রতন থিয়ামের কথা বলতে গেলেই সবার প্রথমে মনে পড়ে যায় ‘কোরাস রেপার্টারি থিয়েটার’-এর কথা। যা ওঁর নিজস্ব নাট্যদলও। যে থিয়েটারের একটা ভূমি তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তা শুধু একটা জায়গা নয়, তা আধুনিক থিয়েটার হল, যা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক থিয়েটার হলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এমন এক প্রেক্ষাগৃহ, তাঁর সৃষ্টিশীল কাজ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার প্রতি বিস্ময় জাগিয়ে তোলে। এবং এই যে যৌথখামার, যৌথ ভাবে থেকে থিয়েটারের জার্নির মধ্যে দিয়ে অভিনয়কে আবিষ্কার করা এবং কোথাও কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদেরকে আত্মনির্ভর ভাবে গড়ে তোলা, যাতে নিজেদের সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ থাকা যায়, সেই ইচ্ছাশক্তিকে মনে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন রতন থিয়াম, পেরেছিলেন ‘কোরাস রেপার্টারি থিয়েটার’-এর চলনের মধ্য দিয়ে।
‘রতন থিয়াম’– নামটা শুনলেই নিজের নাট্যজীবনের একেবারে শুরুর সময়ের যে উন্মাদনা, উত্তেজনা, যে স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা– একার্থে অদ্ভুত এক রঙিন রূপকথা, যে রূপকথাকে আদতে বিশ্বাস করতাম, তার কথা মনে পড়ে। সেই রূপকথা, আমাদের চারপাশের যে জগৎ, যে জীবন, যে অগণন মানুষ, তার চলনের ভিতর থেকে তা তৈরি হয়। অথচ আমাদের চারপাশের ধোঁয়া-ধুলো-কাদা-কংক্রিট তাকে ছুঁতে পারে না। তাই তাকে আরও বেশি করে ‘রূপকথা’ বলে মনে হয় এখনও। মনে হয়, যেন এই জগৎ-কে নির্মাণ করতে পারি আমার শিল্প এবং শিল্প-মাধ্যম দিয়ে। হয়তো কেউ তার নির্মাণ ঘটান বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে, কেউ রাজনৈতিক ভাবে, কেউ খেলাধুলোর মধ্য দিয়ে তা গড়ে তোলেন। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য সাধনাই এই নির্মাণের সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ প্রকাশ। এই ভাবনার মধ্য দিয়েই রতন থিয়ামকে বুঝতে পারি, অনুভব করতে পারি।
থিয়েটার করা যখন শুরু করেছি, একেবারে শিক্ষানবিশি পর্যায়ে, ‘নান্দীকার’-এ তখন ‘ন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল’ হত, এখনও হয়। তখন শুধু ভারত নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের নাটকও সেসময় মঞ্চস্থ হতে আমরা দেখেছি। সেখানেই আমার রতন থিয়ামকে আবিষ্কার করা। খুব বাড়াবাড়ি করে বললে বলতে হয়, সেই প্রথম দর্শন এবং রতন থিয়ামের প্রেমে পড়ে যাওয়া!
‘প্রেমে পড়ে যাওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করছি খুব সচেতনভাবে, কারণ, এইরকম সুদর্শন, এইরকম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং একইসঙ্গে নিজের সৃষ্টি, ভাবনাকে সুনিপুণ ভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে নিরলস প্রয়াস, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়া ও প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা– তা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে ভেবেছিলাম, এই রকমই তো হতে চেয়েছিলাম জীবনে! তার আগে হয়তো আমার ‘হয়ে ওঠা’ আর ‘হতে চাওয়া’র অবয়বটিকে ধরতে পারতাম না। রতন থিয়ামকে দেখার পর, ওঁর থিয়েটার ও নির্মাণ-ভাবনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর মনে হয়েছে– যদি কোনও দিন এই রকম হতে পারতাম! কিন্তু এটাও বুঝতে পারতাম, এই ‘হয়ে ওঠার’ নেপথ্যে কী কী ঘটনা ঘটতে ঘটতে যাচ্ছে।
রতন থিয়ামের কথা বলতে গেলেই সবার প্রথমে মনে পড়ে যায় ‘কোরাস রেপার্টারি থিয়েটার’-এর কথা। যা ওঁর নিজস্ব নাট্যদলও। যে থিয়েটারের একটা ভূমি তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তা শুধু একটা জায়গা নয়, তা আধুনিক থিয়েটার হল, যা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক থিয়েটার হলের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এমন এক প্রেক্ষাগৃহ, তাঁর সৃষ্টিশীল কাজ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার প্রতি বিস্ময় জাগিয়ে তোলে। এবং এই যে যৌথখামার, যৌথ ভাবে থেকে থিয়েটারের জার্নির মধ্য দিয়ে অভিনয়কে আবিষ্কার করা এবং কোথাও কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদেরকে আত্মনির্ভর ভাবে গড়ে তোলা, যাতে নিজেদের সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ থাকা যায়, সেই ইচ্ছাশক্তিকে মনে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন রতন থিয়াম, পেরেছিলেন ‘কোরাস রেপার্টারি থিয়েটার’-এর চলনের মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীতে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ নানাভাবে এই মডেলকে আদর্শ করে থিয়েটারের কাজকর্ম করেছেন। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য, বিশ্ব দরবারে তাকে অর্থবহ করে তুলেছেন রতন থিয়ামই। শুধু তাই নয়, তাঁর যে প্রযোজনাগুলি আমরা দেখেছি, তার মধ্যে ‘ঊরুভঙ্গম’, কিংবা মহাভারতের বিষয় নিয়ে ‘চক্রব্যূহ’ নাটক, তা যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনই মুগ্ধ করেছে ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’, ‘অন্ধযুগ’ নাটকও। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’, শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকও করেছেন এক সময়। ভাস রচিত ‘কর্ণভরম’ নিয়েও নাটক করেছেন। সব নাটকেই তিনি ছুঁয়ে গিয়েছেন সমসাময়িক বিষয়কে। ভারতীয় সংস্কৃতির যা নিজস্ব রস এবং ঐতিহ্য এবং শক্তি– বারবার তাকে রতন থিয়াম তুলে ধরছেন নিজস্ব চর্চায়।
‘উত্তর প্রিয়দর্শী’ থেকে ‘চক্রব্যূহ’– সব নাটকেই প্রতিফলিত হয়েছে রতন থিয়ামের অন্তরের চেতনা। সেখানে বাহ্যিক যা কিছু তা গৌণ, অন্তরের অনুভবটাই মুখ্য। তাঁর ভাবনার মধ্য দিয়ে মানুষকে ছুঁয়ে বাইরে যে চিত্তাকর্ষক ছবি তৈরি হচ্ছে, তা রতন থিয়ামের মতো করে আর কেউ তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু তারই সঙ্গে সমান্তরালে তৈরি করছেন অন্তরের ছবি। দুটোকেই নিজের সৃষ্টিকর্মে মিলিয়ে দিয়েছেন রতন থিয়াম, নিপুণ হাতে, একক দক্ষতায়। জাহাজের দক্ষ নাবিকের মতো।
‘টিমম্যান’ রতনকে দেখেছি আরও কাছ থেকে। ‘ন্য়াশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল’-এ ওঁরা যখন আসতেন, আমি ওঁদের সঙ্গে স্টেজ করা, এমনকী, রিহার্সলেও থাকতাম। একটা শোয়ে, সম্ভবত ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের শো হবে, অ্যাকাডেমি ফাইন আর্টসে ওঁদের নাটক চলাকালীনই একটি মেয়ে অভিনয় করতে করতে মঞ্চ থেকে নিচে পড়ে যায়। এবং জ্ঞান হারায়। সেই পরিস্থিতিতে কোনও মতে মেয়েটিকে তুলে ভিতরে নিয়ে আসা হয়। ওদিকে তখন নাটক চলছে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আমরা তখন একবুক আশঙ্কা দিয়ে কাঁপছিলাম যে, হয়তো মেয়েটিকে আর বাঁচাকে পারব না! শঙ্কা দানা বাঁধছিল, ওকে বোধহয় হারালাম!
