক্সে ঠাঁই পেত নানারকম সন্দেশ।
আমার দাদা, সৃঞ্জয় চৌধুরী কোনওকালেই মিষ্টিভক্ত নয়। আমি তখন ঠিক উল্টোটা, ঘোর মিষ্টি-অ্যাডিক্ট বলা চলে, এখন যদিও প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। বাবা শোয়ের পরে, মেক-আপ তুলে রেডি হত ফেরার জন্য। অস্টিন গাড়িতে চেপে পড়তাম আমি, বসতাম বাবার পাশের সিটেই। ফেরার পথে সিগনাল ছাড়া একটাই স্টপ– নকুড়চন্দ্র নন্দী। নকুড় যদিও ততক্ষণে দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। কিন্তু পিছনের রাস্তা আগে থেকেই আমাকে চিনিয়ে রেখেছে বাবা। এ তো আজকের অভ্যেস নয়। সে রাস্তা দিয়ে হাঁটা লাগিয়ে মিষ্টির বাক্সখানা জোগাড় করে ফেলতাম ঠিক। শুনতে পেতাম, ‘অ্যাই, বসন্তদার ছেলে এসেছে, মিষ্টির বাক্সটা দিয়ে দে!’
মানুষ বিস্মিত হয় সাধারণত নতুন কোনও জিনিস দেখলে। কিন্তু প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সুযোগ পেলেই নকুড়ের মিষ্টি খাওয়া বাবা ওই মিষ্টির বাক্সটা দেখেই বলত, ‘দেখি তো কেমন করেছে আজ!’ মনে হত এই প্রথম সেই মিষ্টি বাবা নাগালে পেয়েছে। বাক্সখানা খুলে অনেকসময়ই দেখতাম– নলেন গুড়ের জিভে-জল-আনা সন্দেশ! আমার চেনা, কারণ সে জিনিস, বহুবার বাড়ি এসেছে। বাবার বেশ প্রিয় বলেই জানি।
এদিকে শীতের রাত। শহরের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে খোদ বসন্ত চৌধুরী। অস্টিন গাড়ি হাঁকিয়ে, মুখে মিষ্টি। স্কোরকার্ড বাবা-৪, আমি-৪। মুখের মধ্যে সেই স্বাদ ফুরিয়ে যেতে না যেতেই– ‘আর দুটো দেখি।’ ফলে আবারও। শ্যামবাজার থেকে টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে চলে এসেছি। তখনকার দিনে বেশ রাত। বাড়ি আর সামান্য পথ। বাবা বলল, “ক’টা আছে?” বললাম, ‘চারটের মতো।’ ‘চারটে?’ প্রশ্নটা এমনভাবেই করল যে, বুঝতেই পারলাম মূল বক্তব্য: চারখানা সন্দেশ আর বাড়ি নিয়ে গিয়ে কী হবে! ফলে আমরা এই সামান্য পথেই পার্টনারশিপে ২টো করে মিষ্টি সাঁটিয়ে ফেললাম। এই হল বাবার সঙ্গে একেবারে ছেলেবেলায় মিষ্টি খাওয়ার গল্প।
একবার দক্ষিণ কলকাতার এক বিখ্যাত দোকান থেকে আগের দিন বাবা মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। সে মিষ্টি খাওয়াও হয়ে গিয়েছে। পরের দিন, যাওয়ার পথে, সেই মিষ্টির দোকানের গায়ে গাড়ি পার্ক করলেন বাবা। আমিও নেমে বাবার সঙ্গে দোকানে চললাম। দোকান মালিককে গিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনাদের কি নতুন কোনও কর্মচারী এসেছেন?’ দোকান মালিক বললেন, ‘কই না তো! কেন জিজ্ঞেস করছেন?’ বাবা বললেন, ‘কালকের মিষ্টিটা যে নিলাম, তার স্বাদটা একটু অন্যরকম লাগল।’ ভদ্রলোক বললেন, “না না, আসলে যে বানাত, সে ক’দিনের জন্য দেশে গিয়েছে। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাচ্ছে এখন।” বাবার মিষ্টির সঙ্গে বোঝাপড়া ছিল এইরকমই। মিষ্টি ডিরেক্টরের হাতে তৈরি হয়েছে, না অ্যাসিস্ট্যান্টের হাতে– ধরা পড়ে যেত তাঁর জিভ ডিটেক্টরে।
………………………………………………………………
শীতের রাত। শহরের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে খোদ বসন্ত চৌধুরী। অস্টিন গাড়ি হাঁকিয়ে, মুখে মিষ্টি। স্কোরকার্ড বাবা-৪, আমি-৪। মুখের মধ্যে সেই স্বাদ ফুরিয়ে যেতে না যেতেই– ‘আর দুটো দেখি।’ ফলে আবারও। শ্যামবাজার থেকে টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে চলে এসেছি। তখনকার দিনে বেশ রাত। বাড়ি আর সামান্য পথ। বাবা বলল, “ক’টা আছে?” বললাম, ‘চারটের মতো।’ ‘চারটে?’ প্রশ্নটা এমনভাবেই করল যে, বুঝতেই পারলাম মূল বক্তব্য: চারখানা সন্দেশ আর বাড়ি নিয়ে গিয়ে কী হবে!
