নিজেকে নিয়ত প্রস্তুত রাখা, টানটান রাখা, অনেক নখ-দাঁতের আঁচড় মনের দেওয়ালে পড়তে না দেওয়া, বলা ভাল, পড়তে না দেওয়ার চেষ্টা করা, সব থেকে বড় কথা ‘প্রসন্নতার শিক্ষা’, তা পাওয়া যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। গল্প-উপন্যাস তো বটেই, ওঁর দিনলিপি সেই সুদূরের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আজ, ১২ সেপ্টেম্বর, তাঁর জন্মদিন।
রবীন্দ্রনাথের লেখা পূজা পর্যায়ের একটি গানের শুরুর দু’টি লাইন মাঝে মাঝেই আমার কাছে আসে। অনেক গানের মতো এই গানটিও নিঃশব্দে জীবনের অংশ হয়ে গেছে।হয়তো চুপ করে বসে আছি, মাথার মধ্যে গানটি আপনমনে বাজছে:
‘লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই? দেখ্ রে চেয়ে আপন-পানে, পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই’
প্রথম লাইনের শেষে জিজ্ঞাসা চিহ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের অন্তরমহলের দিকে তাকিয়ে আত্মপ্রশ্ন। শ্রী, সৌন্দর্য, স্বপ্ন বা অন্য পৃথিবীর তরঙ্গ যে তোমার কাছে এসে ধরা দেবে, তার জন্য তোমার আধার কি তৈরি আছে? ঘরদোর যত্ন করে ধোয়ামোছা আছে তো?
এই যে নিজেকে নিয়ত প্রস্তুত রাখা, টানটান রাখা, অনেক নখ-দাঁতের আঁচড় মনের দেওয়ালে পড়তে না দেওয়া, বলা ভাল, পড়তে না দেওয়ার চেষ্টা করা, সব থেকে বড় কথা ‘প্রসন্নতার শিক্ষা’, তা পাওয়া যায় বিভূতিভূষণের কাছে। গল্প-উপন্যাস তো বটেই, ওঁর দিনলিপি সেই সুদূরের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।
বিভূতিভূষণের লেখায় মানুষের পাশাপাশি গাছপালা-নিসর্গ সমান গুরুত্বপূর্ণ। তুচ্ছতার ভিতরে যে গহন-আনন্দ, সামান্যকে ছুঁয়ে অসামান্য অনুভূতির দিকে চলে যাওয়ার যে বোধ, তা আমাকে আকর্ষণ করে। বিভূতিভূষণের সপ্রাণ দিনলিপির কাছে আমি বারে বারে তাই যাই। যেতে হয়।
আনন্দে পূর্ণ মানুষটি লিখেছেন, ‘কাল শেষরাত্রে তোমাকে হঠাৎ দেখলাম। অন্ধকার প্রহরের শেষ-রাত্রের চাঁদ– তার পাশ্ববর্তী শুকতারার পেছনে। তোমাকে প্রণাম করি।’
পরের অনুচ্ছেদে লেখা হচ্ছে,
‘বেলা পাঁচটা, ঠিক সন্ধ্যেটা হয়ে এসেছে, ছোট ছোট সেই অজানা রাঙা ফুলগাছগুলোর দিকে চেয়ে কেমন হঠাৎ আনন্দ এসে পৌঁছলো…’
মানুষটির কাছে আনন্দের ঢেউ এসে পৌঁছচ্ছে পথের পাশে ফুটে থাকা ভাল করে নজর না করলে চোখে পড়ে না এমন নামহীন ফুলের দিকে তাকিয়ে।
‘কেউ জানে না কত ভালোবাসি আমি আমার গ্রামকে– আমার ইছামতী নদীকে, আমার বাঁশবন, শেওড়া ঝোপ, সোঁদাফিফুল ছাতিমফুল বাবলা বনকে। সে ছায়া, সে স্নিগ্ধস্নেহ, আমার গ্রামের সে সব অপরাহ্ন– আমার জীবনের চিরসম্পদ হয়ে আছে যে।… তারাই যে আমার ঐশ্বর্য। অন্য ঐশ্বর্যকে তাদের কাছে যে তৃণের মত গণ্য করি।’
চিরজীবন এই ভালবাসাই তাঁর ভরকেন্দ্র ছিল।
মানুষের অপরিণামদর্শীতায় প্রকৃতির যে আমূল বদল, তাতে কত গাছপালা কত ঝোপজঙ্গল যে ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই, বিভূতিভূষণের লেখা মন দিয়ে খুঁজলে সেই লুপ্ত প্রকৃতির তাজা-স্পর্শ পাওয়া যায়। বিভূতিভূষণ একটু একটু করে সযত্নে ভালবাসার প্রকৃতি-বিজ্ঞান তৈরি করে রেখেছেন আমাদের জন্য।
আশ্চর্য এই নির্সগের ভিতরে ওঁর সময়ে সব মানুষ কি তাহলে স্থির, সুন্দর, সৎ ছিল? একেবারেই না। লিখছেন,
‘আমাদের গ্রামের প্রকৃতি অদ্ভুত, কিন্তু মানুষগুলো বড় খারাপ।পরস্পর ঝগড়া-দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা,পারিবারিক কলহ, জাতিবিরোধ, সন্দেহ, কুসংস্কার এতে একেবারে ডুবে আছে। লেখাপড়া বা সৎচর্চার বালাই নেই কারো।’
তার একটু পরেই অনুচ্ছেদ জুড়ে লিখছেন চালতেপোতার বাঁকে তিৎপল্লা, কলমী, নীল ঘাসের একরকম ছোট ছোট ফুলের কথা। মৃদু জ্যোৎস্নার স্তব করছেন। ফিরে যাচ্ছেন মালিন্যহীন চরাচরের গর্ভে। দিনলিপির পাতায় পাতায় মানুষকে ভালবাসার কথা লিখছেন।
‘পথের পাঁচালী’ লেখার সময়কার পরিশ্রমের কথা মনে পড়বে। একটি টেবিলে বসে ভোর ছ’টা থেকে বেলা পাঁচটি অবধি লিখে চলা মুখের কথা নয়।এই অমানুষিক পরিশ্রমে মাথা ঘুরে উঠলে ইডেন গার্ডেনে কেয়াঝোপের কাছে বসে মনে মনে সংশোধন-কাটাকুটি করছেন বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে লালফুল-ফোটা ঝিলটা ওঁকে এক ধরনের আন্তরিক স্নান দিচ্ছে।
২.
আজকাল ভোর ও সন্ধের দিকটাতে আমি একা থাকার চেষ্টা করি। একেবারে একা অবশ্য নয়, সাইকেল থাকে। কিছুক্ষণ সাইকেল চালিয়ে কোথাও একটা ঠেস দিয়ে রেখে হাঁটতে শুরু করি। কিছুই না, একটু নদীর ধারে গিয়ে বসলাম, অনেক দিন আগে যাওয়া গ্রামের রেললাইন বরাবর হেঁটে হেঁটে পুকুরগুলো দেখে বেড়ালাম, কাশফুল ফোটা শুরু হয়েছে, অল্প অল্প হিম পড়ছে, ভাদ্র কীভাবে আস্তে আস্তে আশ্বিনের দিকে চলেছে, ফাঁকা জায়গার হাওয়ায় যে গন্ধ ও ভরাট জায়গার হাওয়ার গন্ধ যে ভিন্ন, তা বোঝার ক্ষমতা একটু একটু করে বুঝতে পারি বিভূতিভূষণের লেখার কাছে এলে।
সন্ধে ও ভোরের এই লাবণ্য ভোগ করতে না পারলে মানুষের অনুভূতিগুলি ভোঁতা হয়ে যায়।মানুষ নষ্ট হয়ে যায়। নিজস্ব অলৌকিক আঁকশি শেষ হয়ে গেলে কীভাবে তখন যোগাযোগ হবে সুন্দরের সঙ্গে? বুঝতে হবে, নির্জনতা ও নিসর্গ আমাদের দু’হাত দিয়ে আগলে রেখে ফুরিয়ে যেতে দেয় না।
অনেক সময় আমি একটা মজার খেলা খেলি।আজকের তারিখের সঙ্গে বিভূতিভূষণের দিনলিপির তারিখ মিলিয়ে পড়ি।সবসময় তো মেলে না, কারণ সব তারিখের তো এন্ট্রি নেই।কিন্তু, মাঝে মাঝে আশ্চর্য ফল পাই এই ব্যক্তিগত খেলায়।
প্রায়শই দেখা যায় এমন বাক্য, ‘এমন আনন্দ সত্যিই অনেকদিন পাই নি’ অথবা ‘আজ খুব আনন্দ হল’।
আনন্দের উৎস খোঁজ করতে গেলে দেখা যাচ্ছে একটি ঢোলকলমি ফুল, আকাশের নক্ষত্র, নদীতে স্নানের মতো সামান্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়।
তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিজস্ব জীবনের দৈন্য। লেখা জল-আয়নার কাজ করে। বুঝতে পারা যায়, অকারণ-আনন্দ থেকে কত সরে এসেছে আমাদের যাপন।
ওঁর লেখায় টের পাওয়া যায়, জীবনে একটি বন্যঝোপের গুরুত্ব, একটি পোকারও ক্ষমতা রয়েছে অস্তমেঘের রং বদলানোর, আমাদের বেঁচে থাকার নকশা আমূল পালটে দেওয়ার। তখন বোঝা যায়, পাশের মানুষটিকে ভালবাসার মতো সৌন্দর্য আর কিছুতেই নেই।তখন মর্ত্যপৃথিবীর ধুলোমাখা জীবন একটু উপরে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।
যাঁর লেখায় এমন শীতলপাটি বিছানো, সেই বিচিত্র আনন্দময় মানুষটিকে সালাম জানাই।