Robbar

তাঁর মৌন থাকাকে ‘অকর্মণ্যতা’ বলে বহু অপপ্রচার করা হয়েছে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 27, 2024 7:23 pm
  • Updated:December 27, 2024 8:48 pm  

প্রচার প্রোপাগান্ডার বাইরে তিনি ছিলেন চুপচাপ কাজ করার মানুষ। তাঁর মৌনতাকে ‘অকর্মণ্যতা’ বলে অনেক অপপ্রচার করা হয়েছে। কিন্তু নিজে পণ্ডিত মানুষ ছিলেন বলে, পাণ্ডিত্যের প্রয়োজনীয়তা ও মূল্য বুঝতেন। আজ মনমোহন সিংহের প্রয়াণে শুধু এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই আমরা হারালাম না। সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতের যেসব উচ্চশিক্ষিত তরুণরা দেশকে শিক্ষায় দীক্ষায় বড় করার কাজে একদা মেতে উঠেছিলেন, সেই প্রজন্মের এক নক্ষত্রকে হারালাম।

বিভাস সাহা

ভারতের প্রথম অহিন্দু এবং ত্রয়োদশ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের মৃত্যুতে আমরা এক দুর্লভ প্রজাতির শেষ মানুষটিকে হারালাম। এমন বড় মাপের অর্থনীতিবিদ, দক্ষ অর্থনৈতিক প্রশাসক এবং পণ্ডিত মানুষ ভারতের রাজনীতিতে আর দেখা যাবে না। এসবের উপরেও বড় পরিচয়, এক নিপাট ভালো মানুষ। কোনও অহং বোধ নেই, দূরত্ব সৃষ্টি নেই, যে কথা বলতে চেয়েছে, তার সঙ্গেই তিনি সস্নেহ কথা বলেছেন। যখন তিনি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন, সহজেই তাঁর কাছে তরুণ ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপকরা যেতে পারত। তাঁর সম্ভ্রান্ত মৌনতায় ছিল শোনার আগ্রহ, জ্ঞান চর্চার প্রশ্রয়। আমার কর্মজীবনে বেশ কয়েকবার খুব কাছ থেকে ওঁকে দেখার সুযোগ হয়েছে, প্রত্যেকবার শ্রদ্ধায় ও সম্ভ্রমে মাথা নত হয়েছে।

Image

কিন্তু ওই ত্রয়োদশ সংখ্যাটি বোধ হয় অশুভ। তাই তাঁকে বাম-ডান সবদিক থেকেই বারবার আক্রমণ করা হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়ির পরম্পরা তাঁর গায়ে কালি মাখানোর অনেক চেষ্টা করেছে।

কিন্তু সেকথা আজ থাক। কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা করা এক মধ্যবিত্ত পাঞ্জাবি পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষটির বিপুল কর্মজীবনকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি, দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সের অধ্যাপনা (১৯৬৯-’৭১)। দ্বিতীয়টি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালনা (১৯৮২-’৮৫)। তৃতীয়টি বিভিন্ন উচ্চপদস্থ পদে আসীন হওয়া ( বিভিন্ন সময়ে), যেমন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (১৯৭২-’৭৬) যোজনা কমিশনের প্রধান (১৯৮৫-’৮৭) ইত্যাদি নানা দায়িত্ব। চতুর্থটি ভারতের অর্থমন্ত্রী (১৯৯১-’৯৬), এবং পঞ্চম ও  শেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল প্রধানমন্ত্রিত্ব (২০০৪-২০১৪)।

আন্তর্জাতিক ভাবে তাঁকে আধুনিক ‘ভারতের রূপকার’ বলে ধরা হয়। অর্থাৎ ১৯৯১-’৯৬ সালের নরসিমা রাওয়ের সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত সাহসী কিছু সিদ্ধান্ত তাঁর জীবনের বোধহয় সবচেয়ে সেরা কাজ। তাঁর হাত ধরেই ভারত মুক্ত অর্থনীতির পদযাত্রা শুরু করে।

এই বিষয়টি বুঝতে গেলে আমাদের স্মরণ করতে হবে যে, পণ্ডিত নেহরু দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় (১৯৫৬) থেকে এক মিশ্র অর্থনীতির মডেল অনুসরণ করেন। এই মডেলের প্রাথমিক সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ইন্দিরা গান্ধী আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে লাইসেন্সিং প্রথা চালু করেন, যার মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগ ও বিনিয়োগের উপর বিবিধ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। যেমন, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও নতুন বিনিয়োগ করা যেত না। পরে এই নিয়ন্ত্রণ শুধু বিনিয়োগের উপর নয়, কর্মী ছাঁটাই বা কারখানা বন্ধের উপর আরোপিত হয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ, বিশাল পরিমাণ আমদানি শুল্ক এবং বৈদেশিক মুদ্রার দাম সরাসরি বেঁধে রাখার মাধ্যমে।

