কী আছে ‘অ্যানোরা’র স্টোরিলাইনে, যা এমন করে মথিত করে চলেছে দর্শকের মনন? মানছি এই ছবি কমেডি-রোমান্স গোত্রের। মানছি মিকি নবাগতা নন। তিনি তাঁর জাত আগেই চিনিয়েছেন কুইন্টিন ট্যারান্টিনোর ‘ওয়ান্স্ আপন আ টাইম ইন হলিউড’ ছবিতে সুসান অ্যাট্কিনস চরিত্রে। শুধুমাত্র বিনোদন, অভিনয়ের উচ্চতা, সম্পাদনা-দক্ষতা বা হুইপ প্যান শটের আধিক্য এই ছবিকে জনতার মননের আত্মীয় করে তোলেনি; জনতা পছন্দ করেছে এই ছবির বক্তব্য, বক্তব্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নাগরিক অসহায়তা, বলা ভালো রিডিং বিটুইন দ্য লাইনে প্রান্তিক মানুষের অসহায়তা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস আসে। চলেও যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস! তার কথা কে বলবে?
‘স্টার মেকার’, ‘সিন্ডারেলা স্টোরি’, ‘কমেডি ড্রামা’, ‘ইন্ডিভিজুয়াল ডিরেক্টার্স কাট’– শন বেকারের সাম্প্রতিক ছবি ‘অ্যানোরা’-র গায়ে স্বনামধন্য চলচ্চিত্র সমালোচকরা অকাতরে ঝুলিয়ে দিয়েছেন এমন অসংখ্য সপ্রশংস হ্যাসট্যাগ। বলা হচ্ছে, স্বাধীন পরিচালকের একটা অলিখিত স্টোরিলাইন সৃষ্টি করে চলেছেন শন!
২০০০ সালে ‘ফোর লেটার ওয়ার্ডস’ নিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতে পা-রাখা শনের সপ্তম ফিচার ছবি ‘অ্যানোরা’। ২০২৪ সালের মে মাসে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অ্যানোরা’ প্রদর্শিত হয় এবং পাম ডি’অর জিতে নেয়। তারপর ওই বছরেই অক্টোবর মাসে প্রেক্ষাগৃহে। চলছে শনের বিশ্ববিজয় গাথা। ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলারে নির্মিত ছবি এর মধ্যে ৪০ মিলিয়নের বেশি ব্যবসা করে ফেলেছে! এসেছে অস্কার স্বীকৃতি। পাঁচ-পাঁচটা অস্কার ‘অ্যানোরা’-র ঝুলিতে, যার মধ্যে শনের চারটে।
শন জিতেছেন সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিন-প্লে এবং সেরা সম্পাদনার পুরস্কার। একটা অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের আসরে একজন ব্যক্তির এটাই সর্বাধিক পুরস্কার জয়ের পরিসংখ্যান। সঙ্গে ‘অ্যানোরা’-র চরিত্রে অনবদ্য মিকি ম্যাডিসন জিতে নিয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর স্বীকৃতি। মানুষ নতুন করে দেখছেন ছবিটা। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রেন্টেড মুভি লিস্টে ‘অ্যানোরা’ এখন টপ-স্কোরার।
এই ছবি যে শন বা মিকিকে আগামীতে অনেক রমণীয় সুযোগ এনে দেবে– সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেটা বড় কথাও নয়, বড় কথা স্বীকৃতি। ছবির বক্তব্যকে স্বীকৃতি জানিয়েছে বোদ্ধামহল থেকে আমজনতা। ধারে-ভারে জাঁদরেল সব পুরস্কার আর বাণিজ্যিক সাফল্যের দ্বৈত পরিসংখ্যান সেকথা অবলীলায় বলছে। কিন্তু কী আছে এর স্টোরিলাইনে, যা এমন করে মথিত করে চলেছে দর্শকের মনন? মানছি এই ছবি কমেডি-রোমান্স গোত্রের। মানছি মিকি নবাগতা নন। তিনি তাঁর জাত আগেই চিনিয়েছেন কুইন্টিন ট্যারান্টিনোর ‘ওয়ান্স্ আপন আ টাইম ইন হলিউড’ ছবিতে সুসান অ্যাট্কিনস চরিত্রে। শুধুমাত্র বিনোদন, অভিনয়ের উচ্চতা, সম্পাদনা-দক্ষতা বা হুইপ প্যান শটের আধিক্য এই ছবিকে জনতার মননের আত্মীয় করে তোলেনি; জনতা পছন্দ করেছে এই ছবির বক্তব্য, বক্তব্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নাগরিক অসহায়তা, বলা ভালো রিডিং বিটুইন দ্য লাইনে প্রান্তিক মানুষের অসহায়তা।
…………………………………….
