কেদারনাথে পৌঁছে শুনলাম সেদিন সকালে, বিপর্যয়ের তিন বছর পর কেদার মন্দিরের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে দু’টি মনুষ্য কঙ্কাল। হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের পিছন দিকে পৌঁছলাম। একটি বৃহদাকার পাথর। ভয়াবহ জলের স্রোত সেই পাথরে লেগে দু’ভাগে ভাগ হয়ে চলে যায় দু’পাশে। মন্দির বেঁচে যায়। কেদারতালের সেই পাথরের নামকরণ হয়েছে ‘ভীমশিলা’। তেলে, সিঁদুরে, মিষ্টিতে পুজিত হচ্ছেন তিনি। না, মানুষ কেউ বাঁচেনি সেই পাথরের কৃপায়। ঈশ্বরকে বাঁচিয়ে পাথর ঈশ্বর হয়েছেন।
২০১৩ সালে কেদারনাথের দুর্যোগ যখন ঘটছে, আমি তখন পাহাড়ে। লাভার একটা কটেজের বারন্দায় বসে দেখছি ভরদুপুরে ঘন মেঘের চাদরে ঢেকে অন্ধকার হয়ে আসছে উত্তরবঙ্গের ছোট্ট পাহাড়ি শহর। বাবা-মা ঘরে বিশ্রামরত। বাবার ফোনে কল আসে। আমার পিসি। পিসি জানত আমরা বেড়াতে এসেছি পাহাড়ে। কোথায় জানত না। ফলে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন। আমাদের কোনও ধারনা ছিল না উত্তরাখণ্ডে কী ঘটছে। পিসির কথায় টিভি চালালাম। দেখলাম কেদারে তাণ্ডব চালাচ্ছে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। দেশলাই বাক্সের মতো হোটেল, বাড়ি মুহূর্তে ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এদিকে লাভার আকাশে আরও অন্ধকার করে ঘনিয়ে আসছে মেঘ। আর প্রকৃতির মুহূর্ত-খেয়ালে তছনছ হয়ে যাচ্ছে উত্তরাখণ্ড। সবক’টা নিউজ চ্যানেলে একটি দৃশ্য ঘুরে ঘুরে আসছে। হৃষীকেশের সুবৃহৎ শিবমূর্তি। ধ্যানস্থ মহাদেবের চারপাশ দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে ফুঁসছে গঙ্গা। মনুষ্য সভ্যতার সমস্ত গর্ব ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। মধ্যে নিথর, মগ্ন বসে আছেন নটরাজ।
আমাদের আর তিনদিন পর ফেরা। ভালোয় ভালোয় পাহাড় থেকে নামতে পারলে বাঁচি। এইসব ভেবে থম মেরে বসে রইলাম ঘরে। ঝমঝম করে বৃষ্টি হল সারা দুপুর। মনে করার চেষ্টা করছিলাম বৃষ্টির শব্দে এমন ভয় লেগেছিল শেষ কবে। কিন্তু নিশ্চিন্তও লাগছিল একরকম। ভাগ্যিস উত্তরাখণ্ড যাইনি। ভাগ্যিস।
নিশ্চিন্ত মনে প্রথম আঘাত লাগল শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে। ভোরবেলা স্টেশন চত্বরে থাকলে খবরের কাগজ কিনে চোখ বুলিয়ে নেওয়া আমার পুরনো অভ্যেস। চারের পাতায় আটকালাম। আমার বন্ধু অর্পণ (নাম পরিবর্তিত), তার মা, বাবা এবং বোন। ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। কেদারে বেড়াতে গিয়ে পুরো পরিবার নিখোঁজ। টিভিতে দেখেছিলাম জলের একেকটা ঢেউ-এ ভেসে যাচ্ছে গোটা গোটা বাড়ি। চারটে মানুষ আর এমনকী! অর্পণ আমার স্কুলমেট নয়। কোচিং ক্লাসের বন্ধু। বিজ্ঞানে দুর্দান্ত ছিল। তুড়ি মেরে জয়েন্ট ক্র্যাক করার কথা বলত। আমি দুর্বল ছাত্র, হিংসে করতাম। মনে হত, বাবা! ফিজিক্সে ভালো বলে কী ঔদ্ধত্য। করেও ছিল জয়েন্ট ক্র্যাক তুড়ি মেরে। দারুণ চাকরি পেত। ভেসে গেল। একদিক থেকে ভালো, কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্ধকার তালা বন্ধ বাড়িটা ছাড়া বাড়িতে আর অপেক্ষা করার কেউ নেই। এদিকে ধ্যানমগ্ন বাড়ি, এদিকে ধ্যানমগ্ন মহাদেব।
