জন্মদিন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪১-এর ১৭ মে, প্রয়াণ সংখ্যা প্রকাশের ঘোষিত তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ হলেও প্রকাশ পেয়েছিল এক সপ্তাহ পরে। বিপুল তথ্য ও চিত্রের সমাবেশ প্রকাশ করা কঠিন, ছাপাখানা ও ছাপাই কর্মীদের সহযোগিতা সব সময় পাওয়া যায় না। পুরসভার ছাপাখানাটিতে এই চিত্র-তথ্য ছাপার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। তাই অন্যত্র যেতে হয়েছিল। সব মিলিয়ে দেরি। অমল হোম জানতেন, যতই কবি তথ্যের স্তূপ দেখে বিচলিত হন তিনি সম্পাদক হিসেবে ভবিষ্যৎ পাঠকদের কাছে রবীন্দ্র তথ্যের ভাণ্ডারটি যতটা সম্ভব সুবিন্যস্ত করে যাচ্ছেন। এই সংখ্যাটি হাতে থাকলে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যাবে।
শ্রাবণ মাসের ২২ তারিখ তিনি চলে গেলেন। তাঁকে স্মরণ করে কলকাতা পুরসভা প্রকাশ করল বিশেষ স্মরণ সংখ্যা। সম্পাদক অমল হোম। এর আগে অমল হোমের সম্পাদনায় কলকাতা পুরসভা থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর শেষ জন্মদিনের বিশেষ সংখ্যাটি, তখন অবশ্য জানা ছিল না, মর পৃথিবীতে তাঁর এটাই জীবৎকালের শেষ জন্মদিন। সম্পাদক অমল হোমকে কবি চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘অমল, তুমি আশ্চর্য করে দিয়েছ। তোমার সংগ্রহ প্রাচুর্য একেবারে অভ্রভেদী এবং অতলস্পর্শী। আমার ক্লান্ত দেহে আমি ভাল করে সমস্তটার অনুসরণ করতে পারব না। সুস্থ শরীর যাদের তারাও বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠবে। এত বিচিত্র আমদানী ইতিপূর্বে তারা কোথায়ও পায়নি। আমার বাল্যলীলা থেকে আরম্ভ করে অন্তলীলা পর্যন্ত যে স্তূপাকার পরিচয়ের সামগ্রী তুমি সাজিয়ে তুলেছ সেগুলি পাঠকদের অঞ্জলি ছাপিয়ে গিয়েছে, তারা তোমার জয়ধ্বনি করবে।’
জন্মদিনের সেই বিশেষ সংখ্যাটিতে কবিজীবনের ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত ধরা হয়েছিল ছবিতে, কথায়। যাকে পিক্টোরিয়াল বায়োগ্রাফি বলে তারই আদল ছিল সেখানে। এটি সংযোজন-সহ যুক্ত হয়েছিল বিশেষ প্রয়াণ সংখ্যাতেও। অমল হোমকে টাইপ করা প্রশংসাসূচক চিঠির তলায় কাঁপা-কাঁপা হরফে নিজের হাতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘সব যে ভালো লেগেছে তা নয়, পড়তে এবং দেখতে মাঝে মাঝে লজ্জা বোধ হয়।’ নিজের তথ্যগত জীবনচরিত সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের কুণ্ঠা চিরকালই ছিল। কবিকে যে তাঁর তথ্যগত জীবনচরিতে পাওয়া যায় না, তথ্যের স্তূপ যে অনেক সময় কবির প্রকৃত পরিচয়কে ঢেকে দেয়, একথা তো সারাজীবন নানা ভাবে বলেছিলেন তিনি। তাই জীবনের প্রান্তবেলায় অমল হোমের সম্পাদিত সংখ্যায় সেই তথ্যের প্রাচুর্য দেখে তাঁর দ্বিধা হওয়া স্বাভাবিক।
সম্পাদক অমল হোম অবশ্য অন্যরকম করে ভাবছিলেন। জন্মদিন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪১-এর ১৭ মে, প্রয়াণ সংখ্যা প্রকাশের ঘোষিত তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ হলেও প্রকাশ পেয়েছিল এক সপ্তাহ পরে। বিপুল তথ্য ও চিত্রের সমাবেশ প্রকাশ করা কঠিন, ছাপাখানা ও ছাপাই কর্মীদের সহযোগিতা সব সময় পাওয়া যায় না। পুরসভার ছাপাখানাটিতে এই চিত্র-তথ্য ছাপার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। তাই অন্যত্র যেতে হয়েছিল। সব মিলিয়ে দেরি। অমল হোম জানতেন, যতই কবি তথ্যের স্তূপ দেখে বিচলিত হন তিনি সম্পাদক হিসেবে ভবিষ্যৎ পাঠকদের কাছে রবীন্দ্র তথ্যের ভাণ্ডারটি যতটা সম্ভব সুবিন্যস্ত করে যাচ্ছেন। এই সংখ্যাটি হাতে থাকলে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যাবে। শুধু তো জীবনের ধারাবাহিক সচিত্র বৃত্তান্তই নেই আছে রবীন্দ্ররচনার ধারাবাহিক পঞ্জি ( ১৮৭৮-১৯৪১)। তথ্যনিষ্ঠায় বাঙালিদের সুখ্যাতি নেই, অমল হোম যেন সেই অখ্যাতি মোচন করতে চাইছেন।
এই জীবনপঞ্জি ও রচনাপঞ্জি ছাড়া এই সংখ্যার প্রথমাংশে ছিল নিবন্ধ ও স্মরণিকা, কবির প্রয়াণের পর লেখা হয়েছিল সেগুলি। এদিক থেকে এই স্মরণ সংখ্যাটি কেবল তথ্যের পুঞ্জ হিসেবেই নয়, আবেগদীপ্ত উচ্চারণের প্রবহমান ধারা হিসেবেও গ্রহণযোগ্য। শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতন ভ্রমণের স্মৃতিকথায়। যে বুদ্ধদেব কল্লোল পর্বের তারুণ্যে প্রশ্নশীল ছিলেন সেই বুদ্ধদেবই রবীন্দ্রনাথের শেষবেলায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন সব পেয়েছির দেশ। বুদ্ধদেব লিখেছেন তাঁর কণ্ঠস্বর আগের থেকে ক্ষীণতর কিন্তু কথার দীপ্তি তখনও একই রকম। বুদ্ধদেব জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ বলতেন না অসুস্থতার (illness) রোগের (disease) কথা, বলতেন তিনি ক্লান্ত (tired), শরীর নামের যন্ত্রটি অকেজো হয়ে পড়েছে (body-machine had gone out of order)। তিনি আর তাঁর শরীর যেন আলাদা। রোগ ও অসুস্থতা তো তাঁর নয়, শরীরযন্ত্রের– ক্লান্ত সেই যন্ত্রটি।
………………………………………………………
যে বুদ্ধদেব বসু কল্লোল পর্বের তারুণ্যে প্রশ্নশীল ছিলেন সেই বুদ্ধদেবই রবীন্দ্রনাথের শেষবেলায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন সব পেয়েছির দেশ। বুদ্ধদেব লিখেছেন তাঁর কণ্ঠস্বর আগের থেকে ক্ষীণতর কিন্তু কথার দীপ্তি তখনও একই রকম। বুদ্ধদেব জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ বলতেন না অসুস্থতার (illness) রোগের (disease) কথা, বলতেন তিনি ক্লান্ত (tired), শরীর নামের যন্ত্রটি অকেজো হয়ে পড়েছে (body-machine had gone out of order)। তিনি আর তাঁর শরীর যেন আলাদা। রোগ ও অসুস্থতা তো তাঁর নয়, শরীরযন্ত্রের– ক্লান্ত সেই যন্ত্রটি।
………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথ যে ব্যক্তিগত অসুস্থতায় আচ্ছন্ন হয়ে তাঁর মনটিকে শরীরে আটকে রাখেননি সে-কথা জানিয়েছেন রবিপরিকর আশ্রমিক। চূড়ান্ত অসুস্থতার মধ্যেও চিন ও রাশিয়া নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা বলছেন। রাশিয়া আসন্ন যুদ্ধে সাফল্য পাক, চাইছেন তিনি। কমিউনিজিমের সংকট কোথায় তা নিজের মতো করে জেনেও রাশিয়ার পক্ষ নিচ্ছেন। অমিয় চক্রবর্তীর মিতায়তন লেখাটিতে জানিয়েছিলেন, মৃত্যু এল আর এল ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ মনুষ্য সাগর তার যাবতীয় উন্মত্ততা নিয়ে। মানুষের ভিড়ের সত্তায় আবেগের যে উৎসার তা সশ্রদ্ধ, প্রণত নয়। অমিয় চক্রবর্তীর লেখার পাশে অমল হোম জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ও কলকাতার রাস্তায় মানুষের ভিড়ের ছবি চিত্রতথ্য হিসেবে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। এই নাগরিক উদ্যাপনের পরেই ছিল শান্তিনিকেতনের শ্রাদ্ধ-বাসরের চিত্র ও বিবরণ। মণ্ডপে ক্ষিতিমোহন সেন বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। বসে আছেন বিধুশেখর শাস্ত্রী। ‘সম্মুখে শান্তি-পারাবার,/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’ গানে সেদিন শান্তিনিকেতন কবি-জীবনের ‘মর্ত্যের বন্ধনক্ষয়’ করেছিল। কবির জন্মের শহর আর কবির অর্জিত-সংস্কৃত শান্তিনিকেতন দু’য়ের আচরণের পার্থক্য সেদিন অসেতুসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রবীন্দ্রনাথের ষাট বছরের জন্মদিনে আশীর্বচনে বলেছিলেন, ‘আমাদের যাহা কিছু সুন্দর, যাহা কিছু সুরভি, তাহা তোমাতেই আছে।’ এই যে সুরভিত সুন্দর তাই দিয়েই কি শুধু রবীন্দ্রনাথকে দেখব আমরা? তাঁর সুন্দরকে তাঁর মঙ্গলবোধকে তো সবাই মেনে নিতে পারেননি। এই সংখ্যায় তাঁর যে কর্মপঞ্জি প্রকাশিত তাতে জানানো হয়েছিল পাশ্চাত্যের ন্যাশানালিজমের সমালোচক রবীন্দ্রনাথ কীভাবে নানা দেশে সমালোচিত হয়েছিলেন। ন্যাশানালিজম যে অসুন্দর ও অমঙ্গলের স্রষ্টা তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আয়োজনে বোঝা গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কথাগুলি বলছিলেন তখন তাঁর দূরদৃষ্টি সকলের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি। আইনস্টাইন, বার্নাড শ, রোম্যাঁ রোলাঁ, হেলেন কেলার এঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছবি এখন তো চাইলেই দেখা যায়– কিন্তু ১৯৪১-এ তো সুলভ ছিল না তা। যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?
তথ্য কি সত্যই স্তূপ? তা কি কেবলই চেপে ধরে মানুষটিকে? নাকি পাঠকের দিক থেকে আরেক রকম কথা উঠে পড়ে! এই যে অমল হোমের সম্পাদনায় নানা তথ্য নথিখানার মতো সাজিয়ে দেওয়া হল এখানে সেই নথিখানার মধ্যে আছে জানালা। তা খুলতে জানতে হয়। একালের কোনও পাঠক যিনি ধীরে ধীরে এই মূল্যবান সংখ্যাটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হয়তো থেমে যাবেন একটি ছবিতে। রামকৃষ্ণদেবের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন জটিল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সেই পরিসরে রামকৃষ্ণদেবের মরমিয়া ভক্তিধর্ম কি রবীন্দ্রনাথকে আরেক ভাবে পরমহংসের মূল্যায়নে নিয়োজিত করছে! আগে যে ভাবনা রবীন্দ্রনাথের ছিল তা আরেক রকম হয়ে উঠল! নথিখানার জানলা খুলতে খুলতে মনে হয় তথ্য শুধু তথ্য নয়– তথ্যের ঘরের জানলা খুলতে জানলে কত কিছু কত রকম করে যে ভাবা যেতে পারে!
……………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………….