রতন কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও কী অদম্য চেষ্টায় মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, ঠিক ক্যাপ্টেনের মতো, অভিভাবকের মতো। সেই পরিস্থিতিতেও খেয়াল করেছিলাম, একজন মানুষ, থিয়েটারের বাইরেও এই বিপন্নতাকে কীভাবে সামলাচ্ছেন! অনুভব করতে পারছিলাম, কেন, কোন কারণে অনেককে নিয়ে এত বড় কাজ উনি করতে পেরেছেন। রতন থিয়াম এরকমই। একেবারে হাত ডুবিয়ে জীবনের মধ্যে কাজ করতেই ও অভ্যস্ত এবং হাত ডুবিয়ে যে নোংরাগুলো উঠে, তাকে ঝেড়ে ফেলে ও অদ্ভুত এক আলো তৈরি করতে পারতেন, যার বিকিরণ সকলের মনে গিয়ে পৌঁছয়।
রতন থিয়ামের বহুমুখী প্রতিভা, তাঁর সুচারু দক্ষতার কথা উল্লেখ করেছিলাম। রতন থিয়াম এক অর্থে দক্ষ শিল্পী। তিনি আঁকতে পারেন, সেট নির্মাণ করতে পারেন, লোকনৃত্য, সংগীতে পারদর্শী। এসবের নেপথ্যে যে মিতেই সম্প্রদায়ের নিজস্ব আর্ট ফর্ম, সেই আর্টের সঙ্গে নিজেকে রতন জড়িয়ে নিয়েছিলেন নিবিড় ভাবে। সেই মিতেই সংস্কৃতি থেকে ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’ এবং তারপর সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা, তার সঙ্গে নিজের মধ্যে যে সংস্কৃতি রয়েছে, যে ভঙ্গিমা রয়েছে, তার প্রয়োগ তিনি ঘটিয়েছেন নিপুণ ভাবে, তার প্রকাশ দেখতে পাই মণিপুরি নৃত্যকলায়, সেই অভাবনীয় কর্মকাণ্ড আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। মণিপুরের সমসময়ের চলন, রাজনৈতিক উত্তাপকে ধরেছেন অন্য ভঙ্গিমায়। আমরা তাঁর সেই প্রয়াস, সেই সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে অভিজ্ঞতা আর সময়কে উল্টেপাল্টে দেখি। পাশাপাশি ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’-র ডিরেক্টরও ছিলেন এক সময়। ভারতের থিয়েটারের স্বরূপকে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরেছেন, কিন্তু সেখানে কোথাও ‘কলোনিয়াল হ্যাবিট’ ছিল না, প্রসেনিয়াম থিয়েটারের প্রভাব ছিল না। সেই ধরনকে ভেঙে ভেঙে নতুন ভঙ্গিমা গড়ে তুলেছিলেন, ছায়ায় ও ছবিতে তা অভাবনীয়। বিশ্বের কাছে রতন থিয়ামের এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় পরিচয়।
১৯৮৯ সালে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান পেয়েছেন, পেয়েছেন ‘সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি’ও। কিন্তু রতন থিয়ামের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ওঁর থিয়েটার, যা দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। ভবিষ্যতেও হবে। ‘কোরাস রেপার্টারি থিয়েটার’ তার বড় জায়গা। সকলে একসঙ্গে থেকে থিয়েটার করা, তাকে রুটিরুজির ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া, একটা স্বপ্ন দেখা, সেই ভাবনাকে নাট্যকর্মের মধ্য দিয়ে সফলভাবে গড়ে তোলার প্রয়াসে সবচেয়ে সফল রতন থিয়াম। যদি অসুস্থ না হতেন তাহলে হয়তো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমাদের আরও আরও মনোমুগ্ধকর প্রযোজনা উপহার দিতেন।
………………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved