গুলজারের ডায়েরিতে ওঁর হাতের লেখায় থাকে ওঁর পছন্দের কবিতা, আমাকে দেখিয়েছিলেন। তাঁর ভারতীয় কবিতা পড়া দেখে অবাক হয়েছিলাম। গুলজার বলেছিলেন, ‘পড়লে, লিখতে পারি।’ আজ তাঁর জন্মদিন। লিখছেন সুবোধ সরকার।
কিছু মানুষ আছেন, পৃথিবীতে যাঁদের পাশে দু’দণ্ড বসতে পারলে মন ভাল হয়ে যায়। যাঁর কাছে আমি কিছু চাইতে আসিনি। কিছু পেতে আসিনি। কোনও অভিযোগ জানাতে আসিনি। স্রেফ একটু বসতে এসেছি। এক মিনিট বসে চলে যাব। গুলজারের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে আমার মনে হয়েছে, গোলাপ বাগান, আমি তোমার সৌগন্ধ প্রাণ ভরে নেব। গন্ধে অবশ হয়ে যাব। বড়জোর তোমার গোলাপ বাগানে বসে এক পেয়ালা চা খেতে পারি। তারপর চলে যাব। গোলাপ বাগান, তোমাকে নিয়ে আমার কোনও আদিখ্যেতা নেই, কিন্তু উদযাপন আছে। হাহাকার নেই কিন্তু সংবরণ আছে। ধৃষ্টতা নেই কিন্তু ধারণ আছে। রাজমুকুট নেই কিন্তু রাজত্ব আছে। সেই রাজত্ব কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ যেমন, তেমনই অরুণাচল থেকে অমরাবতী। ধারাভি বস্তি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাকিস্তানের ঝিলম জেলায় শিখ পরিবারে জন্মে আর কোনও আধুনিক কবি উপমহাদেশের কবি হয়ে উঠতে পারেননি। গুলজার পেরেছেন। ঝিলমের আর কোনও ছেলে এত বড় উপমহাদেশের হৃদয় শাসন করেনি। আর কোনও হিন্দি ছায়াছবির গীতিকার এত বড় কবি হতে পারেননি। ভারতবিখ্যাত গীতিকার অনেকেই আছেন, তাঁরা গানটা ভাল লেখেন, কবিতাটা হয় না, যেমন জাভেদ আখতার। ঠুংরি ভাল গাইলেই কি গজল ভাল গাওয়া যায়?
রাশিয়ায় ‘মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার’-এ সেবার ডাক পেয়েছিলাম। দুটো লেখকদল পাঠিয়েছিল ভারত সরকার। একটি ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের মাধ্যমে। আর একটি সাহিত্য অকাদেমির সৌজন্যে। কেন এরকম হল, জানি না। জাহাজের খবর রাখি না। একটি দলে গুলজার, অশোক বাজপেয়ী, নবনীতা দেবসেন নিয়ে প্রায় ১০-১২ জন লেখক। অন্য দলে আরও ১০-১২ জন। আমি ঢুকে গেলাম গুলজার আর অশোক বাজপেয়ীর মাঝখানে। বইমেলাতে আমাদের বিশেষ কোনও কাজ ছিল না। ২০-২৫ জন শ্রোতা, তাও ভারতীয়রাই বেশি, আমি কোনওরকমে আমার কবিতা পাঠ করে পালিয়ে গেলাম বরিস পাস্তারনাকের বাড়ি দেখতে। বইমেলার বাইরে একটা রাস্তার ধারে টেবিল-চেয়ার পেতে গুলজার, অশোক বাজপেয়ীদের সঙ্গে যে আড্ডাটা হয়েছিল, সেটাকেই মনে হল আসল বুক ফেয়ার। গুলজার এমন একজন মানুষ, যিনি কোনও মত চাপিয়ে দেন না। আমি ছাত্রের মতো লক্ষ করছিলাম। সবাই বলাবলি করছিল, যে-মেলাতে গুলজার আসেন, সেখানে তো তিল ধারণের জায়গা থাকে না, মস্কোর বইমেলা এত ক্যালাস কেন? গুলজারের মতো একটা নাম ওরা ব্যবহার করতে পারল না? গুলজারকে বলতেই হাসিমুখে সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে বলতে শুরু করলেন। সেই মুহূর্তে এত প্রশান্তি নেমে এসেছিল তাঁর মুখে, মনে হয়েছিল তাঁর মুখ শ্রাবস্তীর কারুকার্য।
খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম দিল্লিতে। কোভিডের আগের বছর। সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কার মঞ্চ। সেবার গুলজার প্রধান অতিথি এবং প্রধান বক্তা। তিনি প্রায় ঘণ্টাখানেক যে বিষয় নিয়ে বললেন, তা হল ভারতের কবিতা। বা বলা যায় কবিতার ভারত। হাতে লিখিত বক্তৃতা নিয়ে আমি কখনও গুলজারকে মঞ্চে উঠতে দেখিনি। সেদিন দেখেছিলাম। কী যত্ন নিয়ে তিনি অরুণাচল-মণিপুরের কবিতা থেকে শুরু করে ডগরি-কোঙ্কনি হয়ে বাংলা-মারাঠি-কন্নড় ভাষাতে ঢুকে পড়লেন, তা দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম! গুলজারের একটা ডায়েরি দেখেছিলাম, উনিই দেখিয়েছিলেন, সেখানে যখন যার কবিতা ভাল লেগেছে, লিখে রেখেছেন। ডায়েরিটা হয়ে উঠেছিল ভারত কবিতার আর্কাইভ। এখান থেকেই তাঁর পছন্দের কবিতা নিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি অসাধারণ বই, যার নাম ‘আ পোয়েম আ ডে’। সেদিন বক্তৃতা শেষ করে যখন আমরা ডিনারে যাচ্ছিলাম, উনি আমার পিঠে হাত রেখে হালকা সুরে বললেন, কী সুবোধদাদা, ঠিক ছিল তো? আমি বলতে পারলাম না কী অপূর্ব বলেছেন, সবাই তাই বলছিলেন। আমি শুধু বললাম, আপনি মণিপুরের ইবম্চার কবিতাও পড়েছেন’? ওঁর মতো বিখ্যাত ও ব্যস্ত কবি ভারতে আর তো কেউ নেই। নাই পড়তে পারতেন নীলিম কুমারের কবিতা। গুলজার বললেন, ‘পড়লে, লিখতে পারি।’
মানুষ ছোটবেলায় প্রথমে শোনে, শুনতে শুনতে সে বলতে শেখে। যে শোনে না, সে বলতে পারে না। সেদিন গুলজারের কথার ভেতরে কি লুকিয়েছিল সেই কথা যে, যে পড়ে না সে লিখতে পারে না। এই বয়সে ভারতের কবিতা আবিষ্কার করে কী হবে? উর্দু হলেই চলবে। আমার বন্ধুরা তো ব্যঙ্গ করতেন কন্নড়ে কি পোস্ট-কলোনিয়ালিজম চলিতেছে? গুলজার এখনও যা পারেন, আমরা তাঁর অনুজ হয়েও পারব না।