৩৩ বছরের আইবুড়ো মেয়ে লেখালিখি-সম্পাদনা করে ক্ষান্ত দেননি, সক্রিয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করছেন। হতাশ দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সরলা বরং তরবারিকে-ই বিয়ে করে নিক! উচ্চস্বরা, ক্ষিপ্রগতি সরলা রবিমামারও প্রিয়পাত্রী নন। আজ তাঁর মৃত্যুদিন। লিখছেন শতাব্দী দাশ।
‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’-র প্রসঙ্গ উঠলেই দেখা যায় নায়কের অবিসংবাদিত প্রাধান্য। মঞ্চ নায়িকাশূন্য প্রায়। সতীদাহ রদ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, নারীশিক্ষা প্রসার করছেন পুরুষেরা। বিবেকানন্দের পাশে নিবেদিতা আছেন, কিন্তু পার্শ্বচরিত্র হিসেবে। কংগ্রেসে মেয়েদের আনাগোনা বাড়ছে, তবে পুরুষের ছত্রছায়ায়। শিক্ষিতা হলেন যাঁরা, তাঁরা কি নারীর ‘উপকার’-এর ভার পুরুষের ওপরেই ছাড়লেন? লিঙ্গগোষ্ঠীর একজন হিসেবে নিজে ঝাঁপালেন না? প্রান্তিকের কথা প্রান্তিক না বললে অনেক কিছুই যে থেকে যায় অব্যক্ত! এই কাজটি করেছিলেন সরলা দেবী চৌধুরাণী, হৃদয়-অবাধ্য মেয়ে। সমসময়ের তাবড় পুরুষ একাধারে তাঁর গুণমুগ্ধ ও সমালোচক। সে তালিকায় আছেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ এবং অবশ্যই গান্ধী, যিনি সরলার সঙ্গে মনে মনে ‘আধ্যাত্মিক বিয়ে’ সেরে নিয়েছিলেন, কিন্তু ‘ইহা করণীয়, উহা বর্জনীয়’ ইত্যাদি ‘ম্যানসপ্লেনিং’-এ ভরা চিঠিপত্র লিখে সরলাকে বাগে আনতে পারেননি।
আরও পড়ুন: ‘যে পড়ে না, সে লিখতেও পারে না’, এমনটাই কি বলতে চাইছিলেন গুলজার?
প্রগতিশীল ব্রাহ্ম ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউরা নতুন কেতায় সেমিজ-শাড়ি পরবে, বিলেত যাবে স্বামীর সঙ্গে, গাড়ি চালাবে– এসব চল ছিল। কিন্তু পেশা নির্বাচন! তাও নিজ শহরে নয়, সুদূর দাক্ষিণাত্যে পাড়ি দেওয়া ‘মহীশূর মহারানি গার্লস কলেজ’-এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে, এ নজির গড়া সরলার পক্ষেই সম্ভব। ৩৩ বছরের আইবুড়ো মেয়ে লেখালিখি-সম্পাদনা করে ক্ষান্ত দেননি, সক্রিয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করছেন। হতাশ দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সরলা বরং তরবারিকে-ই বিয়ে করে নিক! উচ্চস্বরা, ক্ষিপ্রগতি সরলা রবিমামারও প্রিয়পাত্রী নন।
সাংগঠনিক সক্ষমতা তাঁর রক্তে ছিল। মা স্বর্ণকুমারী দেবী সামাজিক-রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার জন্য গড়েছিলেন ‘সখি সমিতি’। বাড়িতে মেয়েদের ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’-ও চলেছিল ক’বছর। মা ‘মহিলা শিল্প মেলা’র-ও উদ্যোক্তা। বীজবপন অতএব হয়েছিল, সরলার কাজ ছিল অঙ্কুরের উদ্গমন ঘটানো। সরলা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগেই মেয়েদের জন্য খাদি ও অন্যান্য কুটিরশিল্প সামগ্রী নিয়ে গড়েছিলেন ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। এরপর সরলা পারিবারিক স্তরে নয়, জাতীয় স্তরে মহিলা সংগঠন পরিকল্পনা করলেন সরলা। ফলাফল: ‘ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল’।
আরও পড়ুন: ‘আমারে তোমরা মাইরা ফালাইবা’ বলেছিলেন জর্জদা
জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের সঙ্গে নানা সমান্তরাল অধিবেশন বসত। পুরুষরা মহিলা কংগ্রেস অধিবেশনের আয়োজন করতেন। এমনই এক অধিবেশনে স্থায়ী সর্বভারতীয় নারী সংগঠনের কথাটি পাড়েন সরলা। সমর্থনের ঢেউ আছড়ে পড়ল। মেয়েদের একান্ত সভায় এবার নিউক্লিয়াসটি গড়া হল। আগামী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হল সরলাকে, যিনি একক সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। তাঁর উপরেই পড়ল খসড়া সংবিধান রচনার ভার। ১৯১০ সালে এলাহাবাদ কংগ্রেসে আত্মপ্রকাশ করল ‘ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল’, সর্বধর্মবর্ণশ্রেণির নারী-সমন্বয় প্রকল্প। এক টাকার বিনিময়ে সদস্যপদ গ্রহণ শুরু হল। প্রথম শাখা লাহোরে, কারণ সরলা লাহোরবাসী হয়েছেন বিবাহের পর। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ল কানপুর, হাজারিবাগ, কলকাতা, হায়দরাবাদ, অমৃতসর, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরে।
সরলার নারীবাদী ভাবনার উড়াল এখানে থামল না। মুখ খুললেই আগুনের ফুলকি। ১৯৩১ সালে কলকাতায় মহিলা কংগ্রেস অধিবেশনে সরলা বলেছেন, আইনভঙ্গের আন্দোলনে মেয়েদের ডাক পড়লে আইন তৈরির সময় ডাক পড়বে না কেন? বললেন, সম্পত্তিতে ও স্বামী-পুত্রের উপার্জনে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত হোক। পুরসভায় মেয়েদের আসন পাকা হোক। মেয়েদের ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক দীক্ষা আর তাদের দায়িত্বগ্রহণে উজ্জীবিত করা– এই তিন ধারা ঘিরে সরলার কর্মযজ্ঞ।
সরলা যখন ফিরে আসেন কলকাতায়, তখন ১৯২৭ সালে ‘বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশন লিগ’ স্থাপিত হয় চারদিনের অধিবেশনে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চস্তরের নারীশিক্ষার উদ্দেশ্যে। শেষদিনে সরলা পৌরহিত্য করেন। ওই বছরই পুনায় ‘নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন’-এর প্রথম অধিবেশনে তিনি বাঙালি প্রতিনিধি। ১৯২৮ সালে মহামণ্ডলের কলকাতা শাখার উদ্যোগে তৈরি হয় ‘ভারত স্ত্রী শিক্ষাসদন’। ভবানীপুর ও অ্যালবার্ট হলে প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি হয়। ছাত্রীনিবাসও গড়ে ওঠে।
সীমাবদ্ধতা ছিল। ছিল গ্রামের নিম্নবিত্ত মেয়েদের জড়ানোর অপারগতা। প্রচেষ্টা উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শহুরে আবর্তে পাক খেয়েছিল। যেমন গোড়ার দিকের পাশ্চাত্যের নারী-আন্দোলনেও হয়েছিল। অনেক পরে তাঁরা ব্ল্যাক ফেমিনিস্টদের, আমরা দলিত ফেমিনিজমকে পেয়েছি। কিন্তু সূচনালগ্নকে অস্বীকার করা যায় কি? তাছাড়া পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন না হলেও, সরলা কিন্তু পরাধীন দেশে বসে, সর্বভারতীয় ধর্ম-জাতি-বর্ণ-শ্রেণি নিরপেক্ষ নারী সংগঠনের কথাই লিখেছিলেন সংবিধানে।
সরলা তেজস্বী ‘ভারতী’-র সম্পাদক হিসেবেও। রবিমামা-কে দিয়ে ‘চিরকুমার সভা’ লিখিয়ে নেন। আবার নতুন লেখিকা-লেখক আবিষ্কার করেন। ছিলেন আরেক ব্যক্তিগত সরলাও– গান-পাগল, বই-পাগল, যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য থেকে উঁকি দেয়। আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ তাই হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক, কারণ ‘ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক’।