শুধু আঁকা ছবি নয়, মণ্ডপসজ্জায় রণেন আয়নের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়া ৭২’-এর মেলা উদ্বোধনে মণ্ডপ দেখে ইন্দিরা গান্ধী নিজে খোঁজ নিয়ে নেপথ্য কারিগর শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। শিল্প ও স্থাপত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সৃষ্টি করতেন বিশাল মাপের বাণিজ্যিক প্যাভিলিয়ন। রাশিয়া, ফ্রান্স, লন্ডনের ভারত উৎসবে তাঁর গড়া মণ্ডপ খ্যাতি পেয়েছে। কলকাতা-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বেশ কয়েকটি সংগ্রহশালাও গড়ে উঠেছে তাঁরই পরিকল্পনায়। কলকাতায় স্টেট ব্যাঙ্কের সংগ্রহশালা এবং রামমোহন সংগ্রহশালাও তাঁরই হাতে তৈরি।
মনে আছে, ১৯৭০ সালে আমি শ্রীরামপুরের গোস্বামী বাড়িতে পড়তে যেতাম নিখিলেশ গোস্বামীর কাছে। যে ঘরে পড়তাম, তার বিস্তৃত সাদা দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার টাঙানো থাকত । ‘গ্যাঞ্জেস প্রিন্টিং ওয়ার্ক্স’-এর। ছ’টি পাতায় ভারতের ছ’টি যুদ্ধের রঙিন ছবি। প্রত্যেকটা আলাদা স্টাইলে আঁকা। কুরুক্ষেত্র, পানিপথ, হলদিঘাট, পলাশি– এই চারটে ছবির কথা মনে আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ছবিতে ছিল কৌরবদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণার্জুনের লড়াই। ছবির কেন্দ্রে ছিল অর্জুনের রথের দু’টি ঘোড়া। ডানদিক থেকে লড়াই করছেন অর্জুন। বাঁ-দিকে বিরুদ্ধাচারী সেনাবাহিনী। মাঝখানের ফাঁকা স্পেসে লাল হলুদের আগুনরঙা মাঠ আর আকাশ। চকিত ক্ষিপ্র-লাইনে রথ, ঘোড়া আর সেনাদের উপস্থিতিতে ছবিতে ধরা পড়েছিল যুদ্ধের গতিময়তা। যতবার ছবিটা দেখতাম, প্রথমেই ওই আগুনের ভয়াবহতায় যুদ্ধের ভয়ংকর রূপটা মনের সামনে চলে আসত। তুলনায় পানিপথের যুদ্ধের ছবিতে বাবর আর ইব্রাহিম লোধিকে বেশ নিঁখুত করে তুলে ধরেছিলেন শিল্পী। মুঘল মিনিয়েচারের ডিটেলসকে অন্য ধারায়, অন্য ফর্মেও কীভাবে নিয়ে আসা যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল সেই ছবিটি। ছবিগুলোর ধারে সই ছিল ‘রণেন’। ৫০ বছর পরেও ছবিগুলো চোখের সামনে ভাসে। বলিষ্ঠ টানে যুদ্ধের ভয়ংকর আবহাওয়াটা ধরে দিয়েছিলেন ছবিতে। ভয়ংকর সুন্দর!
সেই ভালো লাগাটা এখনও মনের মধ্যে চেপে বসে আছে।
তারপর থেকেই যেখানে তাঁর ছবি দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি। সেই ১৯৮০-’৯০ এর দশকে বোরোলিন, শালিমার নারকেল তেল, জবাকুসুম তেলের বিজ্ঞাপনে তাঁর ইলাস্ট্রেশন কেটে জমিয়ে রাখতাম। দশমহাবিদ্যা, দুর্গার দশ অস্ত্রের কাহিনি, কালিদাসের লেখার ছবি, অসাধারণ মুনশিয়ানা ফুটিয়ে তুলতেন। সাদা-কালোয় রামধনু সৃষ্টি করতেন।
যেকোনও ছবিতেই, যা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল– ছবির ছন্দ। রণেন আয়নের রেখার ছন্দ দর্শককে আনন্দ দেয়। দুই বা ততোধিক রেখার সংযোগ, কাটাকুটি বা পরস্পরের প্রতিসাম্য তাঁর ছবিকে সৌন্দর্য দান করে। ছবির মধ্যে রেখার নানা ভঙ্গীর গতি তাঁর ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য। চিত্রে রেখার গতি এবং একইসঙ্গে সংযত ভঙ্গী ছবির প্রাণশক্তি হয়ে ওঠে। তাঁর ছবি মানেই মাধুর্য, রেখার স্বচ্ছন্দ গতি। ছবির বিষয়ের রস অনুযায়ী রেখার ব্যবহার। রেখার মাধ্যমেই ফুটিয়েছেন ছবির বক্তব্য। মুখাবয়ব বা চোখ ছাড়াও ছবির চরিত্রের অঙ্গের ব্যবহারেও তিনি ছবিতে কথা ফোটাতেন। চেহারা পরিস্ফুটনের জন্য ব্যবহার করা রেখার প্রতিধ্বনি এবং সামঞ্জস্য ছবিগুলিকে রসময় করে তুলতেন। ছবির বিভিন্ন অংশের মধ্যে একটা চমৎকার ঐক্যসাধন ছিল তাঁর আর এক বৈশিষ্ট্য।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
শিল্পী রণেন আয়ন কাজ দেখার কোনও উপায়ই রাখেনি কলকাতা শহর! তাঁর কাজের প্রদর্শনী হয়েছে গুটি কয়েক মাত্র। সেই পাঁচের দশকে প্রথম, তারপর বড় মাপের প্রদর্শনী ২০১৫-তে গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন গ্যালারিতে। মোট ৮২টি নানা ধরনের ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের প্রদর্শনী। তার মধ্যে ছিল জলরং, তেলরং, স্কেচ, কাগজের বিজ্ঞাপন, বইয়ের প্রচ্ছদ, ফিল্মের পোস্টার। এবং বেশ কিছু ফোটোগ্রাফও সেই প্রদর্শনীতে দেখা গিয়েছিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বিজ্ঞাপন জগতে রণেন আয়ন দত্তের ভারতজোড়া নাম। তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল ‘উইলস’- এর বিজ্ঞাপনের সেই মনোমুগ্ধকর ‘ক্যাচ লাইন’– ‘মেড ফর ইচ আদার’। আটের দশকে শালিমার নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনে পুরাণ, মহাকাব্য থেকে গল্প তুলে এনে, তাকে রেখায় সাজিয়ে পাঠক-দর্শকের সামনে তুলে এনে, তিনি বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। এই সময়ের মতো নেটস্যাভি নয়, তাঁর কল্পনা আর হাতের কারিকুরিতেই শ্রেষ্ঠ আসনে নিজেকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন।
শুধু আঁকা ছবি নয়, মণ্ডপসজ্জায় রণেন আয়নের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়া ৭২’-এর মেলা উদ্বোধনে মণ্ডপ দেখে ইন্দিরা গান্ধী নিজে খোঁজ নিয়ে নেপথ্য কারিগর শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। শিল্প ও স্থাপত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সৃষ্টি করতেন বিশাল মাপের বাণিজ্যিক প্যাভিলিয়ন। রাশিয়া, ফ্রান্স, লন্ডনের ভারত উৎসবে তাঁর গড়া মণ্ডপ খ্যাতি পেয়েছে। কলকাতা-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বেশ কয়েকটি সংগ্রহশালাও গড়ে উঠেছে তাঁরই পরিকল্পনায়। কলকাতায় স্টেট ব্যাঙ্কের সংগ্রহশালা এবং রামমোহন সংগ্রহশালাও তাঁরই হাতে তৈরি।
বাংলা ফিল্মের পোস্টার বা পুস্তিকা এঁকেও একদা সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘হারানো সুর’-এর মতো ছবির পোস্টার, টাইটেল তাঁরই হাতে তৈরি। জ্যামিতিক আকারে বোল্ড ও সাজেস্টিভ ভাবনায় ‘কাবুলিওয়ালা’ বা ‘ছুটি’ ছবির লেখাঙ্কনে ডানা ঝাপটানো পাখির অবয়ব বাংলা ছবির পোস্টার শিল্পে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল।
কিন্তু শিল্পী রণেন আয়ন কাজ দেখার কোনও উপায়ই রাখেনি কলকাতা শহর! তাঁর কাজের প্রদর্শনী হয়েছে গুটি কয়েক মাত্র। সেই পাঁচের দশকে প্রথম, তারপর বড় মাপের প্রদর্শনী ২০১৫-তে গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন গ্যালারিতে। মোট ৮২টি নানা ধরনের ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের প্রদর্শনী। তার মধ্যে ছিল জলরং, তেলরং, স্কেচ, কাগজের বিজ্ঞাপন, বইয়ের প্রচ্ছদ, ফিল্মের পোস্টার। এবং বেশ কিছু ফোটোগ্রাফও সেই প্রদর্শনীতে দেখা গিয়েছিল।
‘সুন্দরম’ আর ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার শিল্পনির্দেশক হিসেবে রণেন আয়ন দত্তর কাজ অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে। আনোয়ারুল হক, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অতুল বসু, জয়নুল আবেদিনের প্রিয় ছাত্র জন্মেছিলেন ১৯২৭-এ, শ্রীহট্টে। বাবা রজনীমোহন ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, মা প্রিয়বালা। ১৯৪২-এ সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন প্রথম শ্রেণিতে।
আর কয়েক বছর পর শতবর্ষে পদার্পণ করতেন শিল্পী। কিন্তু এই রবিবার, ৩ মার্চ চলে গেলেন শিল্পী রণেন আয়ন দত্ত। প্রায় নব্বই বছর পর্যন্ত ছবি এঁকে গেছেন। শেষ দিন পর্যন্ত তার বাসনা ছিল, একটি ছাদের নিচে তাঁর শিল্পকর্মের নিদর্শন সাজিয়ে রাখা।
আমরা পারি না, তাঁর শেষ ইচ্ছেটুকুকে মর্যাদা দিতে? সঙ্গে তাঁর যাবতীয় লেখা আর আঁকা ছবির একটা সুদৃশ্য সংকলন প্রকাশ করতে?