কয়েক মাস পর বাবার এক পুরনো কলিগ বেড়াতে এলেন বাড়িতে। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। কথায় কথায় জানা গেল বিপর্যয়ের সময় তারাও পুরো পরিবার কেদারে ছিলেন। পরিবার বলতে ওরা দু’জন, ওদের কিশোরী কন্যা এবং ভদ্রলোকের বৃদ্ধা মা, চারজন। ইন্ডিয়ান আর্মি চারজনকেই উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু একসঙ্গে নয়। টানা দশদিন ভদ্রলোক ছিলেন একটি ক্যাম্পে। ভদ্রলোকের স্ত্রী এবং কন্যা ছিলেন একটি ক্যাম্পে, মা ছিলেন তৃতীয় একটি ক্যাম্পে। বিস্কুট ছাড়া খাদ্য বলতে কিছুই ছিল না প্রথম কয়েকদিন এবং সে ভাণ্ডারও সীমিত। ভদ্রলোকের কাছে নগদ টাকা ছিল হাজার দশেক। এক যুবকের কাছে পাঁচ হাজার টাকার পরিবর্তে একটি দশ টাকার বিস্কুটের প্যাকেট চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন তিনি। দশদিন পরিবারের কেউ জানত না তার পরিবারের বাকিরা বেঁচে আছে কি না। ক্যাম্পের বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশু এবং মহিলাদের পর সবশেষে হেলিকপ্টারে জায়গা পান ভদ্রলোক। দু’দিন পরে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিবারের বাকিদের সঙ্গে দেখা হয় তার, ভদ্রলোক বলছিলেন, বলছিলেন আর কাঁদছিলেন।
আমি ভাবছিলাম চারজন ফেরেনি। চারজন ফিরেছে। দিব্য ব্যালেন্স। মানুষ মরে, মানুষ বাঁচে। প্রকৃতির আশ্চর্য লীলা।
কাট টু | ২০১৫ | আমি উত্তরাখণ্ডে |
দেবপ্রয়াগের আকাশে তখন আধখানা চাঁদ। দেবপ্রয়াগের গলি, যারা গিয়েছেন তারা জানেন। পাহাড় থেকে পাহাড়ে প্যাঁচানো আশ্চর্য সব ভেজা স্যাঁতসেঁতে পথ, দু’চারটে দোকানের আলো-অন্ধকার রাস্তায় ফ্যাকাসে কয়েকটা ত্রিভুজ, ট্রপিজিয়ম, রম্বসের জন্ম দেয়। সেইসব গলি, দু’একটা বারান্দা এবং কয়েকটা নিঃস্পৃহ বাড়ির সিঁড়ি ডিঙিয়ে অনেকটা নীচে নেমে গেলে মন্দির শুরু হয়। মন্দিরের শেষ মাথায় প্রয়াগ, অলকনন্দা আর ভাগীরথীর মিলনস্থল। একদম মিলনবিন্দুতে স্থলভাগের শেষ পাথরটিতে দাঁড়িয়ে পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে আরতি করেন এক পুরোহিত। বেনারস বা হরিদ্বারের মতো আরতি নয়, এই আরতি দেখতে কোনও লোক আসে না। গেলে দু’চারটি নকুলদানা পাওয়া যায়। এখান থেকেই গঙ্গা নাম হয়েছে নদীর। সেই মহাজন্মের উদ্দেশ্যে একটি মানুষ প্রদীপ দেখান, আরেকজন চামর দোলান। আধখানা চাঁদে আবছা জ্বলে থাকা আকাশে একটি ভীষণ প্রাচীন ঝুলন্ত সেতু সিলুয়েট হয়ে থাকে শুধু। গল্প শোনা যায় মেঘভাঙা বৃষ্টির সময় চল্লিশ ফুট উঁচু দিয়ে জল গিয়েছিল মন্দির ডুবিয়ে দিয়ে সেতু ছুঁয়ে ফেলেছিল প্রায়। মন্দিরের একটি দেওয়ালও খসে পড়েনি সে বন্যায়। ফিরতি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আশপাশে প্রায় ফুট ত্রিশ উচ্চতায় এখনও দেখতে পাবেন এককালের কাঠের বাড়ি, বারান্দা, সিঁড়ি, দেওয়াল চেপটে লেগে আছে পাহাড়ের গায়ে। অনেক পুরনো ক্ষতর শুকিয়ে যাওয়া খোলসের মতো। পাহাড়ের ক্ষত সারতে সময় লাগে বোধহয়। আমি যখন গেছিলাম বদ্রীনাথ-এর কয়েক কিলোমিটার আগে বাঁ দিকে হঠাৎ দেখা যেত পর্বতের গা ফাটিয়ে হাঁ করে রেখে চলে গ্যাছে কেদারতাল। এখন আর দেখা যায় কি না জানি না। ওই পর্বতেরই পিছন ঘুরে কোনও এককালে একা পুরোহিত হেঁটে যেতেন চারধাম। কেউ বলেন মিথ। কেউ বলেন সত্যি ।
তারপরের বছর ২০১৬। আমি কেদারনাথ যাই। মাত্র একবছর ব্যবধানে উত্তরাখণ্ডের অনেক জায়গার চেহারা বদলেছে। রাস্তাঘাট আবার নির্মাণ করা গিয়েছে অনেকটাই। আবার যত্রতত্র পাহাড় ফাটিয়ে হোটেলও নির্মাণ করা গিয়েছে যথেচ্ছ। কেদারনাথে পৌঁছে শুনলাম সেদিন সকালে, হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন, বিপর্যয়ের তিন বছর পর সেদিন সকালে কেদার মন্দিরের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে দু’টি মনুষ্য কঙ্কাল। হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের পিছন দিকে পৌঁছলাম। কেদারতাল এখন ধ্বংসাবশেষ মাত্র। পাথরের স্তূপ। তারই মধ্যে একটি বৃহদাকার পাথর। মেঘভাঙা বৃষ্টির সময় তাল থেকে ছিটকে বেরিয়ে মন্দির থেকে কয়েক হাত দূরে আটকে যায়। ভয়াবহ জলের স্রোত সেই পাথরে লেগে দু’ভাগে ভাগ হয়ে চলে যায় দু’পাশে। মন্দির বেঁচে যায় ধ্বংসের হাত থেকে। যেভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন হৃষীকেশের শিব কিংবা যেভাবে বেঁচে গিয়েছিল দেবপ্রয়াগের মন্দির। সেভাবে বেঁচে আছে কেদার মন্দির। কেদারতালের সেই পাথরের নামকরণ হয়েছে ‘ভীমশিলা’। তেলে, সিঁদুরে, মিষ্টিতে পুজিত হচ্ছেন তিনি। না, মানুষ কেউ বাঁচেনি সেই পাথরের কৃপায়। ঈশ্বরকে বাঁচিয়ে পাথর ঈশ্বর হয়েছেন। মানুষ মরে, দেবতার জন্ম হয়। প্রকৃতির আশ্চর্য লীলা।
২০২৩-এ হিমাচলের বন্যায় একটি ভিডিও ক্লিপ ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। মান্ডির পঞ্চবক্র মন্দিরের চারপাশ দিয়ে পাক খেয়ে বয়ে যাচ্ছে বন্যার জল। কিন্তু মন্দির অটুট। এই ভিডিও ক্লিপটিতে এক যুবকের হিন্দিতে ন্যারেশন শোনা যায়। তিনি বলছেন, দেখুন ঈশ্বরের লীলা। চারদিকে বন্যা, ধ্বংস, তাণ্ডব। কিন্তু মধ্যে নিথর, মগ্ন বসে আছেন নটরাজ।
দেবতা বেঁচে যায়, দেবতার নবজন্ম হয়। প্রকৃতির আশ্চর্য লীলা!