………………………………………………………………
সিনেমা, থিয়েটারের পাশাপাশি, বাবা দু’বছর যাত্রা করেছিল নট্ট কোম্পানির সঙ্গে, তখন কাজের সূত্রেই নানা জায়গায় যেতে হয়েছে। কলকাতারই আশপাশে যখন যেত, মফসসলে– হাওড়া কিংবা হুগলিতে, তখন অনেক রাত হলেও বাবা ফিরে আসত। এই যাত্রা করার সময় থেকেই বুঝতে পারলাম বাবা মিষ্টির দোকানের প্রায় এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে উঠেছে। নানা আঞ্চলিক মিষ্টির দোকানের খোঁজখবর রাখত বাবা। কোন দোকানের কী মিষ্টি ভালো, সেসব নিখুঁত তথ্য মাথায় রেখে দিত। ফেরার পথে অবশ্যই সেসব দোকানের মিষ্টি নিয়ে আসত বাবা।
………………………………………………………………
পড়ুন সঞ্জীত চৌধুরীর ফ্রেমকাহিনি: বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
………………………………………………………………
কিন্তু একটা মুশকিলও ছিল। তা হল, যাত্রা করে বাড়ি ফিরতে বাবার অনেকটা রাত হয়ে যেত। কখনও বারোটা-সাড়ে বারোটা, কখনও দুটো। কিন্তু যত রাতই হোক, বাবা আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিত। বলত, ‘নাও, এই মিষ্টিটা এনেছি’। সঙ্গে একটা জলের গ্লাস। আসলে বাবার ব্যাখ্যা ছিল যে, টাটকা মিষ্টির স্বাদ একরকম, আর অনেকটা সময় কেটে গেলে তার স্বাদটা পালটে যায়। আসল স্বাদ আর পাওয়া যায় না। তাছাড়া, মিষ্টি ব্যাপারখানা সেকালে ফ্রিজের স্নেহ পেত না। ফলে, গভীর রাতে মিষ্টি খেতে হত আমাকে প্রায়শই। খেতে হত বলে যদিও একেবারেই কোনও রাগ-টাগ ছিল না। ভাববেন না নিরীহ সন্তানের প্রতি এ কোনও পিতৃ-অত্যাচার! আমি অপেক্ষা করেই থাকতাম, ঘুম থেকে উঠে দুরন্ত একটা মিষ্টি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ব বলে। আর একটা কথা না বললেই নয়, প্রতিবারই মিষ্টি খাওয়ার পর বাবার কৌতূহলী প্রশ্ন ছিল: কেমন লাগল?
১৯৯৭-’৯৮ সাল। আমি সেবার বিজ্ঞাপনের কাজের পাহাড়ে ডুবে। দু’দিনে একবার ঘুমোই। আমাকে একটা প্রোজেক্ট জমা দিতে বলা হয় পুরনো বাড়ি আর তার ইতিহাস নিয়ে। পুরনো একটা কাজ করাই ছিল, সেটাই কিন্তু কিন্তু করে জমা দিয়ে দিই। আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন আর. পি. কাকু– রাধাপ্রসাদ গুপ্ত। ভেবেছিলাম, ল্যাটা চুকে গেল। এ কাজের বরাত নির্ঘাত আমার ওপর এসে পড়বে না। কিন্তু দুভার্গ্য! কাজটা পেয়ে গেলাম। পড়লাম মহা ফাঁপরে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ আমার খুবই বন্ধু ছিল। চটজলদি ওর কাছে গেলাম। সব শুনে ঋতু বলল, ‘আমাকে দে, আমি স্ক্রিপ্টটা লিখি।’ ক’দিন পর থেকে ভোরবেলা– সাড়ে ৫টা-৬টা নাগাদ ঋতুর বাড়িতে যেতাম। আর্লি মর্নিং মিটিং। স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাটাছেঁড়া চলত তখনই। স্ক্রিপ্টের কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে, হঠাৎ করেই ঋতু বলল, ‘এই কাজটা দারুণ করবে বসন্তদা!’ আমি বললাম, ‘আমি বলতে পারব না বাবাকে।’ ‘তোকে কিছু বলতে হবে না, আমিই বলব।’ বাবার সঙ্গে ঋতু ততদিনে ‘হিরের আংটি’ করেছে, একটা বন্ধুত্বও তৈরি হয়েছে। দু’দিন পর বাবা বলল, ‘ঋতু এসেছিল, তুমি করছ তো ছবিটা।’ বুঝলাম, বাবা কাজটায় রাজি।
………………………………………………………………
পড়ুন সঞ্জীত চৌধুরীর ফ্রেমকাহিনি: পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
………………………………………………………………
ছবিটা ছিল দেড় ঘণ্টার একটা ডকু ফিকশন। একটা অংশের শুটিং ছিল চন্দননগরে। শীতের সকাল। বাবা একটা গাড়ি করে চলেছে, সঙ্গে রানা পাল, ঋতুর অ্যাসিস্ট্যান্ট। সেদিনকার শুটিংয়ের ডায়লগ পড়াতে পড়াতে চলেছে। পিছনে আমাদের গাড়ি। ঘড়িতে ৮টা কি সাড়ে ৮টা বাজে, দেখলাম, বাবার গাড়ি থামল। দেখাদেখি আমরাও থামলাম। চন্দননগরের এক বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে বাবা সটান ঢুকে পড়ল।
বাবার চোখে সানগ্লাস। গায়ে গরম জামা। কড্রয়ের ট্রাউজার। দোকানের মধ্যে ঢুকেই মালিকের নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দিল বাবা। কিন্তু কই, তিনি কোথায়! ইতিমধ্যে নানা লোক তাকাচ্ছে, কারণ বসন্ত চৌধুরীকে দুম করে তো মিষ্টির দোকানে হাঁকডাক করতে দেখা যায় না। খানিক পরেই সেই মিষ্টির দোকানের মালিক উপস্থিত। বাবা তাঁর বাড়ির লোকজনের খবরাখবর নেওয়ার মধ্যেই একটা মোক্ষম প্রশ্নবাণ ছুড়ল– ‘ছেলের তো উচ্চমাধ্যমিক এ বছর?’
ভদ্রলোক এক্কেবারে থ! মানে! বসন্ত চৌধুরী একথা মনে রেখে দিয়েছেন! বাবা আসলে বছর দুই আগে গিয়েছিল সেই দোকানে। সেই ভদ্রলোক তখন বলেছিলেন ছেলের মাধ্যমিকের কথা। কিন্তু বাবা যে এতকাল পরে ছেলের উচ্চমাধ্যমিকের অঙ্কটা কষে ফেলবে, ভদ্রলোক একেবারেই ভাবেননি!
………………………………………………………………
পড়ুন সঞ্জীত চৌধুরীর ফ্রেমকাহিনি: ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
………………………………………………………………
অতঃপর সকলের মুখে মিষ্টি উঠল। চমৎকার সেই মিষ্টি। বাবা যদিও বলল, ‘পাকটা আরেকটু কড়া হলে ভালো হত, আর একটু বেশি মিষ্টি লাগছে।’ আমাদের কেমন লাগছে, জিজ্ঞেস করতে বাবা ভোলেনি এবারেও। আমি বলেছিলাম, ‘ঠিকই বলছ, একটু বেশি মিষ্টি, তবে খেতে ভালো।’ বাবা করলেন কী, তখনই গোটা ৪০-৫০টা মিষ্টির অর্ডার দিলেন। সঙ্গে বলে দিলেন, পাকটা কড়া হবে, মিষ্টিটা কম হবে এবং আরও নানা সূক্ষ্ম ব্যাপারস্যাপার– যা শুধুমাত্র ময়রারাই বুঝতে পেরেছিল সেদিন। যখন ফেরা হবে, সন্ধে পার করে, তখন নিয়ে যাওয়া হবে এই অর্ডার দেওয়া মিষ্টি। আমি বললাম, ‘তোমাকে তো টাটকা মিষ্টিই খাওয়াল, আমিও খেলাম, আর তুমি তো জানোই এদের মিষ্টি কীরকম, নিজেদের একটা ধরন আছে।’ বাবা বলল, “ওরা ছ’ জেনারেশনের লোক, ওরা ঠিক করে ফেলতে পারবে!” এমনই আশ্চর্য কনফিডেন্স ছিল বাবার! এইসব অদ্ভুতুড়ে কারণেই এক এক সময় মনে হত সমস্ত মিষ্টির দোকানই বোধহয় বাবা চালায়!
ফেরার সময় সেই মিষ্টির দোকানে আবার হাজিরা দিই আমরা। বাবার ডিরেক্ট করা মিষ্টি খাওয়া হল। সকালের মিষ্টির থেকে ঠিক যতটা আলাদা হবে ভেবেছিলাম, দেখলাম ঠিক ততখানিই অন্যরকম এবং ভালো।
একবার আড্ডা মারছিলাম ইন্দ্রদার সঙ্গে, অর্থাৎ ‘সুবর্ণরেখা’র কর্ণধার ইন্দ্রনাথ মজুমদার। আটের দশকে ইন্দ্রদা একটা ফরেন কনসলেটেড পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বুফে ডিনার পার্টি। বাবাও সে পার্টিতে নিমন্ত্রণ পেয়েছিল। খুব বড় পার্টি নয়। অল্পস্বল্প লোক। বাবা অন্য লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিল। ইন্দ্রদা একসময় বাবার কাছে এসে ফিসফিস করে জানায়, ‘দাদা, খাবারের ওখানে গিয়েছিলাম, সবই তো ফরাসিতে লেখা, কিছু তো বুঝতেই পারছি না! কী খাব তো দূর, কোনটা কী বস্তু, তা-ই তো বুঝছি না!’ ভাবুন, এই ইন্দ্রনাথ মজুমদারই কিন্তু বাদুড় দিয়ে বাংলা খেতেন। একবার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন বাদুড় সহযোগে বাংলা খেতে, কিন্তু মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম এই গর্হিত অপরাধে ইন্দ্রদা আমার বাদুড় খাওয়াও নাকচ করে দিয়েছিলেন। এহেন ইন্দ্রদা, পড়েছেন নাকি খাবার নিয়ে সমস্যায়!
………………………………………………………………
পড়ুন সঞ্জীত চৌধুরীর ফ্রেমকাহিনি: মৃণাল সেনকে এক ডলারেই গল্পের স্বত্ব বিক্রি করবেন, বলেছিলেন মার্কেস
………………………………………………………………
সে যাত্রায় ইন্দ্রদাকে উদ্ধার করেছিল বাবাই। বাবা বলেছিল, ‘ঠিক আছে, আধ ঘণ্টা পরে আয়, আমি তখন ডিনার খাব।’ ইন্দ্রদা যথাসময়ে উপস্থিত। কাঁটা-চামচ এবং প্লেট হাতে ইন্দ্রদা সেই পার্টিতে বাবার পিছু নিয়েছিলেন। বাবা যে যে খাবার নিয়েছিল, ইন্দ্রদাও সেই সেই খাবারই নিয়েছিলেন। ডিনার শেষে ইন্দ্রদা অবশ্য বাবাকে জানিয়েছিলেন, ‘চমৎকার খেলাম!’ বাবা যে কন্টিনেন্টাল খাবারও ভালো জানতেন, বুঝেছিলাম ইন্দ্রদার বলা এই গপ্পেই।
শুধু এই ঝাঁ-চকচকে পার্টিতে নয়, ইন্দ্রদার সোদপুরের বাড়িতেও বাবা খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিল, জানিয়েছিলেন ইন্দ্রদা নিজেই। আটের দশকে একবার শুভেন্দু দাশগুপ্ত, গৌতম ভদ্রকে ইন্দ্রদার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল বাবা। কারণ, দুষ্প্রাপ্য বই দেখা ও কেনা। ইন্দ্রদার বাড়িতে সেদিন নাকি এলাহি খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল। ইন্দ্রদার স্ত্রী দুরন্ত রান্না করতেন। ইন্দ্রদা বলেছিল, ‘পার্টিতে আমি চমৎকার খেয়েছিলাম বসন্তদার কল্যাণে, আর আমার স্ত্রীর হাতে চমৎকার খেয়েছিলেন বসন্তদা।’
যবে থেকে স্মৃতি রয়েছে, মনে করতে পারি, বাবা রোজই দুপুরে একই খাবার খেত। তা ছিল বড় এক টুকরো মাছ। আর কিছু সবজি। করোলা, পেঁপে, কাঁচকলা ইত্যাদি থাকতই সেই সবজিতে। পুরোটাই স্টিম বয়েলড। মশলা বলতে, গোটা মরিচ আর তেজপাতা। এক-দু’বার সে জিনিস খাওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম। অন্তত আমার মতে, তা এক্কেবারে অখাদ্য!
