Robbar

প্রীতীশদা কী কী ভাবে মরতে চাইতেন না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 9, 2025 3:02 pm
  • Updated:January 9, 2025 3:32 pm  

মাঝে মাঝে যা খুশি বলার মতো একটা খোশগপ্প হত বোধহয় এই বয়সের কারণেই। সেই গপ্পেই তিনি একবার বলেছিলেন, কী কী ভাবে তাঁর মরতে ভালো লাগে না। প্রথমত, বাথরুমে কোনওভাবেই না। কারণ, কী চেহারাতে লোকে ওঁকে দেখবে, কে জানে! প্রীতীশদা ফ্যাশনপ্রিয় লোক, যাতে তাঁকে খারাপ না দেখায়, সেই জন্যই মৃত্যুর মঞ্চ হিসেবে বাথরুমটাকে বাতিল করেছিলেন। যদিও যে জামাকাপড় তিনি পরতেন, তা সবসময় যে খুব আধুনিক, কেতাদুরস্ত হত, এমন নয়। কিন্তু আধুনিক হওয়ার একটা শখ তো তাঁর ছিলই। আশ্চর্য হাই হিল খটখট করে আওয়াজ করা জুতো ছিল। সরু, গা-চাপা জিন্‌স পরতেন। কলারগুলো ছিল বড়। পরতেন কানে দুলও।  

প্রীতীশ নন্দীর প্রতিকৃতি সমীর মণ্ডল

সমীর মণ্ডল

প্রীতীশদার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪।  প্রীতীশদা বলছিলেন, কলকাতায় এক প্রদর্শনী থেকে তিনি একটা গ্লাস পেইন্টিং কিনেছিলেন, কিন্তু তাতে সই নেই! সেই শিল্পীর যদি কোনও খোঁজ দিতে পারি আমি। বারবারই বলছিলেন, ওঁর যে সংগ্রহ, তা গুছিয়ে রাখা দরকার, খুব একটা গুছিয়ে রাখা হল না। কথাবার্তা মৃদুস্বরে, টের পেয়েছেন যেন, আর সময় নেই। তবে শুধু ছবি নয়, প্রীতীশদা এত পরিমাণে বইপত্র পেতেন যে, ওঁর বান্দ্রার ফ্ল্যাট ছিল বইয়ের গোডাউন। নিজের বসতবাড়িতে গোছানো লাইব্রেরি থাকা সত্ত্বেও, এই কাণ্ডটা প্রীতীশদাকে করতেই হয়েছিল। আর্কাইভ করার মতো সময় ওঁর ছিল না কোনও দিনই।

প্রীতীশ নন্দী। শিল্পী: সমীর মণ্ডল

আমাদের বয়স প্রায় একই। যদিও বলতাম ‘প্রীতীশদা’। মাঝে মাঝে যা খুশি বলার মতো একটা খোশগপ্প হত বোধহয় এই বয়সের কারণেই। সেই গপ্পেই তিনি একবার বলেছিলেন, কী কী ভাবে তাঁর মরতে ভালো লাগে না। প্রথমত, বাথরুমে কোনওভাবেই না। কারণ, কী চেহারাতে লোকে ওঁকে দেখবে, কে জানে! প্রীতীশদা ফ্যাশনপ্রিয় লোক, যাতে তাঁকে খারাপ না দেখায়, সেই জন্যই মৃত্যুর মঞ্চ হিসেবে বাথরুমটাকে বাতিল করেছিলেন। যদিও যে জামাকাপড় তিনি পরতেন, তা সবসময় যে খুব আধুনিক, কেতাদুরস্ত হত, এমন নয়। কিন্তু আধুনিক হওয়ার একটা শখ তো তাঁর ছিলই। আশ্চর্য হাই হিল খটখট করে আওয়াজ করা জুতো ছিল। সরু, গা-চাপা জিন্‌স পরতেন। কলারগুলো ছিল বড়। পরতেন কানে দুলও।

Pritish Nandy passes away, Anupam Kher pays tribute | Filmfare.com
একমাথা চুলের প্রায় অচেনা প্রীতীশ নন্দী

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, একসময় প্রীতীশদার মাথার চুল উঠে যাচ্ছে দ্রুত। কলকাতা থেকে তিনি যখন বোম্বেতে এসেছিলেন, মাথা ভর্তি চুল ছিল তাঁর। সেসব ছবিও দেখেছি। একদিন রিনাবউদি দেখলেন, প্রীতীশদা কোথা থেকে ন্যাড়া হয়ে চলে এসেছেন! প্রীতীশদা বলেছিলেন, অল্প চুল গুছিয়ে আঁচড়ে যে ম্যানেজ করি, গাড়িতে যেতে গিয়ে হাওয়ার কবলে পড়ে, বিচ্ছিরি অবস্থা হয়! এই যে চুল উড়ে গেলে, প্রীতীশদা ভালো দেখাবে না, এবং সেজন্য সমস্ত চুলই সেলুনে বিসর্জন দিলেন– এই হল আশ্চর্য মজার, পাগলামি ভরা প্রীতীশ নন্দীর চিন্তা। ফলে মৃত্যুর পরেও, লোকে তাঁকে যা খুশি ভাবে দেখবে, এই ব্যাপারটা তাঁর ভালো লাগেনি। এমনকী, তিনি চাইতেন না কোনওভাবে রোড অ্যাক্সিডেন্টেও মারা যান।

প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে প্রথম দেখা, সম্ভবত ’৮৬ সালে। বেঙ্গালুরুতে। বোম্বের ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র তরফে তিনি মাঝে মাঝে টুরে যেতেন। জানা গেল, প্রীতীশ নন্দী হোটেলে থাকছেন। আমার বন্ধু রঞ্জন ঘোষাল ও আমি– দু’জনে মিলে ঠিক করলাম আলাপ করতে যাব। সন্ধেবেলায়, অফিসের কাজ মিটিয়ে দেখা করতে গেলাম। রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলাম, বলা হল, প্রীতীশ নন্দী এখন রুমে নেই। ভাবলাম, কতক্ষণ আর বাইরে থাকবেন, অফিসের কাজে বেরিয়েছেন, বড়জোর বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার করে ফিরে আসবেন। যখন এলেন তখন রাত ২টো ছুঁই ছুঁই! প্রীতীশদা জুতোর আওয়াজ করতে করতে ঢুকলেন, রিসেপশন তখন ফাঁকা। লিফটের দিকে হাঁটা দিয়েছেন, এমতাবস্থায় আমরাই প্রীতীশদাকে পাকড়াও করলাম। উনি প্রথমেই খুশি হলেন শুনে যে, আমরা সন্ধেবেলা থেকে ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে আছি। তার ফলে খানিক গলেও গেলেন। রঞ্জন প্রস্তাব দিল, ‘এভাবে আড্ডা হবে না, একদিন যদি আপনার সঙ্গে সময় করে একটু বসা যেত।’ প্রীতীশদা রাজি হলেন। আড্ডাটা ঠিক হল রঞ্জনের বাড়িতেই হবে। খাবেন দাবেন আড্ডা দেবেন– এই হল প্ল্যান।