যৌনতার সঙ্গে শরীরী সুখের যোগ আছে, মানবিক সম্পর্কের যোগ আছে। কিন্তু খেলা! যৌনতার সঙ্গে খেলার যোগ! কতটা? এখানেই শন আমাদের চেপে ধরেন। দেখিয়ে দেন, বিত্তের পাহাড়ে চেপে থাকা মানুষগুলোর কাছে যৌনতা আসলে ‘খেলা’। নারীর শরীর আসলেই একটা ‘প্লেবল প্রোডাক্ট’। বানিয়া নেশা করে, গেম খেলে, সেক্স করে। প্লে-স্টেশনের রিমোট, না-হয় অ্যানির শরীর, আমেরিকায় পড়তে এসে এই তার ব্যস্ততার সীমারেখা!
…………………………………….
‘অ্যানোরা’ বা ‘অ্যানি’ ব্রুকলিনের এক যৌনকর্মী, যার নিজের নাম থেকে পেশা সবই অপছন্দের। কিন্তু এছাড়া আর কোনও পথ খোলা রাখেনি তার দুর্মূল্যের সমকাল। ব্রুকলিনের রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপের মিশ্র জনতার বসবাস তাকে স্বাভাবিক বহুভাষী করে তুলেছে। ইচ্ছে না-হলেও মিডটাউন ম্যানহাটনের ক্লাবে তাকে স্ট্রিপ নাচতে হয়। তার কাজে মেডিক্যাল ইনসিওরেন্স নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, ইনক্রিমেন্ট নেই, রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট নেই। গ্রাহককে খুশি করলে শুধু ‘টিপ’। এই তার অধিকার। এটাই তো অসংগঠিত শ্রমক্ষেত্রের বিশ্বচিত্র!
অ্যানি সেই শ্রমজীবী নারীমুখ, যাকে শন খুব যত্ন নিয়ে তাঁর দু’ঘণ্টা উনিশ মিনিটের জার্নিতে গড়ে তুলেছেন। সেখানে খাওয়ারও বিরতি নেই। ক্লায়েন্টের বয়স-রূপ-আর্থিক অবস্থা-বৈবাহিক পরিস্থিতি ইত্যাদি কিছু নিয়েই ভাবা বারণ। মুখে হাসি ঝুলিয়ে, নির্মেদ শরীরে বিভঙ্গ টেনে নিয়ে, একটুও সময় নষ্ট না-করে চটপট শরীর উন্মুক্ত করে গ্রাহকের মাদকতৃপ্তিকে পূর্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া তার কাজ। উপযুক্ত মজুরি পেলে সে দেবে প্রাইভেট সার্ভিসও। ঘড়ির কাঁটা ধরে নিজের শরীরের মাধুর্য চেটেপুটে ভোগ করতে দেবে গ্রাহককে। দ্রুত দক্ষতায় সে পুরুষকে করে দেবে নিঃস্ব, নীরস। একইসঙ্গে চূড়ান্ত তৃপ্তি ও আকস্মিক দ্রুততার অতৃপ্তি নিয়ে, একরাশ টাকা তার স্টকিংসে গুঁজে দিয়ে, নীল অন্ধকার হেড-কোয়ার্টার থেকে হলুদ আলোর ভদ্র দুনিয়ায় নির্বাসন নেবেন গ্রাহকরা।
ক্লাব-মালিক খুশি, ফলে অ্যানিকেও খুশি দেখাতে হয়। যৌনকর্মীদের মতো প্রান্তিক পেশার মানুষদের নিয়ে শন বারবার নিরীক্ষার রাস্তায় হেঁটেছেন চলচ্চিত্রের দরবারে। ‘ট্যানজারিন’-এর মতো স্ক্রুবল কমেডিতেও লস অ্যাঞ্জেলেসের রূপান্তরকামী যৌনকর্মীদের হৃদয় খুঁড়েছিলেন। একটা আইফোনের ক্যামেরাকে ভরসা করেই ছবিটা তৈরি করেছিলেন বেকার। এটাই তাঁর স্টাইল। বিগ হাউসের কর্তৃত্ব মানবেন না। কারণ তিনি প্রান্তিক পেশার মানুষগুলোর কথা দ্বিধাহীন বলতে চান। এবং তা বাজার অর্থনীতির বোদ্ধাদের খবরদারি না শুনেই।
ফিরে আসি অ্যানির গল্পে। তার হয়তো এভাবেই দিন চলে যেত। যেমন চলে যায় এই অন্ধকার-ছোঁয়া মানুষগুলোর। প্রেম হয় না, সুস্থ পরিবারে বিবাহ হয় না, ঘর হয় না, স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে সংসার হয় না– ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী’। সে কেবল এবং কেবলমাত্র ব্রুকলিনবাসিনী উর্বশী। ছবির গল্পকে এখান থেকেই এক গুরুতর খাতে প্রবাহিত করিয়ে দিয়েছেন চিত্রনাট্যকার-নির্দেশক শন বেকার। ক্লাব-মালিক জানালেন, অ্যানিকে এক স্পেশাল ক্লায়েন্টকে সার্ভিস দিতে হবে, যে কি না রুশভাষী। অ্যানি রুশ ভাষা জানে, তাকে রাজি হতে হয়। পর্দায় প্রবেশ ঘটে ইভান জ্যাকারভ ওরফে বানিয়া-র।
বলতে দ্বিধা নেই, এই চরিত্রে মার্ক আলেকজান্দ্রোভিচ আইডেলস্টাইনের অভিনয় আপনাকে হতবাক করে দেবে। অ্যানির জন্যে লেখা চিত্রনাট্যে শন এই ‘ইভান’ চরিত্রটার সঙ্গে বিন্দুমাত্র অবিচারের সম্ভাবনা রাখেননি। আর তা সম্ভব হয়েছে আইডেলস্টাইনের অভিনয়ের সুবাদে। ছবিতে সে রুশ অলিগার্ক নিকোলাই জাকারভের ছেলে। দেখতে বছর পনের-ষোলোর মতো হলেও সে জানিয়েছে সে ২১। ২৩-এর অ্যানির কাছে সে চেয়েছে যৌনতা। কেবল যৌনতা। অ্যানিকে সে এক সপ্তাহের জন্যে ভাড়া করেছে। ১৫,০০০ মার্কিন ডলারে চুক্তি। প্রতিটা ক্ষেত্রেই অ্যানি এমন একটা চুক্তি করে। এখন অ্যানি শিখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে দীর্ঘ সময় ধরে যৌনক্রীড়ায় অংশ নেওয়া যায়।
সমীক্ষা বলছে, ৮১% মহিলা যৌনতায় অর্গাজমের সুখ পায় না। অ্যানিদের সেটা ডেইলি রুটিন। কিন্তু সে যেন বিপরীত পথে হাঁটতে শুরু করেছে ইভানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে। এই জায়গাটায় এসে আমাদের থামতে হয়। যৌনতার সঙ্গে শরীরী সুখের যোগ আছে, মানবিক সম্পর্কের যোগ আছে, কিন্তু খেলা! যৌনতার সঙ্গে খেলার যোগ! কতটা? এখানেই শন আমাদের চেপে ধরেন। দেখিয়ে দেন, বিত্তের পাহাড়ে চেপে থাকা মানুষগুলোর কাছে যৌনতা আসলে ‘খেলা’। নারীর শরীর আসলে একটা ‘প্লেবল প্রোডাক্ট’। বানিয়া নেশা করে, গেম খেলে, সেক্স করে। প্লে-স্টেশনের রিমোট, না-হয় অ্যানির শরীর, আমেরিকায় পড়তে এসে এই তার ব্যস্ততার সীমারেখা! পিতৃদত্ত বিস্ময় অট্টালিকায় এরই মধ্যে তার সকাল রাত হয়, রাত হয় সকাল। ফ্লোর ম্যাট থেকে বাথ শাওয়ার, অ্যানির শরীর নিয়ে খেলতে খেলতেই বানিয়া প্রস্তাব দিয়েছে অ্যানিকে বিয়ে করার। যেমন সিদ্ধান্ত তেমনি কাজ, লাস ভেগাসে বিয়ে!
………………………………
আরও পড়ুন সুমন মজুমদার-এর লেখা: এ সিনেমা এক ক্ষমাহীন অপমানের, এক উদ্বাস্তুর, এক অপমানিতের
………………………………
কিন্তু এই খেলাঘর ভাঙতে সময় লাগেনি এক সপ্তাহও। লাস ভেগাসের বিদ্যুৎ বজ্রাহত করেছে রাশিয়ার জাকারভ পর্বতকে। তার প্রতিক্রিয়া আছড়ে পড়েছে আমেরিকায়। জাকারভদের পোষ্য ব্যাপটিস্ট টোরস আর তার সাগরেদরা নৃশংস ব্যস্ততায় লেগে পড়েছে এই বিয়ে ভাঙতে। স্পয়লারের মতো সেই ঘটনাক্রমে আমরা যেতে চাই না। কিন্তু এখানেই প্রকট হয়ে পড়ে অর্থের শক্তির কাছে কত অসহায় প্রান্তিক মানুষের সংবিধান-প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের মতো বিষয়গুলো। ইভানের মা গালিনা যেন সেই নগ্ন অর্থশক্তির ভাষ্য। বিয়ে-স্বামী-সংসারের সব স্বপ্ন তিনি কিনতে পারেন হাজার দশেক ডলারের বিনিময়ে। কোনও আইন সেই পথে বাধার প্রাচীর তুলে নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে অক্ষম। সেটা এমনকী আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশের নাগরিকের ক্ষেত্রেও। শেষ দৃশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে ইগরের সঙ্গে অ্যানির যৌনতার উদ্যোগ আর মাঝপথে কান্নায় ভেঙে পড়া– আমাদের বুকের টেন্ডনগুলো কোথাও যেন বেঁধেছেঁদে একাকার করে দেয়!
সত্যিই তো, অ্যানি নিজেও কি মানবিক সংযোগের এই পথটাকে কালের চক্রান্তে একটা প্রোডাক্টের মতো ব্যবহার করেনি? শনের ছবি প্রশ্ন তোলে, আর কি আলাদা কোনও পথ খোলা রেখেছে এই পণ্যায়িত সমাজ, ওই প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে? অস্কারের মঞ্চও কি সেই প্রশ্নটাকেই স্বীকৃতি দিয়ে গেল না?
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
শেষের দিকে তাঁর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন তাঁর মেয়ে শিষ্যরা—শান্তি হিরানন্দ, অঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়, রীতা গাঙ্গুলি। সকলেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন, বেগম আখতার তাঁদের মাতৃসম স্নেহে মুড়ে রেখেছিলেন। এ মাতৃত্ব তাঁর ওপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এ মাতৃত্ব তিনিই বেছে নিয়ে হতে পেরেছিলেন শিষ্যদের প্রিয় ‘আম্মি’।