‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ পুরস্কার পাওয়ার পর রূপকলায় ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ওঁকে প্রণাম করলাম। পুরস্কারটি দেখালাম। উনি স্বভাবসিদ্ধ হেসে আমার গালটা টিপে দিলেন। সেই ছবি আমার কাছে আছে এখনও। আমাকে বলেছিলেন– আরও অনেক ছবি করতে হবে। চালিয়ে যাও।
রূপকলা কেন্দ্রে ক্লাস শুরু হয়েছিল এই সেপ্টেম্বর মাসেই, ২০০২ সালে। তার আগে প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং পরীক্ষায় পাশ করলে ইন্টারভিউ পর্ব। রায় স্যরের নাম আমি দেখেছি বিভিন্ন ছবিতে। বিশেষত সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে। এর আগে চাক্ষুষ দেখিনি তাঁকে, তাঁর কোনও ফোটোগ্রাফও দেখিনি।
যাই হোক, ইন্টারভিউ বোর্ড বসেছিল রূপকলা কেন্দ্রের পাশেই রূপায়ণের তিন তলায়। ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি। বাইরে বসে আছি। আরও অনেকে বসে আছেন ইন্টারভিউতে ডাক পেয়ে। ক্রমানুসারে নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। এক একটা ইন্টারভিউ অনেকক্ষণ চলছে। আমি তখন একটা মাল্টিমিডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতাম। ঘড়ি দেখছি আর ভাবছি কখন যে ডাকবে! আমার অফিস যাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দেখি, একজন সৌম্যদর্শন ব্যক্তি বাইরে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা পাইপ। খুবই গম্ভীর। আমাদের পাশ দিয়েই ব্যালকনির দিকে গিয়ে পাইপ টানতে লাগলেন। আবার কিছুক্ষণ পরে ওই ঘরে ঢুকে গেলেন। তখনও চিনতে পারিনি। এরপর আমার ডাক এল। ভেতরে গিয়ে দেখি গিয়ে দেখি উনি বসে আছেন। স্যর আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন– ম্যাচ কাট কি জানো? টার্মটা শুনেছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা কী জানতাম না। উনি তখনই সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন।
এই গুরুগম্ভীর কিংবদন্তি লোকটিকেই যে শিক্ষক হিসাবে পাব, তা ভাবিনি তখন। রূপকলা কেন্দ্রে সম্পাদনা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর বিভিন্ন সময় ওঁর ক্লাস করেছি। বেশিরভাগ সময়ই দীর্ঘ ক্লাস। সারা দিন ধরে। কখনও ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ সাদা রঙের ব্যবহার এবং আলো কীভাবে করা হয়েছিল অথবা সেই বিখ্যাত ভূতের নাচের দৃশ্য কীভাবে টেক করা গেল। ‘অশনি সংকেত’-এ রঙের ব্যবহার, ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে রাতের দৃশ্যে একই সঙ্গে ঘরের আলো এবং চাঁদের আলোর ব্যবহার। ‘সোনার কেল্লা’য় ট্রেনের দৃশ্য কীভাবে টেক হল। ‘পলাতক’ কীভাবে করেছিলেন। ‘চরাচর’ কী করে হল। আমার ছোটবেলায় একটা চমৎকার সিরিয়াল হত টিভিতে– ‘পোটলি বাবা কি’। সেটা ওঁর করা শুনে খুবই ভালো লেগেছিল।
আমি সিনেমাটোগ্রাফির ছাত্র না হলেও ক্যামেরা সম্পর্কে খানিক উৎসাহ ছিল। স্যরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম। কখনও কখনও সেগুলো একদমই কাঁচা প্রশ্ন হয়ে যেত। স্যর ধৈর্য সহকারে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিতেন। কখনও কখনও সেইসব কাঁচা প্রশ্ন শুনে অট্টহাসি করে উঠতেন এবং তখনই আমাদের ভুলটা ধরিয়ে দিতেন। মাঝেমধ্যে গালটা টিপে দিয়ে হেসে বলতেন, মন দিয়ে পড়াশুনো করো। আমাদের যেটুকু সেলুলয়েড শিক্ষা, তা ওঁর হাত ধরেই হয়েছিল।
রায় স্যর দীর্ঘদিন রূপকলা কেন্দ্রে পড়িয়েছেন। পাস করার পর যখন কাজ করতে শুরু করি, তখন রূপকলায় গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতেন– কেমন আছ? কী কাজ করছ?
দেখা হলেই উৎসাহ দিতেন সব সময়। আমার প্রথম ছবি ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা প্রদর্শনী হয়েছিল। উনি এসেছিলেন। ছবি দেখে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন।
‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ পুরস্কার পাওয়ার পর রূপকলায় ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ওঁকে প্রণাম করলাম। পুরস্কারটি দেখালাম। উনি স্বভাবসিদ্ধ হেসে আমার গালটা টিপে দিলেন। সেই ছবি আমার কাছে আছে এখনও। আমাকে বলেছিলেন– আরও অনেক ছবি করতে হবে। চালিয়ে যাও।
আজকে মৃত্যুসংবাদ শুনে ওঁর বাড়ি গেলাম। উনি শুয়েছিলেন। বেশিক্ষণ ওই ঘরে থাকতে পারিনি। খারাপ লাগছিল। যখন ওঁর শববাহী গাড়িটা শ্মশানের দিকে রওনা দিল, তখন বুকটা ফাঁকা হয়ে আসছিল। একটা যুগ সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেলেন। আমাদের দেখার জন্য, শেখার জন্য অসাধারণ কাজগুলি রেখে গেলেন। এক মহাজীবনের সামান্য হলেও সাক্ষী থাকলাম আমরা, তাঁর ছাত্রছাত্রীরা।
আশা করি আরও অনেক ছবি করতে পারব স্যর।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
বছর খানেক আগে হাওড়ায় রাম নবমীর মিছিলে কিশোর সুমিত শা-এর ছবি ভেসে ওঠে, যে বন্দুক উঁচিয়ে হুংকার দিচ্ছিল ‘জয় শ্রী রাম’। মনে পড়ে যায় পহেলু খানকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত দুই কিশোরের কথা যারা অ্যাডোলেসেন্সের জেমির চরিত্রের মতোই সাজা কাটাচ্ছে বিশেষ সংশোধনাগারে।