অনুবাদ করব বলে ঘনঘন আমার মাতৃভূমি পুরুলিয়ায় যাতায়াত শুরু হল। কুড়মালি ভাষার বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠে জোর দিলাম। প্রচলিত গীত শুনতে থাকলাম। সাইকেলে, কখনও বাইকে ঘুরতে থাকলাম বিভিন্ন গ্রামে। এসব কর্মকাণ্ড চলেছে দু’-তিন বছর ধরে। চার বছর শেষে গীতাঞ্জলি অনুবাদের কাজ শেষ হল। শঙ্খবাবু আগেই জানিয়েছিলেন, পুরোটা অনুবাদ হলে একবার যেন তাঁকে দেখানো হয়। সেই অনুযায়ী তাঁর কাছে গেলাম পাণ্ডুলিপি নিয়ে।
‘গীতাঞ্জলি’ অনুবাদের কোনও পূর্ব পরিকল্পনা আমার ছিল না। তখন জেলায় কর্মরত। যে সংবাদপত্রে কাজ করতাম, তাদের নিয়ম রয়েছে তিন বছর অন্তর বদলি। বীরভূম থেকে বদলি হয়ে গেলাম বাঁকুড়া। শেষদিনে একগুচ্ছ বই উপহার পেলাম। মনে পড়ছে ‘আনন্দবাজার’-এর বোলপুরের প্রতিনিধি মহেন্দ্র জেনা আমায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ উপহার দিয়েছিল। রবীন্দ্রভূম থেকে রামকিঙ্করের দেশে গিয়ে বেশ কিছুদিন বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। কারণ কর্মসূত্রে বছর তিনেক থাকলেও বীরভূমের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। সিউড়ি শহরের প্রতিটি অলিগলি চিনে ফেলেছিলাম। তার সঙ্গে মানুষজনের আত্মীয়তা। বাঁকুড়ায় মনখারাপ নিয়ে থাকাকালীন হাতে উঠে এসেছিল ‘গীতাঞ্জলি’। আর সেই সময়ই গোটা চার-পাঁচেক কবিতা অনুবাদ করে ফেললাম কুড়মালিতে। মনখারাপ কেটে যেতেই ভেসে গেলাম কাজের জগতে। আর অনুবাদ নিয়ে বসা হয়নি। বছর দুয়েক বাঁকুড়ায় কাজের পর আবার বদলি। এবার চৈতন্যভূম নদিয়া। ভুলেই গিয়েছিলাম কুড়মালিতে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা কবিতা অনুবাদ করেছি। নদিয়ায় থাকাকালীন কলকাতায় যাতায়াত বেড়েছে। কবি গৌতম ঘোষদস্তিদার অনুবাদের কাজটা চালিয়ে যেতে বললেন। দুটো কবিতা নিয়ে রাখলেন তিনি শঙ্খ ঘোষের কাছে পাঠাবেন বলে। পরে গৌতমদা জানালেন, শঙ্খবাবুও নাকি বলেছেন অনুবাদটা চালিয়ে যেতে। কিন্তু চালিয়ে যেতে গিয়ে বুঝলাম, অনুবাদ কী দুরূহ কাজ! আমার পক্ষে সম্ভব নয়, বুঝলাম। দেখা হলেই গৌতমদা খোঁজ নিতেন, গীতাঞ্জলি কতদূর এগোল? আমি বলতাম, চলছে। কিন্তু আমার অনুবাদের কাজ এগোত না। এরই মাঝে কোনও একটা কাজে গিয়েছিলাম শঙ্খবাবুর বাড়িতে। তাঁর পরামর্শ নিলাম। ভাবানুবাদে জোর দিতে বললেন। জানতে চাইলাম, বাংলার বহু শব্দ কুড়মালিতে নেই। বাংলার মতো শব্দ ভাণ্ডার নেই কুড়মালিতে। সেক্ষেত্র কী করব? শঙ্খবাবু বললেন, কাছাকাছি শব্দের খোঁজ নিতে। দেখতে হবে ওই বাক্যের অর্থ ঠিক আছে কি না। কবি যা বলতে চেয়েছেন, তা অনুবাদ হওয়া কবিতায় থাকছে কি না। অর্থ পাল্টে গেলে চলবে না। কাজটা দ্রুত শেষ করে ফেলো।
