অনেকাংশে ঢাকা পড়ে গেছেন তিন-চারজন নারী, প্রীতিলতার জীবনে যাঁদের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। মা প্রতিভা ওয়াদ্দেদার প্রীতিলতাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তাঁর সব সিদ্ধান্তের পাশে থেকেছেন। রাজনীতি-সচেতন করে, মেয়েদের জন্য সমাজ-নির্দিষ্ট ছক ভেঙে বিপ্লবের কাজে বৌদ্ধিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করার বিরাট কাজটি করেছিলেন ঢাকার ‘শ্রী সংঘ’-এর বিপ্লবী নেত্রী লীলা নাগ (রায়) ও প্রীতিলতার স্কুল-শিক্ষিকা ঊষাদি ও নীলিমাদি। আর একজন হলেন গুনুপিসিমা– যাঁর পুরো নামটা কোথাও পাইনি।
আবার এসেছে ২৪ সেপ্টেম্বর! যে অগ্নিকন্যার ছবি-সহ পোস্টার আজও আমাদের নানা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের অংশ হয়ে ওঠে, সেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের (১৯১১-’৩২) দুঃসাহসী অভিযান শেষে বিদায় নেওয়ার দিন।
২১ বছরের মেয়েটির কথা ভাবছি, যাঁকে খুবই শান্ত ও অন্তর্মুখী বলে জানতেন তাঁর পরিচিতজন। ভাবতে চেষ্টা করছি, চট্টগ্রামের ওই সুধীরা মেয়েটিকে বিপ্লবীকাজের জন্য তৈরি করায় বড় ভূমিকা ছিল কাদের? সেই সূত্রে প্রশ্ন রাখছি, দেশকর্মী মেয়েদের দলে টানতে, নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও কাজের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মীজীবনের দিকে মেয়েদের আকর্ষণ করতেন কারা? দাদারা তো অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু শুধুই কি তাঁরা? ‘রিক্রুটার’ ও ‘আইডল/ রোলমডেল’ হিসেবে মেয়েদের কোনও ভূমিকা ছিল কি?
আমরা পড়েছি যে, স্কুল-কলেজে পড়াকালীন প্রীতিলতাকে নাড়া দিয়েছিল ক্ষুদিরাম, কানাইলাল দত্ত ও অন্যান্য শহিদের আত্মত্যাগ এবং চট্টগ্রামের বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, অর্ধেন্দু ও পূর্ণেন্দু দস্তিদার, নির্মল সেন ও মাস্টারদা সূর্য সেনকে জানার অভিঘাত ছিল গভীর। এঁদের আড়ালে অনেকাংশে ঢাকা পড়ে গেছেন তিন-চারজন নারী, প্রীতিলতার জীবনে যাঁদের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। মা প্রতিভা ওয়াদ্দেদার প্রীতিলতাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তাঁর সব সিদ্ধান্তের পাশে থেকেছেন। রাজনীতি-সচেতন করে, মেয়েদের জন্য সমাজ-নির্দিষ্ট ছক ভেঙে বিপ্লবের কাজে বৌদ্ধিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করার বিরাট কাজটি করেছিলেন ঢাকার ‘শ্রী সংঘ’-এর বিপ্লবী নেত্রী লীলা নাগ (রায়) ও প্রীতিলতার স্কুল-শিক্ষিকা ঊষাদি ও নীলিমাদি। আর একজন হলেন গুনুপিসিমা– যাঁর পুরো নামটা কোথাও পাইনি।
এই গুনুপিসিমা আদতে বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের বিধবা পিসিমা, যাঁর উত্তর কলকাতার বাড়ি বহু বিপ্লবীর আশ্রয় ছিল এক সময়ে। প্রীতিলতা যখন বেথুন কলেজে পড়তে আসেন, সেই সময় গুনুপিসিমার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। এই পিসিমাই তাঁকে পাঠান আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের কাছে। গুনুপিসিমার পরামর্শ অনুযায়ী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ‘বোন’ পরিচয় দিয়ে প্রীতিলতা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান এবং অনুমতি পাওয়ার পর রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসি হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ৪০ বার দেখা করেন। এই সাক্ষাৎকারগুলো প্রীতিলতাকে মৃত্যুপণ করে দেশের কাজের জন্য প্রস্তুত করে দেয়।
শুধু প্রীতিলতা নয়, আরও অনেকের বেলায় আমরা দেখি, মেয়েরা নেপথ্যে থেকে সহযোগী হওয়ার রাস্তা পেরিয়ে, বহু বাধা ঠেলে নিজেরা সরাসরি যুক্ত হওয়ার অধিকার আদায় করে, তাঁদের বন্ধুদের অথবা বোনেদের দলে টেনেছেন। যেমন, কুমিল্লার সুপরিচিত ছাত্রীদ্বয় শান্তি ঘোষ-সুনীতি চৌধুরিকে (যাঁরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করেন ১৯৩১ সালের ডিসেম্বরে) দলে আনেন তাঁদেরই স্কুলের সহপাঠী বিপ্লবী প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম (১৯১৪-’৩৭)। সুনীতি চৌধুরির মেয়ে ভারতী সেন তাঁর মা-র কাছে জেনেছিলেন যে, কুমিল্লার যুগান্তর দলের অখিল নন্দী-বীরেন ভট্টাচার্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, জেলায় ‘ছাত্রী সংঘ’ গঠন করে মেয়েদের রিক্রুট করা থেকে শুরু করে ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স হত্যার পরিকল্পনা– সবকিছুতেই ছিল কিশোরী প্রফুল্লনলিনীর প্রধান উদ্যোগ। শান্তি-সুনীতি গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিনই বন্দি করা হয় তাঁকে এবং রাজবন্দি-জীবনের পাঁচ বছরের মাথায় রোগাক্রান্ত প্রফুল্লনলিনীর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঘটায় ব্রিটিশ সরকার।
প্রফুল্লনলিনীর মতো রাজবন্দি অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন তাঁর প্রায় সমবয়সি আরেক বিপ্লবী নারী– বনলতা দাশগুপ্ত (১৯১৫-’৩৬)। বছর দুই আগে বনলতার ভাইপো, এই বছরের গোড়ায় প্রয়াত লেখক সুজন দাশগুপ্তের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে জেনেছিলাম যে, তাঁর নীনাপিসি অর্থাৎ বনলতা এবং আর এক পিসি শান্তিলতাকে দেশের কাজে টেনে এনেছিলেন এঁদের বড় বোন চারুলতা। চারুলতাকে কুড়ির দশকে চারদিন অনশন করে কলেজে পরার অনুমতি আদায় করতে হয়েছিল তাঁর বাবার থেকে! বিপ্লবী দলে যোগদানের জন্য চারুলতাকে ঠিক কী কী পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, সেটা জানার অবশ্য কোনও উপায় নেই, কারণ তিনি স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন বহুকাল আগে এবং কখনও কিছু লিখে রেখে যাননি।
সাধারণত আমরা যখন নারীপুরুষ নির্বিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিষয়ে পড়ি, তখন তাঁদের জীবনে প্রভাববিস্তারী মানুষদের কথা জানতে গিয়ে হদিশ পাই পরিবারের কিংবা দলের কোনও অগ্রজ অথবা কোনও শিক্ষক অথবা নেতৃস্থানীয় কোনও ব্যক্তির, যাঁদের দেখে ও সংস্পর্শে এসে চিন্তার মোড় ঘুরে গিয়েছিল অল্পবয়সি দেশপ্রেমিকদের। দেখি যে, মনোজগতে আলোড়ন তোলা এই ব্যক্তিরা প্রায় সবসময় পুরুষ, কখনওসখনও অবশ্য উল্লিখিত হন কারও প্রেরণাদাত্রী মা/বউদি।
তবে মেয়েদের লেখা আত্মকথা ও গল্প-উপন্যাসে চোখ রাখলে মাঝেমধ্যে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। মণিকুন্তলা সেন ও কনক মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথায় তাঁদের রোলমডেল হয়ে ওঠা শিক্ষিকাদের কথা জানতে পারি, যাঁরা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলেও ছাত্রীদের মনে এক নবচেতনা ও অন্যরকম জীবনবোধের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।
শান্তিসুধা ঘোষের ‘জীবনের রঙ্গমঞ্চ’-তে অন্তত দু’-জন রাজনৈতিক কর্মী-নারীর কথা আছে, যাঁদের দেখে বিস্মিত শান্তিসুধা এক অন্য ধরনের অনুসরণযোগ্য মডেলের খোঁজ পান। ১৯২০-র কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে ১৩ বছরের বালিকা শান্তিসুধা তাঁর দাদার সঙ্গে এসে, মহিলা-স্বেচ্ছাসেবিকাদের অধিনায়িকারূপে ‘একজন বলিষ্ঠ’ মহিলাকে দেখার কথা উল্লেখ করেছেন, যাঁর মতো ‘জবরদস্ত কর্মদক্ষ মহিলা বোধহয় আগে কখনও’ বালিকার ‘চোখে পড়েনি’। ‘সম্ভ্রমে ও সংকোচে’ শান্তিসুধা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন মহিলার নাম জ্যোর্তিময়ী গাংগুলী– বিশিষ্ট সমাজসেবিকা ও কংগ্রেস কর্মী। এর কয়েক বছর পর বি. এ. পড়ার সময় এক বন্ধুর বাড়িতে শান্তিসুধার সঙ্গে পরিচয় ঘটছে প্রায় সমবয়সি একটি মেয়ের, যাঁর চেহারাও ‘মোটাসোটা বলিষ্ঠ’ এবং যার ‘চলনে-বলনে’ একটি ‘নূতনত্ব’– ‘আমাদের মতো একঘেয়ে জীবনধারার বাইরে কোথায় যেন তার গতিবিধি’। সেই মেয়েটির নাম সুহাসিনী গাংগুলী– যাঁকে স্বদেশি যুগে সবাই ‘পুটুদি’ নামেই চিনত এবং যাঁর রাজনীতির প্রতি ‘বিশেষ সচেতনতা’ আকৃষ্ট করেছিল শান্তিসুধাকে।
সে সময় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মূক-বধির বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত সুহাসিনীকে কলকাতার ‘ছাত্রী সংঘ’-এর সাঁতার ক্লাস থেকে ‘যুগান্তর’ দলে ‘রিক্রুট’ করেছিলেন বিপ্লবী কমলা দাশগুপ্ত। এরপর ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের চন্দননগরে একটি নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার জন্য সুহাসিনী যে অসমসাহসী প্রথাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে সম্পর্কে ইতিহাস বইয়ে কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু যেটা নিয়ে খুব কমই জানা যায়, সেটা হল তিন ও চারের দশকে বেশ কয়েক বছর কারারুদ্ধ থাকার ফাঁকে ফাঁকে এবং স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সুহাসিনী আগের মতোই কাজ করেছেন দু’-তিনটি স্কুলে এবং ছাত্রীদের দেশপ্রেমে দীক্ষিত করা ও তাদের তরুণমনে নিজে এক রোলমডেল হয়ে উপস্থিত থাকার মধ্য দিয়ে নীরবে খুলে দিয়েছেন অনেকগুলো সম্ভাবনা।
প্রীতিলতার আত্ম-বিসর্জনের দিনটা তাই গুনুপিসিমা-প্রফুল্লনলিনী-সুহাসিনীদের স্মরণ করারও দিন হোক।