এ দেশের আরও অনেক মেয়ের মতো কাদম্বিনী একা হয়ে যাননি। বাইরের দুনিয়ায় যখন তাঁকে একাধিক পুরুষের অসূয়া-কুৎসা-ঈর্ষার তির সামলাতে হচ্ছিল, তার সমস্ত সময় জুড়েই কাদম্বিনীর পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী, তাঁর স্কুলের শিক্ষক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ‘অবলাবান্ধব’ দ্বারকানাথ, যিনি নারীপ্রগতিকে ব্যঙ্গ করে লেখা সম্পাদকীয় এক সম্পাদককে আক্ষরিক অর্থেই গিলে খেতে বাধ্য করেছিলেন। দু’জনের বিয়ের পরেও বয়ে গিয়েছিল নিন্দা আর কুৎসার ঝড়। ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্ককে ‘কলুষিত’ করা নিয়ে ব্রাহ্ম সমাজেও গেল গেল রব।
একদিন যে মেয়েটিকে ডিগ্রি দিতে চায়নি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, আজ সেই কলেজেই শিশু বিভাগের SNCU-র বাইরে আঁটা একটি ফলক। যেখানে লেখা, “dedicated to the memory of the first lady doctor from Medical College, Bengal”। তিনি– কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। না, শুধু মেডিক্যাল কলেজ নয়, ভারতেরই প্রথম মহিলা ডাক্তার ছিলেন সেই মেয়েটি। কিন্তু সেই ‘প্রথম’ হওয়ার পথে কাঁটা ছড়ানো ছিল অনেক। এমনিতেই এ দেশের সমাজ চিরদিন মেয়েদের সঙ্গে বুদ্ধিহীনতার সমীকরণ টেনে মেয়েরা কী পরবে-র পাশাপাশি মেয়েরা কী পড়বে, তা নিয়েও মাথা ঘামিয়েই গিয়েছে। নারীশিক্ষা নিয়ে যখন আবেদন নিবেদন শুরু হল, সেই যুগেও নারীশিক্ষার সপক্ষের উকিলরা অধিকাংশই স্বামীসেবা ও সন্তানপালন ছাড়া নারীর শিক্ষার অন্য উদ্দেশ্য খুঁজে পাননি। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কোনও মেয়ের ডাক্তারি পড়তে চাওয়া সমাজের কাছে একরকম জেহাদ ঘোষণাই ছিল বটে। কিন্তু পড়ার জন্য লড়তে দ্বিধা ছিল না সেই মেয়ের। ভারতের মতো গোঁড়া দেশে একটি মেয়ে বিয়ের পর ডাক্তারি পড়ছে এবং সন্তানের জন্মের সময়েও যে লেকচার প্রায় কামাই করছে না, তার কথা মুগ্ধ বিস্ময়ে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন খোদ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
আসলে, গোটা বাংলা বা ভারতের কথা থাক, সেকালের রাজধানী কলকাতাও তখন এই চেনা শহরের থেকে অনেকটাই অন্যরকম। ইংরেজি শিক্ষার আলো ইতিউতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে বটে, শহর জুড়ে নব্যশিক্ষিত বাবুরা সংস্কৃতি চর্চা করছেন, কোনও কোনও সামাজিক সমস্যা নিয়ে কথাও বলছেন, তবুও তার আনাচেকানাচে জমাট বেঁধে আছে বহুযুগের অন্ধকার। সেকালে ভদ্র ঘরের মেয়েদের চলাফেরা করতে হয় পালকিতে, এমনকী, ব্রতপুজোর দিনে গঙ্গাস্নান করতে চাইলে তেমন তেমন ঘরে পালকি-সুদ্ধুই গঙ্গায় ডুব দিয়ে আনা হয় বউ-ঝিদের। পরপুরুষ দেখলে নাক পেরিয়ে ঘোমটা টানাই তাদের দস্তুর, আর গায়ে সেমিজ পায়ে জুতো মানে তো লজ্জার বিবিয়ানা। সেই মেয়েদের ঘরগড়া সুখদুঃখের খাঁচাটি ভেঙে যাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন, তৈরি করেছিলেন নতুন পথ, নয়া ইতিহাস— কাদম্বিনী তাঁদেরই একজন।
রবীন্দ্রনাথ যে বছর জন্মেছিলেন, সেই ১৮৬১ সালেই কাদম্বিনীর জন্ম। ভাগলপুরে। তাঁর বাবা ব্রজকিশোর বসু ভারতের প্রথম মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা। ফলে তখনকার আরও অনেক মেয়ের মতো বাড়ি থেকে পড়াশোনায় বাধা পাননি কাদম্বিনী। ভর্তি হয়েছিলেন হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে, যা ১৮৭৮ সালে মিলে যায় বেথুন স্কুলের সঙ্গে। তিনিই বেথুন স্কুলের প্রথম ছাত্রী, যিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। পাশ করার পরে জুটল খোদ লর্ড লিটনের প্রশংসা ও পুরস্কার। কিন্তু এবার কোথায় পড়বেন কাদম্বিনী? মেয়েদের জন্য বাংলায় কোনও কলেজই তো গড়ে ওঠেনি তখনও। অবশেষে তাঁর জন্যই বেথুন স্কুলকে কলেজে পরিণত করা হল। একজন ছাত্রী, অধ্যাপকও একজনই। সেখান থেকেই বিএ পরীক্ষায় বসলেন কাদম্বিনী। ভারতের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে একজন হওয়ার স্বীকৃতিও জুটল। সেবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দু’জনের ডিগ্রি নেওয়া দেখতে এত ভিড় হয়েছিল যে, পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। ভিড় নাকি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল সেই ট্রামলাইন পর্যন্ত!
কিন্তু কাদম্বিনী তো এখানেই থেমে যেতে চাননি। বিএ পাশের পরে, এবং আগেও, মেডিক্যাল কলেজে ভরতির জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। আরজি খারিজ হয়েছিল বারবার, সম্পূর্ণ অকারণে। কোনও ছাত্রীকে গায়নোকোলজি পড়াতে অধ্যাপকদের সংকোচ হবে, ছাত্ররা কু-ইঙ্গিত করতে পারে, এমনই নানা যুক্তি খাড়া করছিল মেডিক্যাল কলেজ। কিন্তু কাদম্বিনী দমে যাওয়ার পাত্রী নন। অবশেষে তাঁকে ভর্তি নিতে বাধ্য হল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, সৌজন্যে প্রথম ভারতীয় র্যাংলার আনন্দমোহন বসুর আইনি নোটিস। কিন্তু ভর্তি নিতে বাধ্য হলেও তো মনোভাব বদলায় না। গোটা কলেজে মেয়েদের জন্য কোনও শৌচাগার নেই। ক্লাস না থাকলে বসার জায়গা নেই! আর সবচেয়ে বড় ধাক্কা এল শেষ ফল প্রকাশের দিন। পরপর তিন বছর যে মেডিসিনে ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পেয়েছিলেন কাদম্বিনী, এমবি-র ফাইনাল পরীক্ষায় ঠিক সেই পেপারেই ফেল করানো হল তাঁকে। এক্ষেত্রেও সৌজন্যে এক বাঙালি পুরুষ, ডা. রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র। কিন্তু কাদম্বিনী হেরে যাওয়ার জন্য এই লড়াইটা শুরু করেননি। ডাক্তারির ডিগ্রি পাওয়ার জন্য তিনি এবার পাড়ি দিলেন বিলেতে। বিলেত যাওয়ার মতো সংস্থান ছিল না তাঁদের। শিকাগো মহাসম্মেলনের প্রদর্শনীতে ভারতীয় মহিলাদের শিল্পকর্ম পৌঁছে দেওয়ার কাজ নিয়ে তিনি রাহাখরচটুকু জোগাড় করে ফেললেন। দেশে ফিরলেন স্কটিশ কলেজ থেকে ট্রাইপস, এডিনবরা থেকে এমআরসিপি, গ্লাসগো থেকে এফআরসিএস আর ডাবলিন থেকে ডিএফপি ডিগ্রি নিয়ে।
