ইদানীং স্কুলগুলিতে পৃথক লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরিয়ানের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কি এই ব্যবস্থা আছে? আমি জানি না। আমরা বরং সাধারণ গ্রন্থাগারের শিশু বিভাগের প্রতি মনোযোগী হই। ‘রাজা রামমােহন রায় লাইব্রেরি ফাউন্ডেশন’ তার নিজস্ব তহবিল থেকে লাইব্রেরির উন্নয়নের জন্যে যেসব কর্মসূচি রূপন্তর হয়েছে, তার মধ্যে সাধারণ গ্রন্থাগারগুলির শিশু বিভাগকে বা শিশুদের জন্য গ্রন্থাগারগুলিকে, সহায়তা দান করা হয়। অর্থাৎ, সরকারের এবং একই সঙ্গে গ্রন্থাগার পরিষদের ইচ্ছা শুভ এবং সৎ। কিন্তু গ্রন্থাগারগুলি কি তাদের পথ সুগম করে শিশু বা কিশোরদের গ্রন্থাগারমুখী করে তুলতে পেরেছে?
‘মুকুল’ পত্রিকা যখন প্রথম প্রকাশ পায়, সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল– ‘যাহাদের বয়স ৮/৯ হইতে ১৬/১৭-র মধ্যে ইহা প্রধানত তাহাদের জন্য।’ শিশুদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক সৃজনী সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা অনেককাল আগেই মানুষের বোধগম্য হয়েছিল। গ্রন্থ মুদ্রণের আগেই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল শিশুপ্রিয় রূপকথা, ছড়া। মুদ্রণ ব্যবস্থা আসার পর বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকই আগে ছাপা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যখনই শিক্ষাবিদগণ বুঝতে পেরেছেন বিদ্যালয়ের পুস্তকই যথেষ্ট নয়, তাঁদেরই কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ। পরবর্তীকালে দেখা যাচ্ছে, শিশুসাহিত্য হিসেবে যেগুলি আমরা উল্লেখ করছি, বিশেষ করে যখন বাংলা শিশুসাহিত্য গ্রন্থপঞ্জিতে দেখেছি, সবসময় সেই সব পঞ্জিতে দেখা যাচ্ছে শিশু ও কিশোর সাহিত্য একইসঙ্গে। শিশুসাহিত্যকে ১৮ বছরের পাঠক-সীমা নির্ধারণ কতটা ঠিক, এটাও ভাবা উচিত বলে মনে হয়।
ব্যক্তি, পশুপাখি, একইসঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশী, ভালো লোক, দুষ্টু লোক, ফুটবল, ক্রিকেট– এমন সব ধরনের উপকরণ নিয়ে শিশুর যে মনোজগতের গঠন, শিশুসাহিত্যে তারই প্রতিবিম্বণ ঘটে। এই জগৎতটিকে চিনতে ও চেনাতে পারলেই শিশুসাহিত্যের পূর্ণবিকাশ ঘটে। কিন্তু কীভাবে? এর অন্যতম প্রধান উপাদান বই।
আমরা যদি বাংলা মুদ্রণের আদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখতে পাই ছোটদের পত্রিকার প্রথম যুগে, কেশব সেনের ‘বালকবন্ধু’ বা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘বালক’ বা প্রমদাচরণ সেনের ‘সখা’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ঠিক এই গুণগুলোই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘সখা’র সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘আমাদের হতভাগ্য দেশে বালক-বালিকাদের জ্ঞানের ও চরিত্রের উন্নতির জন্য অধিক লোক চিন্তা করে না… ‘সখা’ পিতামাতার উপদেশ এবং শিক্ষকের শিক্ষা দুইই প্রদান করবে।’’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই প্রসঙ্গে সেই দীর্ঘ, ফরসা, দাড়িওলা লোকটির বক্তব্য মনে পড়ে যায়– ‘ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর কিছুই নাই। দেশ কাল শিক্ষা প্রথা অনুসারে বয়স্ক মানবের কত নূতন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শত সহস্র বৎসর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে। সেই অপরিবর্তনীয় পুরাতন বারংবার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে, অথচ সর্বপ্রথম দিন সে যেমন নবীন, যেমন সুকুমার, যেমন মূঢ়, যেমন মধুর ছিল আজও ঠিক তেমনি আছে।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমার মতে, বই হাতে পাওয়ার আগেই আমরা পত্রিকা হাতে পাই। পত্রিকা পড়ার একটা আলাদা টান থাকে। একটা সময়ের প্রেক্ষিত থাকে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তা পড়ে শেষ করে ফেলতে হবে। নতুন আর একটি সংখ্যার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা তার পর। বইয়ের চেয়েও তার টান বেশি। প্রসঙ্গক্রমে একটি উদ্ধৃতির দিকে চোখ রাখা যাক–
‘‘আমি স্কুলে ভর্তি হই ১৯৩০ সালের জানুযারিতে, যখন আমার বয়স আট। আমার মেজকাকা সুবিনয় রায় সে সময় নতুন করে বের করলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। ১৯২৩-এর সেপ্টেম্বরে বাবা মারা যাবার পর বছর দুয়েকের মধ্যেই ‘সন্দেশ’ উঠে যায়। তখনও আমার সন্দেশ’ পড়ার বয়স হয়নি। টাটকা বেরোনর সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা হল এই দ্বিতীয় পর্বে। মলাটে তিন রঙা ছবি, হাতি দাঁড়িয়ে আছে দুপায়ে, শুঁড়ে ব্যালান্স করা সন্দেশের হাঁড়ি। এই সন্দেশেই ধারবাহিকভাবে প্রথম সংখ্যা থেকে বেরোয় রবীন্দ্রনাথের ‘সে’ আর এই সন্দেশেই প্রথম গল্প লিখলেন লীলা মজুমদার। ওঁর গল্পের সঙ্গে মজার মজার ছবিগুলো উনি তখন নিজেই আঁকতেন। আঁকিয়েদের মধ্যে ছিলেন তোমাদের খুব চেনা শৈল চক্রবর্তী। তাঁর হাতেখড়ি সম্ভবত হয় এই সন্দেশেই। …আর একটা ছোটদের বাংলা মাসিক পত্রিকা তখন বেরোয় সেটা বেশ ভাল লাগতো, সেটা হল ‘রামধনু ‘। রামধনুর অফিস ছিল বকুলবাগান রোড আর শ্যামানন্দ রোডের মোড়ে, আমাদের বাড়ি থেকে দুশো গজ দূরে। এই কাগজের সম্পাদক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ করে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। কারণ ওঁর লেখা জাপানী গেয়েন্দা গল্প ‘পঞ্চরাগ’ আর ‘ঘোষ চৌধুরীর ঘড়ি’ দারুণ ভালো লেগেছিল। এঁরই ভাই ক্ষিতীশ ভট্টাচার্য আবার আরেকটি খুদে আকারের ছোটদের কাগজ বার করতেন। যার নাম ছিল ‘মাস পয়লা’।’’ (যখন ছোট ছিলাম, সত্যজিৎ রায়)
এই অংশটি উল্লেখ করার কারণ, সেই ৮/১০ বছরের এক বালকের মনে শিশু সাহিত্য কতটা প্রভাব ফেলেছিল, তার প্রমাণ। সেই ছেলেবেলার অভিজ্ঞতার কথা প্রায় ৫৫/৬০ বছর পরেও সমান উজ্জ্বল। শুধু তাই নয়, সেই সুখ-স্মৃতিই তাঁকে কিশোর সাহিত্যের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় লেখকে পরিণত করেছিল। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং, আমার দাদুর কাছে যেমন তাঁদের কালের পত্রপত্রিকার প্রতি ভালোবাসার কথা শুনেছি, আমার প্রায় বাবার বয়সি এই স্মৃতিকথার লেখকের অভিজ্ঞতা শুনলাম, ঠিক তেমনই। আমাদের স্মৃতিতেও এমন অভিজ্ঞতার সুখস্মৃতি জমা হয়ে আছে। এই প্রসঙ্গে সেই দীর্ঘ, ফরসা, দাড়িওলা লোকটির বক্তব্য মনে পড়ে যায়– ‘ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর কিছুই নাই। দেশ কাল শিক্ষা প্রথা অনুসারে বয়স্ক মানবের কত নূতন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শত সহস্র বৎসর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে। সেই অপরিবর্তনীয় পুরাতন বারংবার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে, অথচ সর্বপ্রথম দিন সে যেমন নবীন, যেমন সুকুমার, যেমন মূঢ়, যেমন মধুর ছিল আজও ঠিক তেমনি আছে।’
এই শিশুদের মনের বিকাশে গ্রন্থাগারের কী ভূমিকা থাকতে পারে? কারণ এতক্ষণ যে শিশুসাহিত্যের কথা বলা হল, বাড়ির শিশুদের জন্যে তার অনেকটাই বাড়ির বাবা-মা বা অভিভাবকরাই কিনে এনে দিতে পারেন বা দেওয়া উচিত। কিন্ত সব বই, সব প্রয়োজনীয় বই বাড়িতে কিনে আনা সম্ভব নয়। তার জন্যে আছে গ্রন্থাগার। আমার যতদূর ধারণা, অনেক ক্ষেত্রে পড়ার বইয়ের বাইরে পড়ার জন্যে ছোটদের প্রথম গ্রন্থাগারের অভিজ্ঞতা হয় স্কুলের লাইব্রেরি থেকে। আমার মনে আছে, আমাদের স্কুলেও লাইব্রেরি ছিল। প্রতি সপ্তাহে একদিন ছিল লাইব্রেরি পিরিয়ড। সেদিন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক লাইব্রেরি ঘরে তাঁর টেবলের ওপর একগুচ্ছ বই দু’থাকে সাজিয়ে রাখতেন। রোল নম্বর অনুযায়ী ছাত্রেরা এসে ওই দু’টি থাকের একদম ওপরের দু’টি বই থেকে যে কোনও একটি বই বেছে নিত। এবং দু’সপ্তাহ পর সেটি ফেরত দিতে বাধ্য থাকতাম। যদিও বন্ধুদের কাছ থেকে অদলদল করে আমরা দু’সপ্তাহে একাধিক বই পড়ে ফেলতাম। কিন্তু সেটা কখনওই সঠিক পদ্ধতি ছিল না।