একবার দুপুরে বাবা খেতে বসেছে। খাদ্যবস্তু সেই একই। কিন্তু এইদিন ডাক পড়ল রান্নার ছেলেটির। বাবা বকাবকি শুরু করল, ভদ্রভাবেই। ব্যাপার কী? বাবা বলছে, ‘আলু দিয়েছ কেন!’ তাকিয়ে দেখি, একটা ছোট্ট আলু, চার টুকরো, বাবার খাবারে ভাসছে। বুঝলাম, ছেলেটি অন্যায় করে ফেলেছে, কারণ আলুতে ফ্যাট রয়েছে। বাবা একটা দীর্ঘ লেকচার দিল সেই খাবার টেবিলে বসে। মূল বিষয়: আলু খাওয়ার অপকারিতা। বাকিরা হাঁ করে শুনলাম। ছেলেটিও লজ্জিত। এই ঘটনার খানিকক্ষণ পরেই বাবার সঙ্গে ঠাকুমার বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে বাবা একেবারে দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন ভাবেই জামবাটি করে ঘন পিঠে-পায়েস খেয়েছিল দু’বাটি!
রাধাপ্রসাদ গুপ্তর মেয়ে, গার্গী গুপ্ত একদিন আড্ডায় বলেছিল, বাবা ওদের বাড়ি গেলেই ঘরে তৈরি একটা ফ্রেশ লাইম সোডা দেওয়া হত। এই পানীয়টা বানিয়ে দেওয়া হত কারণ, ওদিকে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত রাম পান করছেন। এদিকে বাবার রাম চলে না। ফলে এই নতুন পানিপথ ধরা। একটা সময়, এই ফ্রেশ লাইম সোডা খাওয়াই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল বাবার। ক্যালকাটা ক্লাবেও দেখেছি, একটা বোতলে করে ফ্রেশ লাইম সোডা সার্ভ করা হত, যা খেয়ে বোতলটা ফেরত দিতে হত। বাবা সে জিনিস কিনত মাঝেমাঝেই।
এসব খুচরো নিয়মভঙ্গের বাইরে বাবাকে একরকম শৃঙ্খলাপরায়ণই বলা চলে। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মোটামুটি নজর তো রাখতই। সিগারেটও ছেড়ে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ধরা পড়ল ক্যানসার। তখন অনেকটাই ছড়িয়ে পড়েছে। বয়সোচিত কারণে বাবার মাঝে একটু ভুঁড়ি হয়েছিল, ওজন বেড়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। সেসব কমানোর চেষ্টাও করছিল। ক্যানসারের চিকিৎসা, নানা ওষুধপত্তরের প্রকোপ ও নিয়ম করে খাওয়ার কারণেই বাবার ওজন খানিকটা কমতে শুরু করল। বাবা রসিকতা করে, একমুখ হাসি নিয়ে বলেছিল, ‘গত ১০ বছরের চেষ্টায় তো হয়নি, যাক, এখন এই ভুঁড়িটা অন্তত কমছে।’
এই সময়টায় বাবার জন্য স্পেশাল মিষ্টি আসত। কে. সি. দাশের বাড়ির এক ছেলে, বাবারই বন্ধু, মিষ্টি বানিয়ে নিয়ে আসতেন। বাবাকে না পেলে, আমাকে দিয়ে বলতেন, ‘এটা দাদাকে দিও।’ ক্যানসারের জন্য জিভে স্বাদের নানা বদল হত, তাই এই ব্যবস্থা।
শরীর ক্রমে ভাঙছিল। যদিও, মাথা চিরকালই ঝকঝকে, পরিষ্কার। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল বলতে বলতে। একটা সময় দেখা গেল, বাবা আবার ঝরঝরে কথা বলছে। অতটা অসুবিধে হচ্ছে না। তখন আমরা– মানে আমি, আমার দাদা সৃঞ্জয় এবং বাবার আরেক সন্তানই বলা চলে, যাদবপুরের ইংরেজি বিভাগের বিগত অধ্যাপক স্যমন্তক দাস এবং বাবা– চারজন মিলে ডিনার করলাম। সে এক চমৎকার ডিনার! মনে আছে, স্যমন্তক বলেছিল যে, ডিনারটা বাবা দারুণ আনন্দ করে খেয়েছে। নানা খাবারের সঙ্গে যা থাকতে হতই, ছিল সেই মিষ্টিও।
পরের দিন ভোরবেলায়, আমার বাবা, বসন্ত চৌধুরী মারা যায়।