উনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এই যে তুমি এখানে এসেছ, তোমাকে আর বেঙ্গলে ফিরে যেতে হবে না। এখানেই থাকবে তুমি।’ এবং পরে সেটাই সত্যি হয়। তারপরে নানা অনুষ্ঠানে ওঁর সঙ্গে দেখা হত। ওঁর পরিচালনায় একটা ছবিতে আমি অভিনয় করেছিলাম– ‘আনন্দ অউর আনন্দ’-এ। মাইসোর থেকে কিছুটা দূরে ‘কুর্গ’ বলে একটা জায়গায় আউটডোরে গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিনের জন্য আমরা একসঙ্গে, ছিলামও একসঙ্গে।
দেব আনন্দ-এর সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয়। যখন আমি বম্বেতে আসি, সেই সময় থেকেই। ফিরে তাকালে অনেক কিছুই মনে পড়ে। আমার প্রথম হিন্দি ছবি ছিল ‘বিশ সাল বাদ’, সেটা ১৯৬২ সাল। সেই স্ট্রাগলের দিনগুলো থেকেই ওঁর সঙ্গে আলাপ। বলিউডে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই যেমন মনে পড়ে, তেমনই মনে রয়ে গিয়েছে অনেক সুন্দর স্মৃতি। প্রথমদিন থেকেই উনি আমার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। আমাকে ভাল লেগেছিল ওঁর। উনি প্রেডিক্ট করে বলেছিলেন, ‘এই যে তুমি এখানে এসেছ, তোমাকে আর বেঙ্গলে ফিরে যেতে হবে না। এখানেই থাকবে তুমি।’ এবং পরে সেটাই সত্যি হয়। তারপরে নানা অনুষ্ঠানে ওঁর সঙ্গে দেখা হত। ওঁর পরিচালনায় একটা ছবিতে আমি অভিনয় করেছিলাম– ‘আনন্দ অউর আনন্দ’-এ। মাইসোর থেকে কিছুটা দূরে ‘কুর্গ’ বলে একটা জায়গায় আউটডোরে গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিনের জন্য আমরা একসঙ্গে, ছিলামও একসঙ্গে। সেখানকার খুব সুন্দর সুন্দর লোকেশনে শুটিং হয়েছিল। প্রায় চোদ্দোদিন ওখানে ছিলাম। খুব কাছাকাছি ওই ক’টাদিন কাটিয়েছিলাম, আজও মনে পড়ে। সেখানে ওঁর ছেলে সুনীল আনন্দ ছিলেন, যাঁকে উনি লঞ্চ করেছিলেন। ওঁর মেয়ে দেবিনাও কিছুদিনের জন্য শুটিংয়ে এসেছিলেন কুর্গে। অত্যন্ত অ্যাকটিভ মানুষ ছিলেন। ওঁর কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি। পাংচুয়ালিটি, কমিটমেন্ট ওঁর বিশেষত্ব ছিল। কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয়, উনি জানতেন নিখুঁতভাবে। পার্টিতেও দেখেছি, অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড। ঠিক রাত দশটার পরে পার্টি ছেড়ে চলে যেতেন। সহবত কাকে বলে, ওঁর থেকে শিখতে হয়। কাজের প্রতি ওঁর ডেডিকেশন শিক্ষণীয়। ওয়েল বিহেভড, ওয়েল ম্যানার্ড, সবকিছুতে পারফেক্ট ছিলেন।
মজার বিষয় হল, আমাকে সম্বোধন করতেন, ‘বিশ্বজিৎ তু’ বলে। বলতেন, ‘আজা তু ইধার মেরে অফিস মে।’ একেবারে কাছের লোকের মতো টেনে নিতেন। আমি ‘দেব ভাই’ বলে ডাকতাম। সবাই যদিও ‘দেব সাব’ বলত। কিন্তু আমি ‘দেব ভাই’-ই ডাকতাম। শুটিংয়ে কোনও দিন পরিচালক দেব আনন্দের কাছে বকা খাইনি। এত সুন্দর ব্যবহার ছিল ওঁর। একবার মনে আছে, উনি হঠাৎ আমার ডেট চেয়ে বসলেন। ওদিকে আরেক বিখ্যাত বাঙালি পরিচালক তরুণ মজুমদারকেও ডেট দেওয়া তখনই। আমি আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলাম সেই ছবিতে। ‘অমর গীতি’ ছিল সেই ছবির নাম। আর তনুবাবু ডেটের ব্যাপারে ভীষণ পার্টিকুলার, একটা ডেট-ও কাউকে ছাড়তেন না। যে শিডিউল থাকত, তার থেকে বেরতেন না কোনওভাবে। তখন আমার করুণ অবস্থা। দেব ভাইকেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না! বলেই ফেললাম শেষে যে, ‘তরুণ মজুমদার আমার ডেট নিয়েছেন। আমার মনে হয় হি অলসো রিগার্ডস ইউ। আপনি যদি একবার কল করেন তনুবাবুকে।’ দেব ভাই বললেন, ‘আচ্ছা, ম্যায় কল কর লেতা হুঁ তরুণ মজুমদার কো। লেকিন তেরা ডেট চাহিয়ে।’ এবার তনুবাবুকে দেব ভাই কল করলেন। বম্বে ইন্ডাস্ট্রির পিলার ছিলেন দেব আনন্দ। উনি চিনতেন তরুণ মজুমদারকে, আলাপ ছিল ওঁর সঙ্গে। তারপর তনুবাবু আমাকে জানালেন, ‘বিশ্বজিৎবাবু, এটা দেব সাহেবের ব্যাপার, এখানে আমি কিচ্ছু বলতে পারলাম না। আমি ডেট অ্যাডজাস্ট করব। আপনি ওই ডেট ওঁকে দিয়ে দিন।’ দু’জনেই দারুণ ভাল ছিলেন। কাজের ব্যাপারে পাংচুয়াল, আর শিডিউল মেনে চলতেন। আজও মনে পড়ে তরুণ মজুমদার দেব ভাইয়ের এই অনুরোধ রেখেছিলেন।
দেব ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হত মুম্বইয়ে। ওঁর অফিসে ডেকে নিতেন। কোনও না কোনও ফাংশনেও যোগাযোগ হত। যখন ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার পেলেন, আমাকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। তাছাড়া ওঁর অটোবায়োগ্রাফি যখন লঞ্চ হয়, আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। শেষবার মনে আছে, আমার বাড়ির পাশে যে পুজো হয়, ওখানে আসতে চেয়েছিলেন। কারও কাছে শুনেছিলেন যে, বিশ্বজিৎ এখানে পুজো করে। বলেছিলেন সে কথা। সচরাচর উনি কোনও ইভেন্টে যেতেন না। কিন্তু আমার বাড়ির পাশে মায়ের পুজোয় আসার ইচ্ছে ছিল ওঁর। কিন্তু সেই বছর বোধহয় ‘লাভ অ্যাট টাইমস স্কোয়ার’ বলে একটা ছবি করেন। যে কারণে ফরেন চলে যেতে হয়। সেই বছর আসতে পারেননি ইউএস-এ যাওয়ার কারণে। দুর্গাপুজোয় আসার ইচ্ছেটা ওঁর ছিল। পিভিআর সিনেমা-শপিং মলের পাশে বিশাল মাঠে ওই পুজোটা আমি করতাম আগে। সেটা দেব ভাই-এর বাড়ির থেকে হাঁটাপথ ছিল। উনি বলতেন, ‘দেখি খুব ভিড়ভাট্টা হয় পুজোয়। মা-কা দর্শন কে লিয়ে আউঙ্গা ম্যায়।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওঁর আসা হয় না।
আউটডোরে খেলা, ফিল্ম– সবকিছু নিয়ে আলোচনা হত। কথায় কথায় জেনেছিলাম উনি স্বামী বিবেকানন্দর বই পড়তেন। বাইরে থেকে ওর চেহারা-সাজ-পোশাক পুরোটাই ওয়েস্টার্ন হলেও, উনি অন্তরে আদ্যোপান্ত ভারতীয় ছিলেন। আমরা বলতাম– আপনাকে তো আমেরিকান অ্যাক্টর মনে হয়। উনি বলতেন, ‘আই অ্যাম বেসিক্যালি আ হিন্দু, আই অ্যাম অ্যান ইন্ডিয়ান। আমি ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করি।’ আউটডোরেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হ্যাভ ইউ রেড বিবেকানন্দ? বলতাম, ‘হ্যাঁ, আমি পড়েছি।’ দেব ভাই বলতেন, ‘ওঁকে আমি ফলো করি। বিবেকানন্দের কর্মযোগ যেটা, ওয়ার্ক ইজ ওয়ারশিপ, আমি ফলো করি। ওর বই পড়ে আমি জীবনে শক্তি পেয়েছি। ব্যর্থতা বা সাফল্য আমার জীবনে প্রভাব ফেলেনি। যার একমাত্র কারণ, স্বামীজি।’ এটা অনেকে জানে না। কিন্তু আমি ওঁকে এত কাছ থেকে দেখেছি, তাই বলতে পারছি।
আমি খুশি যে, দেব ভাই-এর জন্ম শতবর্ষে পিভিআর এবং আইনক্স সারা ভারতের বড় বড় শহরে দেব আনন্দের ছবি দেখাচ্ছে। এত ভাল মানুষ ছিলেন দেব ভাই, কী বলব!