১৯২৩-এর এক গ্রীষ্মে রবীন্দ্রনাথের হাতে ফিরে এল তাঁরই লেখা একটি বার্তা, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে। লেফাফায় কারণ হিসেবে লেখা রয়েছে, ‘Addressee not found’. সেন্ট্রাল জেলে যাঁর কাছে এই চিঠি যাওয়ার কথা, তাঁকে অবশ্য তখন বহরমপুরের নাম করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হুগলি জেলে, সাধারণ কয়েদি হিসেবে। পথে নৈহাটি স্টেশনে কয়েদির পোশাকে, কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পরানো দশায় তাঁকে দেখে বিক্ষোভে উত্তাল হল জনসমুদ্র। যাঁকে খুঁজে-পেতে সুদূর শিলং থেকে পত্রযোগে ডাক দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি অবশ্য তখন হুগলি জেলে বসে সেই রবীন্দ্রনাথেরই গানের প্যারডি লিখছেন ‘সুপার বন্দনা: ভাঙার গান’ নামে–
তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে তুমি ধন্য ধন্য হে,
আমার এ গান তোমারই ধ্যান তুমি ধন্য ধন্য হে।
রেখেছ সান্ত্রি-পাহারা দোরে
আঁধার কক্ষে জামাই-আদরে
বেঁধেছ শিকল প্রণয়-ডোরে তুমি ধন্য ধন্য হে।
কী বার্তা পাঠাতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ? কে-ই বা ছিলেন জেলে? ঠিক কী ঘটেছিল ঠিক একশো বছর আগে?
উপনিবেশের প্রভুর বিরুদ্ধে লেখা শুধু একটি কবিতার জন্য কারাবরণ করেছেন এমন নজির আমাদের দেশে বিরল। আর বাংলায় এমন ঘটনা তো একমাত্র একজনের পক্ষেই ঘটানো সম্ভব, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। ঘটনার সূত্রপাত ১৯২০ সালের জুলাই মাস নাগাদ। করাচি থেকে ফিরে কলকাতায় থাকাকালীন মুজফফর আহমদের সঙ্গে মিলে নজরুল তখন সম্পাদনা করছেন সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকা। সেখানেই লিখছেন একের-পর-এক ‘আগুন জ্বালানো’ রাজনৈতিক লেখা। তবে কয়েক মাস পরেই তিনি ছেড়ে এলেন ‘নবযুগ’। কিন্তু তাঁর লেখা সম্পাদকীয়গুলি দু’-মলাটের মধ্যে সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হল ‘যুগবাণী’ নামে আর প্রকাশ হওয়ামাত্রই জারি হল নিষেধাজ্ঞা।
এই সময়েই ‘সপ্তাহে দুইবার করিয়া বাহির হইবে’ বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘ধূমকেতু’ প্রকাশ পায় ১১ আগস্ট, ১৯২২-এ। ‘আগমনী’ সংখ্যায় সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হল ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। শরতের সূচনায় দুর্দশাগ্রস্ত দেশ প্রস্তুত হচ্ছে মাতৃ-আবাহনে। এই ছিল কবিতার সোজাসাপটা বিষয়। কিন্তু এমন সরল ভাবনার মধ্যেই অপরূপ কৌশলে নানা মারাত্মক রেফারেন্স বুনে দিয়ে গেলেন নজরুল। কবিতাটি দীর্ঘ, তাই এখানে সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি ব্যবহার করা গেল না, তবে বিতর্কিত অংশগুলির কথা আলাদা করে উল্লেখ করে তার নিহিতার্থগুলো বললেই বোঝা যায়, এ কবিতার ছত্রে ছত্রে এত দ্রোহ কেন! কবিতার শুরুতেই কবির অভিপ্রায় কিছুটা স্পষ্ট:
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা– আসবি কখন সর্বনাশী?
কবিতায় অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতগুলির মধ্যে অত্যন্ত অর্থপূর্ণ বাক্যবন্ধ ছিল ‘বিষ্ণু নিজে বন্দী আজ’। এখানে ‘বিষ্ণু’ বলতে গান্ধিজিকে বোঝালেন নজরুল, আর তাঁর বন্দিত্ব প্রসঙ্গে গান্ধিজির কারাবাসের ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন। আবার ‘মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে’ বলার সঙ্গে সঙ্গে নজর কাড়বেই অরবিন্দর পন্ডিচেরিতে সমুদ্রতীরে বসবাসের প্রসঙ্গটি। নজরুল নিজের ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন অরবিন্দরই ভাই বারীন ঘোষকে। তাঁর নামোল্লেখ এই কবিতাতেও বাদ যায়নি– ‘বারি-ইন্দ্র-বরুণ আজি করুণ সুরে বংশী বাজায়’। বুড়িগঙ্গার পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা বিপ্লবী পুলিনবিহারী সেনের কথা বলতে চেয়ে কবিতায় নজরুল লেখেন, ‘বুড়ি-গঙ্গার পুলিন-বুকে বাঁধছে ঘাঁটি দস্যু রাজায়’। এমনই নানা ইঙ্গিত ছড়িয়ে আছে কবিতা জুড়ে। ফলে অচিরেই রাজরোষের মুখে পড়লেন তিনি। নভেম্বর মাসের আট তারিখে ‘ধূমকেতু’র কার্যালয়ে হানা দিল পুলিশ। আর ২৩ তারিখে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হলেন নজরুল। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪-ক এবং ১৫৩-ক ধারা মতে তিনি অভিযুক্ত হন।
মোকদ্দমার দিন পড়ল ২৯ নভেম্বর। কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার সুইনহো-র আদালতে বিচার শুরু হল। সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে নজরুলের পক্ষে সওয়াল করলেন উকিল মলিন মুখোপাধ্যায়। যথাসাধ্য চেষ্টা, দেশবাসীর তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন, তৎকালীন দেশনায়কদের হস্তক্ষেপ– এত কিছু সত্ত্বেও, রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁর এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। কিন্তু বিষয়টা আর খুব বেশিদিন ধরাবাঁধা কারাদণ্ডের মামলা রইল না, কারণ অচিরেই নিজের সমর্থনে একটি বিবৃতি আদালতে পেশ করলেন নজরুল। ঐতিহাসিক এই বিবৃতিটি ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে ‘ধূমকেতু’র বত্রিশ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বিচারাধীন এই সময়কালে তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে, তারপর তাঁকে আনা হয়েছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। পরে সাধারণ কয়েদি হিসেবে স্থান হল হুগলি জেলে।
হুগলি জেলের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। কয়েদিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অখাদ্য খাবার আর অত্যাচার ছিল মাত্রাছাড়া। জেলসুপার থার্সটন সাহেব ছিলেন এই সবের মূলে। এই লেখার শুরুতে যে প্যারডি গানের কথা বলা হয়েছে, নজরুল দলবল নিয়ে সেই গানখানি ধরতেন থার্সটনকে দেখলেই। ফলে অত্যাচার গেল আরও বেড়ে। প্রতিবাদে অনশনে বসলেন নজরুল এবং আরও প্রায় ২১ জন। এই খবর ছড়িয়ে যেতেই বাড়তে লাগল দর্শনার্থীর সংখ্যা, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ল অত্যাচার। প্রবল জ্বরে পড়লেন নজরুল, মাথায় রক্ত উঠে অজ্ঞানও হয়ে গেলেন বেশ কয়েকবার। নলিনীকান্ত সরকার, পবিত্র মুখোপাধ্যায়রা পাঁচিলের উপর থেকে করজোড়ে অনশন ভঙ্গ করার জন্য আবেদন করতে লাগলেন। দেশজোড়া হাহাকার, নজরুল বোধহয় আর ফিরবেন না।
রবীন্দ্রনাথ তখন শিলং-এ, তাঁকে এ খবর জানানো হলে তিনি লিখলেন, ‘আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা, তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যুও ঘটে তা হলেও তার অন্তরের সত্য ও আদর্শ চিরদিন মহিমময় হয়ে থাকবে’। নজরুলের অনশনের মহতী উদ্দেশ্য অনুধাবন করে বাইরে এই দৃঢ়তা দেখালেও, তাঁর স্নেহের নজরুলের এই অবস্থা মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ। সেন্ট্রাল জেলে তার করে বার্তা পাঠালেন, ‘Give up hunger strike, our literature claims you.’ নজরুলকে যে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেন্ট্রাল জেল থেকে এই খবর রবীন্দ্রনাথ তখনও পাননি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বার্তা ফেরত আসে।
বাংলা কবিতার জগতে নজরুলের মতো বর্ণময় চরিত্র কমই এসেছে। কবিতায়, গানে, গজলে, প্রেমে আর বিদ্রোহে আবেগে দীপ্ত তাঁর জীবন। ‘ভাঙার গান’ তাঁর হাতে লেখা হয়েছে গ্রেফতার হওয়ার আগেই। কিন্তু তার পরেও একটি কবিতার জন্য বছরব্যাপী এই কারাবাস তাঁর জীবনের ওপরে যে আলো এনে ফেলল, এ ঘটনা তাঁর জীবনেও অভূতপূর্ব, আর কোনও বাঙালি কবিও স্বাধীনতার লড়াই কলমের জোরে লড়তে গিয়ে কখনও গরাদের পিছনে দাঁড়াননি। স্বাধীনতার স্বপ্ন সত্যি হতে তখনও আরও ২৫ বছর বাকি। আজ শতবর্ষ পরের এই রোমন্থন ঘুমিয়ে পড়া এদেশকে বলতে কি পারবে, ‘ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি’?