Robbar

উত্তমের যে ছবিকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন মৃণাল সেন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 23, 2025 9:10 pm
  • Updated:July 24, 2025 3:11 pm  

ভালোবেসে আর ঘৃণা করে বার বার যিনি দেখেছেন কলকাতাকে– সেই মৃণাল সেনের প্রথম সিনেমার নায়ক লোটন। ছবির নাম ‘রাত-ভোর’। সে ছবিতে অভিনয় করলেন উত্তমকুমারও। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেল যে বছর সেই ১৯৫৫-তেই মুক্তি পেল মৃণাল সেনেরও প্রথম ছবি। 

আশিস পাঠক

জমিদার বেঁধে রেখেছে তথাকথিত এক চোরকে। তার দুঃখে গলে গিয়ে লোটন খুলে দেয় তার বাঁধন। জমিদারের হুকুমে লোটনের নির্বাসন হয়। জমিদারের বিশেষ বন্ধু কলকাতার অধ্যাপক দেবকুমারবাবু বললেন, ছেলেটিকে আমার সঙ্গে বরং যেতে বলুন। আমার কলকাতার বাসায় নিয়ে যাব। লোটনকে চলে আসতে হল কলকাতায়। কলকাতায় এসে লোটন প্রথমটা রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। লোটন যেন দু’দিনেই হাঁপিয়ে ওঠে। লোটনের আর কলকাতা ভালো লাগে না।

ভালোবেসে আর ঘৃণা করে বার বার যিনি দেখেছেন কলকাতাকে– সেই মৃণাল সেনের প্রথম সিনেমার নায়ক লোটন। ছবির নাম ‘রাত-ভোর’। সে ছবিতে অভিনয় করলেন উত্তমকুমারও। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেল যে বছর সেই ১৯৫৫-তেই মুক্তি পেল মৃণাল সেনেরও প্রথম ছবি।

কিন্তু প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে কোনও মায়া কোনও দিন ছিল না মৃণাল সেনের। বরং ও ছবিকে নিজের চিত্রপঞ্জি থেকে বাদ দিতে চাইতেন। এমনকী, জীবনের শেষ পর্বে আকাশবাণীকে দেওয়া রেডিয়ো-আত্মজীবনীতে ওই ‘রাত-ভোর’-এর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে চাননি মৃণাল।

তার সবচেয়ে বড় কারণ, ওই রেডিয়ো-আত্মজীবনীতে (মৃণাল সেন, ফিল্ম ডিরেক্টর, রেডিয়ো অটোবায়োগ্রাফি, পর্ব ৩, প্রসার ভারতী আর্কাইভস, ইউটিউব)  বলছেন মৃণাল, ‘আমাকে যে গল্পটা দেওয়া হয়েছিল সেটা ভীষণ সেন্টিমেন্টাল, খুব বাজে।… তা ছাড়া আমার তখন সিনেমার টেকনিকের ওপরেই কোনও দখল ছিল না। সবকিছু মিলে… এটা এত বড়, এত বাজে একটা ব্যর্থতা, আমি ওই ফিল্মটার নাম পর্যন্ত মনে করতে চাই না।’

রাত-ভোর-এর কাহিনি ছিল স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সে-কাহিনি উপন্যাসের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে ১৯৫৩-সালের পুজোয়। সেই গল্পটা থেকেই সিনেমা করতে চাইছিলেন সুনন্দা ব্যানার্জি। এই সুনন্দা ব্যানার্জিই ছিলেন উত্তমকুমার-অভিনীত প্রথম বাংলা ছবি ‘দৃষ্টিদান’-এর প্রযোজক। সে ছবির নায়িকাও ছিলেন তিনি। নায়ক ছিলেন অসিতবরণ। তাঁরই ছোটবেলার চরিত্রে স্বীকৃতিহীন অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার, তখন অবশ্য তিনি নিছক অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। সুনন্দা ব্যানার্জিরই এস বি প্রোডাকশনসের ব্যানারে তৈরি হয়েছিল উত্তমকুমারের প্রথম বাংলা ছবি এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে একমাত্র বাংলা ছবি। একটিতে অভিনেতা হিসেবে নাম পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি উত্তমকুমারের, আর একটিতে স্বয়ং পরিচালক ভুলে যেতে চান সেই ছবির নামটাই। পুজোর সময়েই রূপবাণী-অরুণা-ভারতীতে মুক্তি পেয়েছিল ‘রাত-ভোর’, ২১ অক্টোবর, ১৯৫৫৷ তার দু’মাস আগে মুক্তি পেয়েছে ‘পথের পাঁচালী’। ‘রাত-ভোর’ অবিশ্যি ২১টি দিন চলে ঘায়েল হয়ে শেষে ১০ নভেম্বর, ১৯৫৫ উঠে গেল।

ডিজি বা ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মৃণাল সেনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সুনন্দার সঙ্গে। গল্প তাঁর পছন্দের, কাস্টিংও তাঁরই। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা শুধু মৃণাল সেনের। আর সে কী কাস্টিং! সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ছায়াদেবী, ছবি বিশ্বাস, জহর রায়… ৷ পরিচালকের পছন্দে রইলেন শুধু কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা সেন, শ্রীমান মানিক ও শ্রীমান জয়ন্ত। সংগীত সলিল চৌধুরী, নেপথ্য কণ্ঠে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শ্যামল মিত্র।

কিন্তু রক্ষা হল না বক্স অফিসে। উত্তমকুমারের আবির্ভাবকালের মতোই মৃণাল সেনও এই প্রথম ছবিতেই সুপার ফ্লপ। সে বছর উত্তমকুমারের আরও ১১টা ছবি মুক্তি পায়। তাদের মধ্যে ছিল সুপারহিট ‘সবার উপরে’। মৃণাল সেন বলেছেন: ‘১৯৫৪ সাল নাগাদ।  কলকাতার এক বিখ্যাত অভিনেত্রী তাঁর প্রযোজিত একটি ছবি পরিচালনা করার জন্যে আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং এ কথাও স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে তিনি নিজের ছবিতে অভিনয় করবেন না। আমার কিছু লেখা পড়ে তাঁর ভালো লেগেছিল– খুবই ভদ্র। এই ভাবেই আমার প্রথম ছবি হল। আমার বাবা-মা খুশি, ভাবলেন এত দিনে আমার একটা হিল্লে হল। ছবি শেষ হওয়ার আগেই আমার বাবা মারা যান– একপক্ষে ভালোই হয়েছিল, কেননা ছবিটা দেখলে তাঁর নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক হত। এত জঘন্য, এত কুত্‍‌সিত ছবি আমি জীবনে দেখিনি।’