১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর ইন্দিরা গান্ধী সরকার যখন জরুরি অবস্থা তুলে নেয়, নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় সিপিআই(এম-এল) দলের। জন্মকালেই স্বঘোষিত আত্মগোপনকারী দলটি ধীরে ধীরে পথ ও পন্থার নানা অন্বেষণে কয়েকটি দলে খণ্ড খণ্ড হয়। ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধে চিনের অবস্থান দেখে অসীম চট্টোপাধ্যায় মুক্তযুদ্ধের সমর্থন না-করায় এবং ঘাঁটি এলাকার ক্ষেত্রে দেশের সুবিধাজনক ভৌগোলিক জায়গাগুলি বাছার কথা বলায় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তির পর অসীম গড়েন সিআরএলআই। নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন বিহারের সত্যনারায়ণ সিং, সন্তোষ রানা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। শুনেছিলাম, ১৯৭৬ সালে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেও আইনি জটিলতায় মুক্তি না পাওয়ায়, জেল ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন আজিজুল হক, নিশীথ ভট্টাচার্য।
আমি ‘আজকাল’ পত্রিকায় ১৯৯১ সালে যোগ দেওয়ার স্বল্পকাল আগে আজিজুলদা, আজিজুল হকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল। বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত একটি মিছিলে বা পথসভায়। তখন আটের দশকের প্রান্তিক সময়। নয়ের দশকের সূচনাকালে বাঙালি ও বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার একটা ঢেউ উঠেছিল– যাতে আমরা, লিটল ম্যাগাজিনগুলির লিখিয়েরা সামিল হয়েছিলাম। সভা, মিছিল হয়েছিল; ওই সময় সদ্য-চালু-হওয়া দূরদর্শন কলকাতা কেন্দ্রটিতে সারা দিনরাত দিল্লি দূরদর্শনে প্রচারিত হিন্দি অনুষ্ঠানগুলি দেখিয়ে, কেবল সকালে-বিকালে বাংলা খবর দেখানোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। দূরদর্শন কেন্দ্রের সামনে ৪৮ ঘণ্টার গণ অবস্থানের পয়লা দিনটিতে সারারাত কবিসম্মেলনে শঙ্খ ঘোষ এসেছিলেন, অসুস্থ অরুণ মিত্র লিখিত বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯ মে আমরা মিছিল, শ্যামবাজারে দু’-চারখানা পথসভাও করেছি। ওই রকম কোনও সভা বা মিছিলে আমি পরিচিত হয়েছি আজিজুলদার সঙ্গে। এরপর তো ‘আজকাল’-এ যোগ দেওয়া, আজিজুলদার সঙ্গে ঘনঘন দেখা। কথাবার্তা।
কিন্তু, তার আগে ‘যুগান্তর’-এ যখন, আটের দশকের শেষদিকটা আজকালে নিয়মিত পড়তাম জেলে থাকা আজিজুলদার খবর। সেকালে অশোক দাশগুপ্ত যেমন ছিলেন, এবং তাঁর সাংবাদিক সঙ্গীরা, তাঁরা আজিজুলদার মুক্তির দাবিকে আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। গৌরকিশোর ঘোষও তেমনটি চাইতেন। কারাগারে বন্দি আজিজুলদার অসুস্থতার মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়ে শৈবাল মিত্র ১৯৮৬ সালের ৫ জুলাই আজকালে একটি প্রতিবেদনে আজিজুলদার মুক্তির দাবি করেছিলেন। জেল থেকে লেখা আজিজুলদার জেলের চিঠিও ছাপা হত আজকালে। দেখাদেখি অন্যান্য কাগজগুলিতেও ইতিউতি বের হত কারাগারে অসহনীয় অবস্থায় আজিজুলদার থাকার খবর। তখন জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী। সেবার জ্যোতি বসুর আমলেই ১৯৮২ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন আজিজুল হক। এসময় বামফ্রন্ট সরকারের দুই মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী ও দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় জেলে গিয়ে আজিজুলদাকে দেখে এসে সুপারিশ করেন তাঁর মুক্তির জন্য। এসবেরও বেশ পরে আজিজুল হক মুক্তি পান ১৯৮৯-এর ২৫ ডিসেম্বর।
আজকালে ১৯৯১-এর পয়লা জানুয়ারি আমি যোগ দিই। মাঝেমধ্যেই আজিজুলদার সঙ্গে আমার কথা হত। দু’-একটি কথা বলতে চাইছি। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের এক অধ্যাপক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় গ্রেপ্তার হলেন মাওবাদী অভিযোগে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে ওই প্রথম মাওবাদী গ্রেপ্তার। আজিজুল হক আজকালে লিখে কৌশিকের মুক্তির দাবি করলেন। একাধিক লেখা। মৃদু রসিকতাও করলেন। লিখে দিলেন, “মাওবাদ বলে কিছু হয় নাকি? মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারা। মাও’জ থট।”
আমিও তো তা-ই শুনেছি। খটকা লেগে গেল আমার। আমার মামার বইয়ের নাম, ‘মাওবাদ ও ভারত-চীন বৌদ্ধদর্শন’! বইটির প্রকাশক– ক্রিয়েটিভ পাবলিকেশন, কলকাতা-৯। মামার কাছে ছুটলাম।