পথটা কঠিন ছিল। কিন্তু ভাবতে ভালো লাগে, এ দেশের আরও অনেক মেয়ের মতো কাদম্বিনী একা হয়ে যাননি। বাইরের দুনিয়ায় যখন তাঁকে একাধিক পুরুষের অসূয়া-কুৎসা-ঈর্ষার তির সামলাতে হচ্ছিল, তার সমস্ত সময় জুড়েই কাদম্বিনীর পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী, তাঁর স্কুলের শিক্ষক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ‘অবলাবান্ধব’ দ্বারকানাথ, যিনি নারীপ্রগতিকে ব্যঙ্গ করে লেখা সম্পাদকীয় এক সম্পাদককে আক্ষরিক অর্থেই গিলে খেতে বাধ্য করেছিলেন। দু’জনের বিয়ের পরেও বয়ে গিয়েছিল নিন্দা আর কুৎসার ঝড়। ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্ককে ‘কলুষিত’ করা নিয়ে ব্রাহ্ম সমাজেও গেল গেল রব। ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় বেরল ব্যঙ্গচিত্র, দ্বারকানাথের নাকে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে চলেছেন কাদম্বিনী। মামলা করেছিলেন লড়াকু দম্পতি, শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমস্ত শিক্ষিত মেয়ে এই ব্যঙ্গের নিশানা বলেই। এই দ্বারকানাথের সাগ্রহ প্রেরণাতেই আট সন্তানকে ঘরে রেখে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন কাদম্বিনী। দেশে ফেরার পর তাঁর ছোট ছেলেটি মাকে চিনতে পারেনি। বাইরের অপমান-অসম্মানের পাশাপাশি ঘরেও জমেছিল দুঃখ। কিন্তু বেদনার উল্টোদিকে প্রাপ্তির ভাঁড়ারও ভরে উঠেছিল অন্যভাবে। কলকাতার ধনী বাড়িতে প্রসব করানোর পর খেতে দিয়ে বলা হয়েছিল খাবার জায়গা পরিষ্কার করে দিতে, কারণ ‘দাই’-দের পাতা ফেলবে না বাড়ির কাজের লোকরাও। আবার নেপালের মরণাপন্ন রাজমাতাকে সারিয়ে তোলার পর পোশাক, মৃগনাভি, তামা-পিতল-হাতির দাঁতের শৌখিন জিনিসে ঘর ভরে গিয়েছিল, সঙ্গে ছিল একটি সাদা টাট্টু ঘোড়া। বিলেত থেকে ফিরে ৩০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেছিলেন লেডি ডাফরিন হাসপাতালে, কিন্তু অচিরেই ইস্তফা দিয়ে শুরু করেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস। তিনিই কলকাতার প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্র্যাকটিস করতেন। আর সেই বিজ্ঞাপনের খ্যাতি যে কতদূর ছড়িয়েছিল, তা তো নেপাল থেকে ডাক আসাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
দ্বারকানাথের আগের পক্ষের মেয়ে বিধুমুখীর বিয়ে হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর মেয়ে পুণ্যলতা লিখেছেন, ‘দিদিমা বিলাত থেকে ফিরলেন, নতুন কায়দায় তাঁর ড্রয়িং রুম সাজানো হল। দেশ-বিদেশ থেকে আনা কত রকম সুন্দর সুন্দর জিনিস।’ পুণ্যলতার দাদা সুবিমলের আবার মনে থেকে গিয়েছিল কাদম্বিনীর পড়ার ঘরটিকে, ‘একটা ঘর ছেলেমেয়েদের কাছে বড় অদ্ভুত লাগত। সেটা ছিল তাদের ডাক্তার দিদিমা কাদম্বিনী গাঙ্গুলির পড়বার ঘর। সেখানে দেওয়ালে একটা মানুষের কঙ্কাল টাঙানো থাকত। বড় বড় আলমারিতে নানারকম ডাক্তারি বই আর যন্ত্রপাতি থাকত।’ বোঝা যায়, ডিগ্রি পাওয়ার পরেও চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ ফুরিয়ে যায়নি কাদম্বিনীর। তাই মৃত্যুর দিনেও জটিল অস্ত্রোপচার সেরে বাড়ি ফিরে তিনি পুত্রবধূকে বলেছিলেন, ‘লোকে বলতে শুরু করেছে ডা. গাঙ্গুলি নাকি বুড়ো হয়ে গেছেন, তাঁর হাত আর আগের মতন চলে না। আজ যে অপারেশন করে এলাম সেটা দেখলে তারা আর এ কথা বলতে সাহস করবে না।’ হ্যাঁ, একথা বলতে পারতেন বইকি ডা. কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। শোনা যায়, মৃত্যুর দিনেও তাঁর অর্জিত ভিজিটের পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ টাকা, যে টাকায় নাকি সেকালের কলকাতায় শ-পাঁচেক লোককে একদিন খাওয়ানো যেত!