‘বহুরূপী’ নাট্যপত্রের প্রথম সংখ্যায় পত্রিকার প্রকাশকাল, সূচিপত্র, সম্পাদকের নাম, প্রচ্ছদশিল্পীর নাম, প্রকাশস্থান, প্রকাশক, নিয়মাবলি– এমনকী, প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার সংগ্রহ মূল্যেরও কোনও উল্লেখ ছিল না। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘বহুরূপী’ প্রবন্ধের একেবারে সমাপ্তি অংশে প্রকাশের তারিখ ছিল ‘১লা মে, ১৯৫৫’। একমাত্র এই তারিখ থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন পত্রিকার প্রকাশকাল।
১৯৪৮ সাল। এ-বছরের মাঝামাঝি পার্ক সার্কাসের এক ঘরে, শম্ভু মিত্রকে কেন্দ্র করে কয়েকজন জড়ো হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে গণনাট্য সংঘের ভূতপূর্ব কিছু সভ্য, আর সকলেই ছিলেন নতুনের দলে। এই বছরের সেপ্টেম্বরে– ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় ‘নবান্ন’র পুনরাভিনয় হল। তখন ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের ‘নবান্ন’ অভিনয়ে জন্য পুলিশের অনুমতি হেতু একটি আমন্ত্রণ পত্রর দরকার পড়ে। সেখানে দলের নাম ছাপা হয়: ‘অশোক মজুমদার সম্প্রদায়’।
১৯৫০ সালের মে মাস থেকে এই ‘অশোক মজুমদার সম্প্রদায়’ বদলে গেল ‘বহুরূপী’ নাট্যদল নামে। অশোক মজুমদারই ছিলেন ‘বহুরূপী’র প্রথম সম্পাদক। শিশু জন্মানোর ঠিক পরে যেমন নামকরণ হয়ে থাকে, ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল একই ঘটনা। নামকরণ করেছিলেন মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি শুধু ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের নামকরণ করেননি, দলের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন, ‘দেখো, তোমাদের কথা জানবার একটা আগ্রহ লোকের হয়েছে, কিন্তু জানবে কী করে? এই জন্যেই কাগজ একখানা থাকা খুব প্রয়োজন।’
কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। একে থিয়েটার, রিহার্সাল, নানা কর্মকাণ্ড। তার ওপর আবার সময় বের করে একটা কাগজ করা! ১৯৫৪ সালের ১০ মে ‘বহুরূপী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’র অভিনয় করল। এই নাট্যাভিনয়ের পর পরই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকে। তখনই তাঁদের মনে হয়েছিল, নিজেদের কিছু বলার প্রয়োজন রয়েছে। এর কিছুকাল পরেই ‘বহুরূপী’ নাট্যপত্রের প্রকাশ। যদিও ‘বহুরূপী’ নাট্যপত্রের প্রথম সংখ্যায় পত্রিকার প্রকাশকাল, সূচিপত্র, সম্পাদকের নাম, প্রচ্ছদশিল্পীর নাম, প্রকাশস্থান, প্রকাশক, নিয়মাবলি– এমনকী, প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার সংগ্রহ মূল্যেরও কোনও উল্লেখ ছিল না। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘বহুরূপী’ প্রবন্ধের একেবারে সমাপ্তি অংশে প্রকাশের তারিখ ছিল ‘১লা মে, ১৯৫৫’। একমাত্র এই তারিখ থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন পত্রিকার প্রকাশকাল। এক বছর পরে, দ্বিতীয় সংখ্যায় পত্রিকা সম্পর্কে গঙ্গাপদ বসু জানিয়েছিলেন ‘দৈনিক নয়, সাপ্তাহিক নয়, মাসিক নয়– আমাদের পত্রিকা নিতান্তই আকস্মিক। দরদীর কাছ থেকে উৎসাহ পেলে নিয়মিত ভাবে পত্রিকা প্রকাশের কল্পনা তো রয়েছেই– কেননা আমরা বিশ্বাস করি দরদীদের আগ্রহ এবং উৎসাহই যে-কোনো শিল্প সংস্থার অগ্রগতির পথের পাথেয়।’ পরে অবশ্য ষাণ্মাসিক ক্রমেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়ে চলেছে। ‘বহুরূপী’-র ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারাভূষণ মুখোপাধ্যায় এগিয়ে এসেছিলেন পত্রিকা প্রকাশনার দায় বহন করতে। প্রথমে ‘নাভানা’ প্রেসে ছাপা হয়েছিল। ‘নাভানা’র শ্রীবিরাম মুখোপাধ্যায় ছাপানোর ব্যাপারে সহায়তা করেছিলেন।
প্রথম তিনটি সংখ্যায় কোনও সম্পাদক ছিলেন না। বলা উচিত, থাকলেও ছিলেন নেপথ্য়ে, নামবিহীনভাবে। চতুর্থ সংখ্যা থেকে সম্পাদক হলেন গঙ্গাপদ বসু। পরবর্তীকালে সম্পাদনার দায়িত্বে শম্ভু মিত্র, চিত্তরঞ্জন ঘোষ, কুমার রায়, প্রভাতকুমার দাস। ‘বহুরূপী’ নাট্য পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক অংশুমান ভৌমিক। প্রায় ৭০ বছরের কাছাকাছি একটি নাট্যপত্রের প্রকাশ বিস্ময়ের বইকি!
‘বহুরূপী’ পত্রিকার প্রথম থেকে এগারো সংখ্যা পর্যন্ত কোনও প্রচ্ছদশিল্পীর নাম উল্লেখ নেই। বারো নম্বর সংখ্যায় প্রথম প্রচ্ছদকারের নাম উল্লেখ করা হয়। তিনি হলেন সূর্য রায়। পরবর্তীকালে প্রচ্ছদ এঁকেছেন খালেদ চৌধুরী, দেবতোষ ঘোষ, কুমার রায়, অনিমেষ চৌধুরী, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, ইন্দ্রপ্রমিত রায়, হিরণ মিত্র, দেবব্রত ঘোষ, রাহী দে রায়, পার্থপ্রতিম দেব। পত্রিকার অলংকরণ করেছেন খালেদ চৌধুরী, কুমার রায়। পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে ছিলেন বিমল গুপ্ত, কালীপ্রসাদ ঘোষ, তারাপদ মুখার্জি, সুশান্ত দাস এবং প্রবাল মুখোপাধ্যায় । ‘বহুরূপী’ পত্রিকার বিজ্ঞাপন প্রথম দিকে সংগ্রহ করতেন শান্তি দাস। পরবর্তীকালে রমেন স্যানাল, সৌমিত্র বসু, আভেরী দত্ত, সুমিতা বসু বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজ করতেন– এঁরা প্রত্যেকেই তখন ‘বহুরূপী’র সক্রিয় সদস্য। পত্রিকার প্রুফ দেখতেন নমিতা মজুমদার, সুকৃতি লহরীরা। এছাড়া সাহায্য করতেন দেবতোষ ঘোষ, শান্তি দাস, সাজেদা আসাদ, কেয়া চক্রবর্তী, বাসবী রায়, স্বপন মজুমদার, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ও সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ।
বহুরূপী নাট্যপত্র সম্পাদনাকালে সম্পাদক গঙ্গাপদ বসু ‘ঘরোয়া’ নামে একটি বিভাগ শুরু করেছিলেন। ‘ঘরোয়া’ বিভাগটিই ছিল পত্রিকার সম্পাদকীয়। এই ‘ঘরোয়া’ বিভাগটি বহুরূপী নাট্যদলের সদস্যরা লিখতেন। পত্রিকাটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘এ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগটা আমাদের– বাংলা দেশে প্রথম থিয়েটার প্রসঙ্গে সত্যকার কিছু বলবার এবং শোনবার প্রচেষ্টায়। কিন্তু এ পত্রিকা শুধু বহুরূপীর মতামত প্রকাশের জন্যই নয়– যাঁরাই এ সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন এবং সমাধানের সঙ্কল্প নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাঁদের সকলের মতামতের স্বাতন্ত্র্যকেই আমরা মর্যাদা দিতে চাই।’ গঙ্গাপদ বসুর সময়ে ‘বহুরূপী’ নাট্যপত্র দলীয় মুখপত্রের পর্যায়ে পৌঁছলেও সম্পাদক চিত্তরঞ্জন ঘোষ পত্রিকাটিকে দল থেকে মুক্ত করে গবেষণার স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। কোনও সময়েই ‘বহুরূপী’ নাট্যপত্রে ভিন্ন নাট্যদলের নাট্য সমালোচনা প্রকাশিত হয়নি। ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় থিয়েটারে ব্যবহৃত শব্দের পরিভাষা নির্মাণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। সমকালীন নাট্য সংস্কৃতির কথা উঠে এসেছে। বহুরূপী নাট্য পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই রবীন্দ্রপ্রসঙ্গের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। ৬৫ নম্বর সংখায় (মে ১৯৮৬) ‘রক্তকরবী’ নাটকের চতুর্থ খসড়া প্রকাশ করা হয় যা বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র ভবনের সংগ্রহে ছিল না। রবীন্দ্র পাঠকের দৃষ্টিতে প্রথম বহুরূপী নাট্যপত্রিকা নিয়ে আসে ‘রক্তকরবী’ নাটকের খসড়া। তারপর ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৬ ‘রবীন্দ্রবীক্ষা’র ১৬ নম্বর সংখ্যায় ‘রক্তকরবী’ নাটকের প্রথম খসড়া প্রকাশ হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত চতুর্থ খসড়াটি এই কারণে আরও গুরুত্বপূর্ণ যে নাটককার রবীন্দ্রনাথ প্রথম নিজ হস্তাক্ষরে ‘নন্দিনী’ শিরোনাম লিখেছিলেন। লিখিত হস্তাক্ষরের খাতার ছবিটিও পত্রিকায় মুদ্রিত হওয়ায় আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
বহুরূপীর লেখকেরা হলেন শম্ভু মিত্র, অমর গাঙ্গুলী, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, তাপস সেন গঙ্গাপদ বসু, কুমার রায়, তৃপ্তি মিত্র, কিরণময় রাহা, অমরনাথ পাঠক, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌস্তভ মুখোপাধ্যায়, বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, নভেন্দু সেন, ধ্রুব গুপ্ত, অতনু সর্বাধিকারী, সবিতাব্রত দত্ত, সুশান্ত বসু, রঞ্জিত মুখোপাধায়, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, অশোক সেন, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শ্যামল সেনগুপ্ত, লোকনাথ ভট্টাচার্য, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শাঁওলী মিত্র, অরবিন্দ গুহ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, প্রশান্ত দেব, হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় বৈরাগী, বিভাস চক্রবর্তী, সৌমিত্র বসু, চন্দন সেন, দেবাশিস মজুমদার, শিশির কুমার দাস, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, তীর্থঙ্কর চন্দ, কৃষ্ণ ধর, রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী, অমিত মৈত্র, অমিতাভ রায়, অসীম চট্টরাজ, উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী, প্রবালকুমার বসু, সুমন মুখোপাধ্যায়, গৌতম হালদার, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, ভবেশ দাশ, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, অরূপশঙ্কর মৈত্র, দেবশঙ্কর হালদার, প্রমুখ। এই তালিকা শেষ করা যায় না। শম্ভু মিত্র একই সংখ্যায় ছদ্মনামে এবং স্বনামে লিখতেন। গঙ্গাপদ বসু লেখক তৈরি করেছেন, কখনও দলের সদস্যদের দিয়ে লিখিয়েছেন আবার কোনও লেখককে জোর করেছেন। এ বিষয়ে তৃপ্তি মিত্র লিখেছেন–
‘‘অনেকদিন পর উনিশ’শ ষাটের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন ‘বহুরূপী’ পত্রিকার সম্পাদক স্বর্গীয় গঙ্গাপদ বসু পত্রিকার জন্যে একটা লেখা চাইলেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! আমি লিখব! কিছু কথার পর বললেন, পারবে পারবে একটু চেষ্টা কর না।’ শ্রদ্ধেয় গঙ্গাদার কথা ঠেলতেও পারি না। শম্ভু মিত্রও খুব উৎসাহ দিলেন। সত্য মিথ্যে মিলিয়ে এই গল্পটা প্রায়ই মনের মধ্যে পাক খাচ্ছিল। লিখলাম নাটক। শম্ভু মিত্রই নাম দিলেন ‘বলি’। বহুরূপী পত্রিকার উনিশ’শ ষাট সালের নভেম্বর মাসে শিবতোষ ভাদুড়ী ছদ্মনামে প্রথম প্রকাশিত হল।’’
‘বহুরূপী’তেই বাদল সরকারের প্রথম নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ প্রকাশিত হয়েছে। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাবন্ধিক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ ‘বহুরূপী’ নাট্যপত্রেই। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ই ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি প্রকাশের জন্য ‘বহুরূপী’তে পাঠিয়েছিলেন দেবতোষ ঘোষের মাধ্যমে।
‘বহুরূপী’ বলতে যে বিশেষ সংখ্যাগুলি বারবার মনে এসে যায়– ‘নবান্ন-স্মারক-সংখ্যা’, ‘ভারত নাট্য সংখ্যা’, ‘পুরাতন থিয়েটার সংখ্যা’, ‘শিশিরকুমার সংখ্যা’, ‘মহর্ষি সংখ্যা’ এবং ‘বিশেষ ক্রোড়পত্র: কেয়া চক্রবর্তী’, ‘স্মরণ: বিজন ভট্টাচার্য ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র’, ‘বিশেষ ক্রোড়পত্র: মৃচ্ছকটিক’, ‘বাংলাদেশ-থিয়েটার সংখ্যা’ ইত্যাদি।
‘বহুরূপী’ নাট্যপত্রকে মডেল হিসেবে অনেকেই বেছে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে ‘গন্ধর্ব’ এবং ‘নাট্যপত্র ঘরে বাইরে’। যদিও পত্রিকা দু’টি একেবারেই ‘বহুরূপী’র থেকে স্বতন্ত্র। ‘বহুরূপী’তে বহু তরুণ নাটককার এবং প্রাবন্ধিকের প্রকাশ ঘটেছে। বাংলা নাটক সাহিত্যের ধারাটিকে বহন করে নিয়ে চলেছে ‘বহুরূপী’ নাট্যপত্র।