আমার মামা আজিজুলদার চেয়ে বয়সে বড়। তদুপরি চিনের কমিউনিস্টদের সঙ্গে ওঠাবসা করা। সেই চৌএন লাই যখন ভারত সফরে এসেছিলেন, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে করমর্দন করার পর নেহরু বলেছিলেন ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’। সেই যুগে বিদেশ মন্ত্রকের তলবে আমার মামা নারায়ণ সেনকে দিল্লিতে তুলে নিয়ে পিকিংয়ের ভারতীয় দূতাবাসে কূটনীতিক করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ নারানমামা শান্তিনিকেতনে চিনা ভাষা শিখেছিলেন দারুণভাবে। তারপর তো ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধ। ভারতীয় দূতাবাস থেকে ভারতীয় দূত, কূটনীতিক সবাই ফেরত এলেন। নারানমামা ফিরলেন না। তিনি তখন চিনা কমিউনিজমে বুঁদ হয়ে গিয়েছেন। ভারত সরকার এক্সপেল করে দিল মামাকে। ছোটবেলায় মামার বাড়ির অনুষ্ঠানাদিতে মা-মাসিদের ছলছল মুখ দেখেছি তাঁদের দাদা বা ভাই নারায়ণ মামার জন্য। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী, চিন-ভারত সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটালেন পিকিং সফরে, এক্সপালশন উঠল নারায়ণ মামার ওপর থেকে। মামা ফিরলেন কলকাতায়। শুনেছি, বামফ্রন্ট সরকার কুষ্টিয়া আবাসনে ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তাঁকে। ওই আবাসনে অমিতাভ চৌধুরীও থাকতেন। কখনও কখনও যেতাম। আমি মামাকে গিয়ে বললাম আজিজুলদার লেখাটির কথা। মামা আমাকে বিস্তর বোঝালেন। বললেন, ইমপ্লিমেন্টেশনে ‘থটস্-ইজম’ হয়ে গিয়েছে। ফলিতভাবে মাও জে দংয়ের চিন্তাধারা রূপায়িত হয়েছে। আজিজুলকে বলো।
ফিরে আজিজুলদাকে এসব বললাম। শুনে অনেকক্ষণ ভাবলেন। হাত মুঠো করে টেবিলে ঠুকলেন। বললেন, একদিন যাব তোমার মামার কাছে।
কী গভীর শোকের ঘটনা ঘটেছিল, দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল আজিজুলদার ছেলে!
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারকে সর্বতোভাবে সমর্থন করে গেছেন। কেউ কেউ মনে করতে পারেন, আজিজুল তখন বুদ্ধদেব সরকারকে সমালোচনামূলক সমর্থন করেছেন। আমি তা মনে করি না।
নন্দীগ্রাম আমি দেখিনি, যাইনি কখনও। কিন্তু সিঙ্গুরের ওই গ্রামগুলি আমি জানি। তিন ফসলি ওই সুফলা জমিকে ‘অনাবাদী, একফসলি’ অপবাদ দিয়ে তা শিল্পপতির হাতে দেওয়ায় ভূ-মা’র অসম্মানে বাংলার কৃষক সেদিন লাল নিশান হাত থেকে নামিয়ে দিয়েছে। আমি এ বিষয়ে অবিচল। আজিজুলদার সঙ্গে এ নিয়ে সহমত হইনি।
আজ বিকটের স্বমূর্তিধারণের চেয়ে সে ক্ষতি অধিক, আত্মগর্বী সিপিআইএম-এর তা ভাবা উচিত।
কিন্তু এসবের ঢের আগে, ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর ইন্দিরা গান্ধী সরকার যখন জরুরি অবস্থা তুলে নেয়, নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় সিপিআই(এম-এল) দলের। জন্মকালেই স্বঘোষিত আত্মগোপনকারী দলটি ধীরে ধীরে পথ ও পন্থার নানা অন্বেষণে কয়েকটি দলে খণ্ড খণ্ড হয়। ১৯৭১ সালে পূর্ববাংলার মুক্তিযুদ্ধে চিনের অবস্থান দেখে অসীম চট্টোপাধ্যায় মুক্তযুদ্ধের সমর্থন না-করায় এবং ঘাঁটি এলাকার ক্ষেত্রে দেশের সুবিধাজনক ভৌগোলিক জায়গাগুলি বাছার কথা বলায় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তির পর অসীম গড়েন সিআরএলআই। নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন বিহারের সত্যনারায়ণ সিং, সন্তোষ রানা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। শুনেছিলাম, ১৯৭৬ সালে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেও আইনি জটিলতায় মুক্তি না পাওয়ায়, জেল ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন আজিজুল হক, নিশীথ ভট্টাচার্য। চারুবাবুর সশস্ত্র লাইনে অবিচল থেকে তাঁরা দু’জন– আজিজুল হক আর নিশীথ ভট্টাচার্য গড়ে তুললেন সিপিআই(এম-এল) সেকেন্ড সি-সি বা দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি। বিহার, অন্ধ্রে ইতিউতি দপদপ করলেও, রাজ্যে তখন নকশালবাড়ির পয়লা মহাঢেউটি নিভে গিয়েছে, আজিজুল-নিশীথ সচেষ্ট হলেন দ্বিতীয় ঢেউ তোলার।
এসব মানুষ মৃত্যুতে শেষ হয় না। এঁরা ফুরোয় না।
আমি দু’জনকেই দেখেছি। কিছু কিছু কথা হয়েছে।
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..