আড্ডার জন্য আমরা আরও ক’জন বাছাই আর্টের, নাটকের, সাহিত্যের বন্ধু জোগাড় করেছি। আড্ডায় যে খুব কথা বলতেন প্রীতীশদা, এমন না। শুনতেন, মজা পেতেন, বেশি কিছু বলতেন না। ওঁর কোনও দিনই খুব বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করত না। লিখতে বললে, ১০০০ শব্দ তক্ষুনি লিখে ফেলবেন, কিন্তু খুব যে কথা বলবেন, তা নয়। উঠবেন উঠবেন করছেন যখন, রিংকু, রঞ্জনের স্ত্রী তখন ঠিকই করে নিয়েছিল, প্রীতীশদাকে আরও খানিকটা আটকাতে হবে। আরেকটু জোরজার করে রাখতে হবে। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার পরও তাই, না প্রীতীশদা, আপনি ফেরত চলুন, আরেকটু থাকুন– এই ‘যানে কি জিদ না করো’ মার্কা আর্জি ছিল রিংকুর।

veteran journalist and filmmaker Pritish Nandy dies at 73 Anupam Kher pays heartfelt tribute ENT : 2025-01-08 | Aajkaal Bengali News, Bangla News, Breaking News in Bengali
বইপড়ুয়া প্রীতীশ নন্দী

প্রীতীশদা এসব শুনছেন। কিন্তু মনস্থির করেছেন, চলেই যাবেন। ফলে গাড়িতে ড্রাইভার উঠল, পিছনে উঠলেন প্রীতীশদা। হেডলাইট জ্বলল, গাড়িও স্টার্ট দিল। এমন সময় রঞ্জন একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাল! এরকম অনেক কাণ্ডই যদিও ও ঘটাত। ওর একটা ইশারায় আমরা ৬-৭ জন মিলে পরপর গাড়ির সামনে সটান শুয়ে পড়লাম রাস্তায়! গাড়ি থেকে নেমে এল প্রীতীশদা, আমরা ধুলোবালি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। প্রীতীশদা চলে গেলেন বটে, কিন্তু এই জেসচার আমাদের তরফে প্রীতীশদাকে একরকমের উপহার, যা প্রীতীশদা কখনও ভুলে যাবেন না।

প্রীতীশদা নিজেকে সাংঘাতিক উঁচু জায়গায় রাখতেন। তিনি বুঝতেন নিজেকে। বুঝতেন, অন্য অনেকের চেয়ে তিনি উন্নত মানুষ। এই বোধটা সবসময় থাকত। ওঁর পাগলামি এই বোধ থেকেই। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ অফিসের লিফট থেকে নেমে, প্রীতীশদাকে একটা হলঘরের মধ্যে দিয়ে নিজের কেবিনে যেতে হত। দু’পাশে অনেক ব্যারিকেড তোলা টেবিলে হু হু করে কাজ হচ্ছে। প্রীতীশদা হাই হিল জুতো পরে, শব্দ করে করে যেতেন। হান্টার শু গোছের। ওই যে ঠকঠকে জুতো, মানে, শোনো, তোমাদের বস এসেছে। হাতে একগুচ্ছ অগোছালো বই-পত্রিকা-ছবি। ওঁর টেবিলে, যাবতীয় যা কিছু জমা হত সারাদিন, তা ড্রাইভার এসে নিয়ে যেত। বেরতেন খালি হাতে। হলঘরে যখন ঢুকতেন, সাধারণত মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন, কিন্তু দুম করে কারও একটা টেবিলের কাছে এসে, ‘আমার মনে হয় এটা, ফেরোনোম না ফেরোমোন হবে।’ বলে চলে যেতেন। চলতি পথে, যেতে যেতে তিনি দেখছেন সবই, এমনকী, বানান ভুলটাও।

এটা প্রীতীশদার এক ধরনের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ জেসচার। সকলে একটু ভয় পাবে, চমকে যাবে। মানুষটা যদিও একেবারেই উল্টো।  কিন্তু ওই অফিসে চেয়ারে বসে তিনি যে কারও কবিতা পড়ে ছিঁড়ে ফেলতে পারতেন। আমার ছবিও ছিঁড়ে ফেলেছেন। ‘সমীর যাঃ, এটা কোনও ছবিই হয়নি! এটা তোমার কাজ হয়নি। শোনো, লড়ে যাও, জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ কাজ করো, তারপর কালকে মরে যাও!’– এই বলে প্রীতীশদা আমার কাজও ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। খুব কষ্ট পেতাম। কিন্তু এখন জানি, তারপর যে কাজটা করেছিলাম, সেটা ওই ছবিটার চেয়ে অনেক ভালো। ফলে যে কাজটা জগতের লোক দেখছে ইলাস্ট্রেটেড উইকলির মলাটে, আমি হাততালি পাচ্ছি– তার জন্য প্রীতীশদা দারুণভাবে দায়ী। এই বোধটা আমার পরে তৈরি হয়েছে। অথচ ছবি ছিঁড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা মনেই হতে পারে, নৃশংস, দাম্ভিক। কিন্তু সত্যিই প্রীতীশদা লোকজনদের থেকে শ্রেষ্ঠ কাজটা বের করে আনতে পারতেন, দরকারে, টর্চার করেও। এখন বুঝি, সত্যিই শ্রেষ্ঠ কাজটা প্রীতীশদার কাছে হত। সকলের থেকেই কাজ আদায় করে নিতেন। ফোটোগ্রাফারদের বলতে শুনেছি, ‘আলাদা একটা প্যান্ট নিয়ে যাও, জলে নেমে তুলবে, বুঝেছ?’ একটা ক্লু দিয়ে দিতেন ছবির বিষয়ে, যেহেতু প্রীতীশদা ফোটোগ্রাফার ছিলেন। গোটা ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ ছাপা হত ফোটোগ্রেভিং প্রসেসে। কিন্তু এটা সময় মেশিন রিপেয়ারের পার্টস, বা নতুন মেশিন পাওয়াই গেল না। বাধ্যত ইলাস্ট্রেটেড উইকলি বন্ধ করতে হল। পত্রিকাটা সাধারণ পত্রিকার মাপেরও ছিল না। প্রীতীশদার সম্পাদনাতেই কিছুদিন কাগজের মতো ব্রডশিটে বড় আকারেও ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তা আর ভালো লাগল না কারও। প্রীতীশদা চেয়েছিল নিজে কাগজটার মালিকানা নিয়ে চালাতে। সেটাও শেষমেশ হয়নি।

ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বিস্ময় বালক’, ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’র প্রচ্ছদে

প্রীতীশদা কখনও বোঝাতে চাইতেন না, যে, ওঁর কোনও কষ্ট হচ্ছে, খিদে পেয়েছে– সব ব্যাপারেই একটু আড়ালে। ওঁর প্রকৃত বন্ধু যে কে, বোঝাই যেত না। নিজেও বুঝতে দিতেন না। রাত্তিরবেলা শুতে গেলে ফোন রেখে দিতেন বালিশের পাশে। প্রথম যখন রিং হবে, তিনি তখন শুধু দেখতেন। দ্বিতীয় রিংয়ের সময় উঠে বসতেন। তৃতীয় বা চতুর্থ রিংয়ে তিনি ধরতেন সেই ফোন। কেন এমনটা? এই তিন-চার রিংয়ের মধ্যে প্রীতীশ নন্দী আসলে নিজের গলা-টলা ঝেড়েকেশে একেবারে ঠিক করে নিতেন। যাতে উল্টোদিকের লোকটা তাঁর ঘুম-জড়ানো গলা না পায়। এবং তিনি খুব পরিষ্কার গলায়, বলতেন, ‘হ্যালোও!’ উল্টোদিকের লোকটা তখন হয়তো বলল, ‘প্রীতীশদা আমি অমুক বলছি, হাউ আর ইউ?’ উনি বলবেন, ‘এক্সিলেন্ট! বলো!’ অর্থাৎ উনি দেখাবেন, প্রচণ্ড কাজে আছি, প্রীতীশ নন্দী কখনও ঘুমোন না! সত্যি কথা বলতে কী, উনি আসলে দিনের ৩-৪ ঘণ্টাই ঘুমাতেন।

একদিন ট্রেন ধরব, প্রীতীশদা বললেন, ‘আমিও বেরব, তোমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিচ্ছি।’ মাঝপথে একটা সময়, রাস্তা পেরিয়ে দু’চার বিল্ডিং দূরে, প্রীতীশদার গন্তব্য– ড্রাইভারকে বললেন, ‘দাঁড়াও, এখানে নেমে যাই।’ আমি বললাম, ‘না না, আপনি কেন নামবেন, আমিই নেমে হেঁটে চলে যাই।’ প্রীতীশদা বললেন, ‘ও পৌঁছে দেবে তোমাকে স্টেশনে, আমার একটু তাড়া আছে।’ আমি গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দেখলাম, প্রীতীশ নন্দী, তাঁর হাই হিলের জুতো পরে রাস্তার ডিভাইডারে জুতো ফাঁসিয়ে পড়ে গেলেন! চারপাশ থেকে ক’টা লোক এসে তুলল প্রীতীশদাকে। ভাবলেশহীনভাবে তারপর তিনি রাস্তা পেরিয়ে গেলেন।

‘দূরদর্শন’-এ একসময় খুব ‘হিট’ করে ‘প্রীতীশ নন্দী শো’। সেখানে হোমরাচোমরা লোকেদের ডেকেও যাচ্ছেতাই ঝামেলার মুখে ফেলে দিচ্ছিলেন। যাঁরা অতিথি, তাঁদের মুখের ছবি এঁকে দিতাম আমি। এই সাক্ষাৎকারে প্রীতীশদা সত্যিই চমকে দিতে পারতেন। শিল্পী, রাজনীতিবিদ তো বটেই, পুলিশ যে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা লোককে খুঁজেই পাচ্ছে না, সেখানে প্রীতীশ নন্দী দিব্যি পাতার পর পাতা সে-লোকের সাক্ষাৎকার ছাপিয়ে ফেলছেন!

A Weekly Fix Like No Other

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পে আসি। ‘আনন্দমেলা’য় ছোটদের জন্য মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কমিকস করার একটা প্রস্তাব এসেছিল, সিদ্ধার্থ ঘোষের সুপারিশে। সে-ই আমাকে গল্পের পাতার কিছু ছবি পাঠিয়ে বলেছিল, চেষ্টা করে দেখতে। আমার যদিও মনে হয়েছিল, ওই গল্পগুলো সবসময় বাচ্চাদের ভালো লাগবে না। সত্যজিৎ রায়ের মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প নামের পাতলা বইটা পড়ে দারুণ লেগেছিল তার আগেই। আমিই উত্তেজনাবশত প্রীতীশদাকে বলি, ‘আপনার কাছে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের ইংরেজি বইটা আছে? যেটায় অনেক গল্প পড়তে পারি?’ প্রীতীশদাকে ২৫-৩০ বার মনে করানোর পর একদিন, এনেছিলেন সেই দু’খণ্ডের বই– খুব সম্ভবত ২৫০-৩০০ মতো গল্প ছিল এক একটাতে। বইটা আমার হাতে দিয়েও হাত থেকে কেড়ে নিলেন প্রীতীশদা!  কী ব্যাপার! বললেন, ‘না, বই দেওয়া যাবে না, কী করবে এ নিয়ে?’ আমি বললাম, ‘আনন্দমেলার জন্য কমিকস’। উনি সাফ জানালেন, ‘না, দেওয়া যাবে না, আমার বই নিয়ে তুমি অন্য কাগজের কাজ করবে, এটা হয় না। তুমি আগে কী করবে, তা একবার করে খসড়া দেখাও তো!’ আমি তখন একেবারে অন্যরকম করে তিনটে ভাগ করে ছোট্ট একটা কমিকস স্ট্রিপ তৈরি করেছিলাম। তিন বক্সের ছবিতেই গল্প শেষ হয়ে যেত। পাতা জুড়ে জলরং। আর পাশে, উপর-নিচ করে তিনটে কমিকস স্ট্রিপ। উপরে ছোট্ট একটা লেখা। গল্পের ভূমিকার মতো। কমিকস স্ট্রিপের যে চলন, তাতে বাঁদিক থেকে ডানদিকে, উর্দুতে ডানদিক থেকে বাঁদিকে– কিন্তু এই ওপর-নিচ কমিকস, এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট হিসেবেই করেছিলাম।  তা প্রকাশিত এবং বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল ‘দ্য ইলাস্ট্রেডেট উইকলি অফ ইন্ডিয়া’য়।

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প নিয়ে কমিকস, ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’-তে

’৯০ সালের আশপাশে প্রীতীশদা টাইমস ছেড়ে দিলেন। গেলেন আম্বানিদের কাছে। ‘সানডে অবজার্ভার’-এর দায়িত্বে। সেখানে নতুন ফিল্ম সেকশন চালু করলেন পপুলার করার জন্য। প্রীতীশদা আমাকে দায়িত্ব দিলেন ফিল্মস্টারদের ছবি আঁকার জন্য। এবং ফুল পেজ ছবি! বোম্বের যে সমস্ত শিল্পী বন্ধু, তাঁরা দেখা হলেই বলত, ‘ভাই তোমার সঙ্গে তো কথা বলা যাবে না, তুমি তো ফুল পেজ আর্টিস্ট!’

এগজিবিশন কাকে বলে, দেখিয়ে দিয়েছেন প্রীতীশদা! কখনও জাহাজের মাথায় শো করছেন। জাহাজের ডেকে নানা বিখ্যাত লোকজন! মহিলারা ওয়াইন খাচ্ছেন, ক্যাভিয়া ভাসছে। ড্রেসকোড দিয়ে ছবির প্রদর্শনী,ভাবা যায়! প্রদর্শনী করেছেন স্টেশনেও। কোনও গরিবিয়ানাই ছিল না প্রীতীশদার মধ্যে। ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও এই উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন এই কারণেই।

ঋণ: দেবাশিস গুপ্ত ও সঞ্জীত চৌধুরী

বাঙালিদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। গণেশ পাইনের ওপর একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন অনেক পাতা জুড়ে এবং চেয়েছিলেন লেখার মধ্যে কোনও বিজ্ঞাপন যেন না ঢোকে। লোকে যেন গণেশ পাইনের সম্পর্কে লেখা থেকে এক মুহূর্তও না সরে যায়। ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’র ১৯৯০ সালের এপ্রিল-মে সংখ্যায় প্রকাশ পেয়েছিল সেই লেখা। তরুণ শিল্পীদের ভবিষ্যৎ কী, কী বাজারদর হতে চলেছে, সে ব্যাপারেও নিখুঁত অবজার্ভেশন ছিল প্রীতীশদার। তা নিয়ে পত্রিকার ২-৩ সংখ্যা জুড়ে গুরুত্ব দিয়ে বিস্তারিত কথাবার্তা। সেসময় ছবি ও ছবির বাজার নিয়ে সাংঘাতিক একটা কাজ!

শেষ কথাটুকু বলেই ফেলি, প্রীতীশদা মধ্যপন্থায় একেবারে বিশ্বাস করতেন না। বলতেন, আমি এই ‘লাভ’ (love) শব্দটাকে একেবারে পছন্দ করি না। আই লাইক ‘হেট’ অর ‘রেসপেক্ট’– এখন বুঝি, এটা বজায় রাখার জন্যই প্রীতীশদার এত পাগলামি! ‘এক্সট্রিমিস্ট’ যাকে বলে আর কী! ওঁর বিশ্বাস, পৃথিবী কালকেই শেষ হয়ে যাবে, যা করার আজকেই করতে হবে এবং তা হবে জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ।

…………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………