এরপর ঘনঘন আমার মাতৃভূমি পুরুলিয়ায় যাতায়াত শুরু হল। কুড়মালি ভাষার বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠে জোর দিলাম। প্রচলিত গীত শুনতে থাকলাম। সাইকেলে, কখনও বাইকে ঘুরতে থাকলাম বিভিন্ন গ্রামে। এসব কর্মকাণ্ড চলেছে দু’-তিন বছর ধরে। চার বছর শেষে গীতাঞ্জলি অনুবাদের কাজ শেষ হল। শঙ্খবাবু আগেই জানিয়েছিলেন, পুরোটা অনুবাদ হলে একবার যেন তাঁকে দেখানো হয়। সেই অনুযায়ী তাঁর কাছে গেলাম পাণ্ডুলিপি নিয়ে। একটা আবদারও করেছিলাম, গ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিতে। তিনি সাগ্রহে রাজি হয়েছিলেন। এবং একমাস পাণ্ডুলিপিটি তিনি নিজের কাছে রেখেছিলেন। পরে ফেরত দেন। সঙ্গে ছিল তাঁর ভূমিকাটিও। এরই মাঝে চলে এল করোনা অতিমারী। সব ওলোট পালোট হয়ে গেল। ছাপাখানা, বইমেলা বন্ধ। গীতাঞ্জলির অনুবাদ গ্রন্থ ‘গিতেক নেহর’-এর প্রকাশকাল থমকে গেল। করোনাকালের মাঝেই শঙ্খবাবু চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমার সারা জীবনের আক্ষেপ, বই আকারে গিতেক নেহর-কে তিনি দেখে যেতে পারলেন না।
একথা অনস্বীকার্য, অনুবাদ ছাড়া কোনও ভাষারই সাহিত্য সমৃদ্ধ হয় না। কুড়মালি, সাঁওতালির ভাষার সাহিত্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুবাদ জরুরি। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলা সাহিত্য যেভাবে এগিয়েছে বা সমৃদ্ধশালী, কুড়মালি-সাঁওতালি সাহিত্য এখনও অনেকটাই পিছিয়ে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে এইসব আদি ভাষার সাহিত্যচর্চাকারীদের। আবার এই যুক্তিও তো ফেলে দেওয়া নয়, এই সব জনজাতিদের ভাষাকেও এককোণে ঠেলে রাখা হয়েছিল। অপাংক্তেয় ছিল। এখনও আছে। জনজাতিদের ভাষা চিরকাল উপেক্ষিত ও অবহেলিত। তাদের ভাষা ‘কুলীন’ ভাষা হয়ে ওঠেনি। সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলেছে এই তো মাত্র দুই দশক আগে (২০০৩ সালে)। স্বাধীনতার ৫৬ বছর পর একটি আদিবাসী ভাষার স্বীকৃতি! আর কুড়মালি ভাষাকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার স্বীকৃতি দিলেও, কেন্দ্র দেয়নি। স্বীকৃতির দাবিতে লড়াই, আন্দোলন চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার ঘটা করে বিরসা মুন্ডার জন্মদিন পালন করে। হেমন্তের আলগা শীতে রাঁচির উলিহাতু গ্রামে জন্মেছিলেন বিরসা। আদিবাসীদের বন আর ভূমির অধিকার যিনি জাগিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি বিরসা। বছর দুয়েক আগে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর জন্মদিনটিকে (১৫ নভেম্বর) ‘জনজাতি গৌরব দিবস’ হিসাবে উদযাপন করেছে। কিন্তু বিরসার মাতৃভাষা আজও উপেক্ষিত। বিরসা ছিলেন মুন্ডা সম্প্রদায়ের। তাঁর মাতৃভাষা মুন্ডারি। সেই ভাষাকে আজও কেন্দ্রীয় সরকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়নি। মুন্ডারি, সাঁওতালি, কড়া, কুড়মালি, টোটো, কোকবোরোক, কুই, খাসি, লেপচা, হো, গারো, গোন্ড, ভূমিজ-সহ ৪০টির বেশি জনজাতিদের ভাষা রয়েছে।
এই সব ভাষার সাহিত্যের অনুবাদ-চর্চা আজ খুবই জরুরি। দেশ, বিদেশের সাহিত্য জানুক এসব ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের। আর এসব ভাষার সাহিত্যও বাংলা বা দেশের অন্য ভাষায় অনূদিত হোক।