ইদানীং স্কুলগুলিতে পৃথক লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরিয়ানের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কি এই ব্যবস্থা আছে? আমি জানি না। আমরা বরং সাধারণ গ্রন্থাগারের শিশু বিভাগের প্রতি মনোযোগী হই। শিশু গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে বঙ্গীয় গ্রন্থাগার সম্মেলনে। ‘বিদ্যালয় ও শিশু গ্রন্থাগার’, ‘বিদ্যালয় গ্রন্থাগার ও শিশু গ্রন্থাগার’, ‘ছোটদের গ্রন্থাগার’ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এবং এই আলোচনার ফলেই প্রতিটি উচ্চ ও উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সর্বসময়ের গ্রন্থাগারিকের অধীনে বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। গ্রন্থাগারিক দিবসের সম্মেলনেও শিশুদের জন্যে গ্রন্থাগার নিয়ে আলোচনা হয়েছে একাধিকবার। ‘রাজা রামমােহন রায় লাইব্রেরি ফাউন্ডেশন’ তার নিজস্ব তহবিল থেকে লাইব্রেরির উন্নয়নের জন্যে যেসব কর্মসূচি রূপন্তর হয়েছে, তার মধ্যে সাধারণ গ্রন্থাগারগুলির শিশু বিভাগকে বা শিশুদের জন্য গ্রন্থাগারগুলিকে, সহায়তা দান করা হয়। অর্থাৎ, সরকারের এবং একই সঙ্গে গ্রন্থাগার পরিষদের ইচ্ছা শুভ এবং সৎ। কিন্তু গ্রন্থাগারগুলি কি তাদের পথ সুগম করে শিশু বা কিশোরদের গ্রন্থাগারমুখী করে তুলতে পেরেছে?
এখানে বয়সের প্রশ্নটা উঠে আসে। কারণ শিশু গ্রন্থাগারের সদস্য হতে হলে তাকে ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে হতে হবে। প্রাকবিদ্যালয় স্তরে, অর্থাৎ ৫/৬ বছরের শিশুদের যখন শব্দ শিক্ষার বয়স, শিক্ষার বয়স, পরিবেশের বিভিন্ন জিনিস সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে ওঠার বয়স, যখন শিশুদের সবে কল্পনাশক্তি বিকাশ শুরু হচ্ছে– ঠিক এই সময়ে গ্রন্থাগারের কোনও ভূমিকা নেই। কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই সময়ে অভিভাবকের দায়িত্ব থাকে তাদের হাতে গ্রন্থ তুলে দেওয়া। ফলে এই নির্বাচনে থাকে গুরুদায়িত্ব। ৬ থেকে ১১ বছর বয়সি শিশুদের জন্য, অর্থাৎ স্কুলে প্রবেশের পর তাদের মানসিক বিকাশে উন্নতি হয়, মনোযোগ বৃদ্ধি পায়, ঠিক এই সময় থেকেই তাদের পছন্দমতো গ্রন্থ ও অবশ্যই গ্রন্থাগারের গুরুত্বের কথা এসে পড়ে। বাড়ির লোকেরা যেমন তাদের বই জোগান দেন, তেমনই গ্রন্থাগারের সদস্য হওয়ারও সুযোগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে সাহায্যের হাত বড়িয়ে দেওয়া উচিত। যাতে বিদ্যালয়ের পড়াশোনার বাইরেও তাদের অন্য গ্রন্থের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়। এই বয়সের ছোটদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা গড়ে ওঠে। সেটাকে সুস্থ মানসিকতার দিকে এগিয়ে দিতে শুধু স্কুল নয়, গ্রন্থাগারকেও এগিয়ে আসতে হবে।
এখন মোবাইলের যুগ। বিপথে যাওয়ার নানা ব্যবস্থা ওই একটি যন্ত্রের মধ্যেই ধরা থাকে। কিন্তু যদি সুস্থ সংস্কৃতির ব্যবস্থা করে তাদের মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। কী করে? ভালো সিনেমা দেখানো শুধু নয়, দেখার পর যদি আলোচনার সুযোগ করে দেওয়া যায়। এ জিনিস বিদেশে ৫০/৬০ বছর আগেই করেছে।
তবে সমস্যা একটাই। লাইব্রেরিতে কর্মচারীর সংখ্যা অপ্রতুল। প্রায় সব লাইব্রেরিতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় নাগরিকেরা। এবং তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ। ফলে এভাবেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আশা রাখি, বয়স্কদের সঙ্গে ছোটরাও যদি গ্রন্থাগারমুখী হয়ে ওঠে, গ্রন্থাগারকে ভালোবাসতে পারে, তাহলে গ্রন্থাগারের পাশাপাশি সমাজও একদিন অনন্য হয়ে উঠবে, উঠবেই।
প্রচ্ছদের শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী