একদিন এই প্রুফ দেখার সময়ই গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। দেখি কাঁচি-কাগজ সব পড়ে আছে। বললাম, ‘এগুলো কী প্রফুল্লদা?’ বললেন, ‘তুমি দেখবে?’ বললাম, ‘শুধু দেখব না, শুটিং করব।’ প্রফুল্লদা ছোট ছোট কাগজ কাটলেন। আঠা দিয়ে ওই পাণ্ডুলিপির ওপর লাগিয়ে দিলেন। সেই সাদা অংশে নতুন করে লেখার অংশ জুড়তেন। এত যত্ন– ভাবা যায় না! লক্ষ করেছিলাম, কথা বলতে বলতে প্রায়শই আঙুল চুলকোতেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কী ব্যাপার?’ বলেছিলেন, ‘এত আঠা ঘেঁটে ঘেঁটে আমার আঙুলটা সমসময় আঠা-আঠা হয়ে থাকে। তাই চুলকোই!’
প্রফুল্ল রায়, আমাদের প্রফুল্লদা, প্রয়াত হলেন। ‘সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি’র জন্য প্রফুল্ল রায়ের উপর একটি তথ্যচিত্র করেছিলাম। তথ্যচিত্রটা সম্পূর্ণ হলেও ওঁকে কোনওভাবেই দেখানো যায়নি। ওঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্যই। গত দেড়-দু’বছর ধরে নানা সময়, অসুস্থতাকে ফাঁকি দিয়ে প্রফুল্লদা ও আমরা বসে পড়েছি নানা সময় ক্যামেরার সামনে, ওঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে। ছোট্ট এই সময়টাতেই উনি ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। অথচ একটু সুস্থ ছিলেন যখন চারতলা হেঁটে উঠতেন, বাজারেও যেতেন।
তথ্যচিত্রের নাম দিয়েছিলাম ‘প্রফুল্ল রায়: আ প্যান ইন্ডিয়ান রাইটার’। প্রফুল্লদা বাংলা ভাষায় লিখলেও, তিনি সর্বভারতীয় লেখক। ওঁর প্রথম উপন্যাস ‘পূর্বা পার্বতী’– প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। নাগাল্যান্ডে গিয়ে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে মিশে, একাত্ম হয়ে লিখেছিলেন এই উপন্যাস। দুঃসাহসী এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় না-হলে এ লেখা অসম্ভব। বিহার নিয়েও গল্প-উপন্যাস লিখেছেন বহু। পড়লেই বোঝা যায়, বাড়ির টেবিল-চেয়ারে নয়, প্রতিটা মানুষকে, ঘটনাকে উনি চোখে দেখেছেন, কানে শুনেছেন, জীবনে উপলব্ধি করেছেন। আন্দামানের উদ্বাস্তুদের নিয়েও ওঁর লেখা রয়েছে, সেসবের প্রস্তুতি নিয়েছেন আন্দামানে ছিলেন যখন।
পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিলেন প্রফুল্ল রায়। এখানে ছিল ওঁর মামার বাড়ি। এসে পড়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। জাপানি বোমা পড়ল। কিছুটা সময় থেকে, আবারও তিনি চলে গিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গে। এই আসা-যাওয়া লেগে থাকার দরুন তিনি দুই বঙ্গকেই চিনতেন খুব কাছ থেকে। তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস, বিশেষ করে ‘কেয়াপাতার নৌকো’য় এই সময়কালের দীর্ঘ বিবরণ পেয়েছি। কিছু সময়ের জন্য চলে গিয়েছেন পশ্চিম উপকূলেও। কাটিয়েছেন বোম্বেতে। সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ করেছেন উপার্জনের জন্য। দীর্ঘদিন ছিলেন উত্তর বিহারেও। ওখানকার মানুষজনদের নিয়েও অনেক লেখা রয়েছে। বাংলায় খুব কম লেখকই আছেন যিনি এই পর্যায়ের ভ্রাম্যমাণ।
সত্যজিৎ রায়ের খুবই ইচ্ছে ছিল প্রফুল্লদার লেখা ‘আকাশের নীচে মানুষ’ থেকে ছবি করবেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন মানিকদা, তারপর আর হয়ে ওঠেনি। আমি প্রফুল্লদার গল্প ‘বর্ষায় একদিন’ নিয়ে ছবি করেছি ২০১৯ সালে। ছবির নাম ‘রাহগীর’। কোভিডের সময় ছবিটার রিলিজ আটকে যায়, এখন আবার রিলিজের কথা চলছে। আশা করি, দ্রুতই মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের কথা, এ ছবিও প্রফুল্লদাকে দেখানো গেল না। তবে শুটিংয়ের বহু গল্প শুনেছেন নানা সময়।
প্রফুল্লদার একটা আত্মজীবনীও রয়েছে। বাংলা ভাষায় আত্মজীবনী তো কম নেই। তবুও ওঁর ‘যখন যেমন মনে পড়ে’ মনে হয়নি স্রেফ গতানুগতিক আত্মজীবনীর মতোই। ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতির কোলাজ। আশ্চর্য বৈঠকি চাল রয়েছে সে লেখায়। একটানা স্মৃতিকথন নয়।
প্রফুল্লদার ছোটগল্প ‘বর্ষায় একদিন’ নিয়ে আমি ছবি করেছি। বিহারের প্রেক্ষাপটে লেখা এই গল্প। শুটিং করেছি ঝাড়খণ্ডে। অত্যন্ত মানবিক গল্প। দু’জন সাধারণ মানুষ, যাদের অনেক কিছুই নেই– কিন্তু আনন্দ রয়েছে। সেই আনন্দকে প্রফুল্লদা খুঁজে পেয়েছিলেন। এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা প্রবল বর্ষায় কীভাবে নিজেদের বাঁচায়– সেটাই ছিল গল্পের বিষয়বস্তু। প্রফুল্লদার লেখা নিয়ে বহু বাংলা ছবিই হয়েছে। ‘এখানে পিঞ্জর’ (১৯৭১) তো খুবই সুপারহিট হয়েছিল এককালে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোই কিন্তু প্রফুল্লদার লেখা থেকে– ‘বাঘ বাহাদুর’ (১৯৮৯), ‘চরাচর’ (১৯৯৪), ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ (২০০২)। কাছ থেকে তাঁর চরিত্রদের দেখেছিলেন বলেই, জীবনের রসবোধ বাদ পড়েনি তাঁর লেখায়।
আমার মনে হয়, সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত থেকেই প্রফুল্ল রায়ের লেখা বেঁচে থাকবে দীর্ঘকাল। তাঁর উত্তরসূরি তেমনভাবে কি কাউকে পাচ্ছি? খানিকটা, মনে হয়, অনিতা অগ্নিহোত্রী। মনে হয় অনিতাও প্রফুল্লদার ভক্ত। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মানুষের জীবন নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখার ঝোঁক অনিতার লেখাতেও পেয়েছি।
একসময় মাঝে মাঝেই অকারণে আমি ও আমার সহকর্মী অরুণ গুহঠাকুরতা উপস্থিত হতাম প্রফুল্লদার বাড়িতে। নেহাতই আড্ডা মারতে। প্রফুল্লদা চা খেতে খুব ভালোবাসতেন। এবং তা বিস্কুট-সহ। মাত্র ৭-৮ মাস আগেও প্রফুল্লদা দিব্যি লিখেছেন। ওঁর প্রুফ দেখার পদ্ধতি দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলাম আমি। সম্ভবত ওঁর আগে বাংলা সাহিত্যে এত যত্নে নিজের লেখার প্রুফ দেখতেন রাজশেখর বসু।
একদিন এই প্রুফ দেখার সময়ই গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। দেখি কাঁচি-কাগজ সব পড়ে আছে। বললাম, ‘এগুলো কী প্রফুল্লদা?’ বললেন, ‘তুমি দেখবে?’ বললাম, ‘শুধু দেখব না, শুটিং করব।’ প্রফুল্লদা ছোট ছোট কাগজ কাটলেন। আঠা দিয়ে ওই পাণ্ডুলিপির ওপর লাগিয়ে দিলেন। সেই সাদা অংশে নতুন করে লেখার অংশ জুড়তেন। এত যত্ন– ভাবা যায় না! লক্ষ করেছিলাম, কথা বলতে বলতে প্রায়শই আঙুল চুলকোতেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কী ব্যাপার?’ বলেছিলেন, ‘এত আঠা ঘেঁটে ঘেঁটে আমার আঙুলটা সমসময় আঠা-আঠা হয়ে থাকে। তাই চুলকোই!’
এত বয়সেও নিজের লেখা নিয়ে, এই যত্ন, অপরিমিত খুঁতখুঁতেমি– ভাবা যায় না! প্রফুল্লদাকে চেনার জন্য রইল ওঁর বহু লেখা। রইল প্রফুল্লদার তথ্যচিত্রটাও। পৃথিবী যখন আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি এসে হাঁপাচ্ছে, তখন প্রফুল্লদা আবার বেরিয়ে পড়লেন। এবার তিনি চিরভ্রাম্যমাণ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রমবিদ্যালয়ের আশ্রমকন্যাদের অগাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেখানে আলাদা করে কোনও প্রহরী রাখতেও দেননি। মেয়েদের স্বাধীন সত্তাকে এতটাই মূল্য দিতেন তিনি। তাই চিত্রনিভার স্কেচ করতে যাওয়ার জন্য তিনি কোনও সীমানা নির্দেশ করেননি, ছবি আঁকার জন্য তিনি যতদূর খুশি যেতে পারতেন।