এই নিয়ন্ত্রণগুলি যে অবান্তর, তা নয়, কিন্তু এগুলির সুফল স্বল্পমেয়াদি হয়, আর কুফল হয় দীর্ঘস্থায়ী। অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ হলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়, মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে, বৈদেশিক ঘাটতি লাগামছাড়া হয়। রাজীব গান্ধী তাঁর স্বল্প সময়ে মুক্তির হাওয়া আনেন। কিন্তু মনমোহন সিং অনেক ধাপ এগিয়ে লাইসেন্সিং প্রথা তুলে দেন, আমদানি শুক কমান, রপ্তানিতে উৎসাহ দেন। বৈদেশিক বাণিজ্যকে ধাপে ধাপে মুক্ত করেন, যার ফলে টাকার বৈদেশিক মূল্য প্রকৃত বাজার দরে পৌঁছায়। তাঁর সময় থেকেই ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ শুরু হয়। এছাড়া আরও অনেক কিছু পদক্ষেপ নেন, যেগুলি সেসময় কষ্টকর মনে হলেও সুফল দিয়েছে পরে। মজার ব্যাপার হল, এই পরিবর্তনগুলি সবাই মনে মনে চাইলেও রাজনৈতিক ঝুঁকির জন্য কোনও দলই আগ্রহী ছিল না। বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

Image

অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের এইসব যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফল মিলেছিল কয়েক বছরের মধ্যেই। যে ভারতের গড় জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার একসময় ছিল ৩ শতাংশ, সেই ভারতেই এই বৃদ্ধির হার ১৯৯০-’১০ এর মধ্যে ৭ শতাংশে উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সময়ে (২০০৪-’১৪), মাত্র দু’টি  বছর বাদ দিলে– ২০০৮, আন্তর্জাতিক অর্থবর্ষের সংকটের বছর, এবং ২০১১– বাকি ৮ বছর ধারাবাহিকভাবে প্রায় ৮ শতাংশ হারে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রেকর্ড অসাধারণ! বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদি এখনও এই রেকর্ড ছুঁতে পারেননি। একই সঙ্গে দারিদ্র কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ১৯৯৩ সালে দারিদ্রর হার প্রায় ৪৮%, আর ২০১৫ সালে এই হার নেমে আসে প্রায় ১৯% (দৈনিক দু’-ডলার পনের সেন্ট আয়ের হিসেবে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী)। ২০২১ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩%।

দারিদ্র বিষয়ে তাঁর দু’টি কাজের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। অর্থনীতির প্রখর জ্ঞানী মনমোহন জানতেন যে, বেসরকারি উদ্যোগের আওতায় সবকিছু অবাধে আনলে মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে; যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, রান্নার জ্বালানি, চাল গম ইত্যাদি। তাই তিনি এগুলিকে অবাধ বেসরকারিকরণ থেকে দূরে রেখেছিলেন।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল, একশো দিনের কাজের প্রকল্প। এটা একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। এই প্রকল্পের বিরোধিতা শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেসের একাংশও করেছিল। কিন্তু বামপন্থীদের সমর্থনে এবং বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের উপর ভরসা করে এই দুরূহ কাজে তিনি হাত দেন। আমরা জানি, এই প্রকল্প মানুষের বিরাট উপকারে এসেছে।

Image

প্রচার প্রোপাগান্ডার বাইরে তিনি ছিলেন চুপচাপ কাজ করার মানুষ। তাঁর মৌনতাকে ‘অকর্মণ্যতা’ বলে অনেক অপপ্রচার করা হয়েছে। কিন্তু নিজে পণ্ডিত মানুষ ছিলেন বলে, পাণ্ডিত্যের প্রয়োজনীয়তা ও মূল্য বুঝতেন। নিজের উৎসাহে খুব বড় মাপের তিন অর্থনীতিবিদকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে টেনেছিলেন। প্রথমজন হলেন কৌশিক বসু, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব প্রধান অর্থনীতিবিদ। কৌশিক বসুকে তিনি প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা করেন। দ্বিতীয়জন– রঘুরাম রাজন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রঘুরামকে  রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর করেন। আর তৃতীয় ব্যক্তিটি হলেন, জন ড্রেজ। একশো দিনের কাজ প্রকল্পে ড্রেজের ভূমিকা ও পরামর্শ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ড্রেজ জন্মসূত্রে বেলজিয়ান (এবং এক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদের পুত্র), কিন্তু বহু দিন ভারতের অধিবাসী, ভারতের দরিদ্রতম মানুষদের নিয়েই তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা, কাজকর্ম, ব্যক্তিগত জীবনে তাঁদের সঙ্গেই থাকেন।

আজ মনমোহন সিংহের প্রয়াণে শুধু এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই আমরা হারালাম না। সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতের যেসব উচ্চশিক্ষিত তরুণরা দেশকে শিক্ষায় দীক্ষায় বড় করার কাজে একদা মেতে উঠেছিলেন, সেই প্রজন্মের এক নক্ষত্রকে হারালাম।

…………………………………………………………………………….

লেখক ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক