Robbar

‘আই ওয়ান্ট টু টক’: যে নীরবতায় হৃদয়ের ডাক শোনা যায়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 24, 2025 8:09 pm
  • Updated:January 24, 2025 8:09 pm  

লার্জার-দ্যান-লাইফ স্পেকট্যাকলের যুগ এসেছে, ঝাঁ-চকচকে, মারকাটারি সিজিআইয়ের জয়জয়কার এখন। এই ধরনের ছবিগুলো জরুরি, তাছাড়াও, দক্ষিণ দেখাচ্ছে এই ওভার-দ্য-টপ বা এপিকধর্মী ছবির মধ্যে দিয়ে আরও বেশি দর্শকের কাছে সমাজচিত্র তুলে ধরা যায়। এই ছবিগুলো রমরমিয়ে চলুক, তাতে ইন্ডাস্ট্রির লাভ। এর পাশাপাশি ‘আই ওয়ান্ট টু টক’-এর মতো শান্ত শীতলপাটির মতো ছবিগুলিও থাক। যে নীরবতায় বুকের বাঁ-পাশে হৃদয়ের লাবডুব স্পষ্ট শোনা যায়, পারিপার্শ্বিক কোলাহল কমিয়ে সেই নীরবতাটি ফিল্মের পর্দায় তৈরি করতে পারেন সুজিত সরকার; তাঁর ছবি ফিল্মে, মানুষে আস্থা ফিরিয়ে দেয় আবার।

রণদীপ নস্কর

সুজিত সরকারের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোকে যদি কালানুক্রমিকভাবে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে তার মধ্যে একটা যাত্রাপথ পাওয়া যাবে– নাটকীয়তা ক্রমশ হ্রাস পাওয়ার যাত্রাপথ। ‘ভিকি ডোনার’ থেকে শুরু করে ‘মাদ্রাস ক্যাফে’, ‘পিকু’ হয়ে তিনি যখন ‘অক্টোবর’-এ এলেন, তখন ভারতের ফিল্ম-দুনিয়া জেনে ফেলেছে সুজিত সরকারের ছবি মানেই তা অসম্ভব নিচু তারে বাঁধা থাকবে। উচ্ছ্বাস-বিষাদ-ক্রোধ-অভিমান-বিরক্তি– সবই থাকবে সে-ছবিতে, কিন্তু তা আশ্চর্য রকমের পরিমিত। যেমনটা চারপাশে দেখা যায়, কালেভদ্রে দু’-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে বড়সড় নাটকীয়তাহীন পরিপার্শ্বে যেমন দস্তুর।

I Want To Talk box office collection day 1: Abhishek Bachchan starrer film starts slow with Rs 25 lakh on first day

কোন ছবি কখন তৈরি করব– এই বোধটা একজন পরিচালকের থাকা দরকার; কীভাবেই বা দর্শককে নিজের ছবির ভাষায় ধাতস্থ করব, জানা দরকার তা-ও। সুজিত সরকারের সেই বোধটা সাংঘাতিক রকমের সজাগ। কেরিয়ারের গোড়ার দিকেই যদি তিনি ঘটনার ঘনঘটাবিহীন একটা ‘অক্টোবর’ বানাতেন, বা তৈরি করতেন একটা ‘গুলাবো সিতাবো’, তাহলে তা বক্স-অফিস, সমালোচক-মহল দু’-জায়গাতেই মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল ষোলোআনা, কিন্তু তিনি সে-পথে হাঁটার বান্দাই নন। মানুষ প্রথমে দেখল ‘ভিকি ডোনার’-এর মতো একটা সোশাল ড্রামা, কিন্তু বলিউডি নাটকীয়তার মশলা মাখানো নয় সে-ছবি। তারপর এল ‘মাদ্রাস ক্যাফে’, অত্যন্ত উত্তপ্ত এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সে-ছবি গড়ে উঠলেও, তা ভারতীয় অ্যাকশন ছবির মতো ওভার-দ্য-টপ নয়। ‘পিকু’-তে এক খিটখিটে বাবা এবং খেঁকুরে মেয়ের সম্পর্কের টানাপড়েন, সেই আবর্তে আটকে পড়া এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় ড্রাইভার– এই গল্পই মুগ্ধ হয়ে দেখল গোটা দেশ।

Piku - Movies on Google Play
‘পিকু’র দৃশ্যে অমিতাভ বচ্চন, দীপিকা পাড়ুকোন ও ইরফান খান

এর পর এল ‘অক্টোবর’। প্রেমের উচ্চকিত প্রকাশ নেই, সোচ্চারে ঢক্কানিনাদ পিটিয়ে প্রেম-নিবেদন করা নেই; বরং, সমর্পণ আছে। প্রতীক্ষা আছে। একটা পথের শেষপ্রান্তে পৌঁছে আরেক চড়াই বেছে নেওয়া আছে। ‘গুলাবো সিতাবো’-তে শপিং মলের উত্থানের সামনে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসা মুদি-দোকানের কর্মচারীর হতাশ হয়ে প্রেমিকাকে চলে যেতে দেখা আছে। প্রাপ্তির একটি ঝুলি পূর্ণ হলে তার পাশে শূন্যতার এসে দাঁড়ানো আছে। আবার, সমস্ত কিছু ধ্বসে পড়ার পর আঁকড়ে ধরার খড়কুটোও আছে। চারপাশে যে-সমস্ত চরিত্র ঘুরে বেড়ায়– ভিড়ে মিশে যাওয়া চেহারা, নেহাতই গতে-বাঁধা জীবন কাটানো সেই মানুষগুলোর অলক্ষিত রক্তক্ষরণ, অনুচ্চকিত হর্ষ-বিষাদ সযত্নে পর্দায় বুনে দিয়েছেন সুজিত সরকার। তাঁর ছবি ক্রমশ উঁকি মারতে পেরেছে চরিত্রের হৃদয়ের গহীনতম কোণগুলিতে– খিটখিটেমি, আলসেমি, ক্লান্ত হাসির ভিড়ে যে হৃদয় প্রায়শই ঢাকা পড়ে যায়।

October movie review: Critics, celebs get blown away by its 'fragrance' - IBTimes India
সুজিত সরকার পরিচালিত ‘অক্টোবর’

‘আই ওয়ান্ট টু টক’-ও ব্যতিক্রম নয়। এ-ছবি সফল, ধনী ব্যবসায়ী অর্জুন সেনের জীবন-সংগ্রামের গল্প বললেও, আসলে ছবিটি তার গোটা রানটাইম জুড়ে অর্জুনের গা থেকে অর্থ-যশ-প্রতিপত্তির পরতগুলি খুলতে খুলতে গেছে; এই সমাজ-নির্ধারিত সাফল্যের মানদণ্ডগুলি সন্তর্পণে পার করে আবিষ্কার করতে চেয়েছে রক্ত-মাংসের অর্জুনের হৃদয়। তার সারা শরীরে অস্ত্রোপচারের নির্দয় দাগ, তার কণ্ঠস্বর ক্রমশ ফ্যাঁসফেঁসে হয়ে আসে; তবু, অর্জুন নাছোড়, দৌড়ে যেতে দৃঢ়সংকল্প।

এই ছবিটা দেখতে দেখতে একটা অদ্ভুত কথা মনে পড়ছিল। আসলে, ‘পিকু’-র বৃত্তই যেন সম্পূর্ণ হল ‘আই ওয়ান্ট টু টক’-এ। ছবির নাম ‘আই ওয়ান্ট টু টক’– এ যে বাবা নয়, প্রকৃতপ্রস্তাবে মেয়ের বাসনা, তা বুঝতে বুঝতে অবশ্য ছবিটি শেষ হয়ে আসবে। গোটা ছবিটা আমরা শুনতে পাই অর্জুন সেনের বয়ানে, একমাত্র শেষের ১০-১৫ মিনিট বাবার কথা বলার ব্যাটন হাতে তুলে নেয় রেয়া– অর্জুন সেনের কন্যা। এত এত কথার ভিড়ে, অবান্তর, অপ্রয়োজনীয়, অপ্রতিরোধ্য কথার স্রোতে আসলে যে কত কথাই বলা হয়ে উঠল না! সেইসব অকথিত অনুভূতি একদিন বাবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যাবে, এই মর্মে বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় রেয়া।

‘পিকু’ ছবিতে ভাস্কর আর পিকু সচরাচর কথা বললে তা অচিরেই ‘কেওস’-এ পর্যবসিত হত, কিন্তু তাদের মধ্যে আদপে যে কতখানি নিবিড় নৈকট্য রয়ে গেছে, তা বোঝা যায় ভাস্করের মৃত্যুদৃশ্যে। কোনও উচ্চকিত বিলাপ নেই, ডুকরে ওঠা নেই; পিকু বাবার নাকের কাছে হাত রেখে বোঝে, আর শ্বাস পড়ছে না। তারপর বাবার কাছে চুপ করে বসে পড়ে। নেপথ্যে মৃদু বাজছে সরোদের থিম, ক্যামেরা ক্লোজ-আপে ভাস্করের চশমা, গীতবিতান– এই ব্যবহার্য জিনিসগুলো দেখায়। আসলে তো মানুষের প্রয়াণে স্মৃতিই আমাদের পীড়া দেয়, আর স্পর্শের মতো স্মৃতি কী-ই বা আছে আর! দর্শক বোঝে, পিকু আর ভাস্করের মধ্যে এক সমুদ্র ব্যবধান থেকে গেল, যদি কোনও দিন তাদের মধ্যে আবার কথা হয়, তাদের একে অপরকে অনেক কিছু বলার থাকবে নিশ্চিত।

আবার পিতা-কন্যা সম্পর্ক ফিরে আসে ‘আই ওয়ান্ট টু টক’-এ। অর্জুন সেন বাবা হিসেবে পরিবারকে তেমন সময় দিতে পারেন না, ভাবেন, বস্তুগত জিনিস দিয়েই মন জয় করে রাখা যায় কাছের মানুষদের। কিন্তু, যখন হাসপাতাল নিয়মিত গন্তব্য হয়ে ওঠে, যখন ডাক্তাররা দিনসীমা বেঁধে দেন– তখন অর্জুনের সঙ্গে তার কন্যার একটা নৈকট্য গড়ে ওঠে। অর্জুনের ভাবনার একমাত্র বিষয় হয়ে ওঠে, মেয়ের ঘনিষ্ঠতার বৃত্ত থেকে সে কোনও দিন দূরে সরে যাবে না তো?

‘আই ওয়ান্ট টু টক’-এ অর্জুন সেনের চরিত্রে অভিষেক বচ্চন

এই যে এক খুঁতখুঁতে, কন্ট্রোল-ফ্রিক বাবার সঙ্গে অন্য প্রজন্মের, পায়ের বেড়ি বাঁধতে যাওয়া মেয়ের কলহ– তা কখনওই কেওসে পর্যবসিত হয় না, কারণ, মৃত্যু এখানে আসে না। মৃত্যুর সম্ভাবনা এই ছবিতে আসে একটা রিমাইন্ডার হিসেবে– প্রিয়জনের সঙ্গে দূরত্ব মিটিয়ে নেওয়ার, একটু ফুরসত বার করে জীবনটুকু বেঁচে নেওয়ার রিমাইন্ডার।

সুবোধকাকা এবং ন্যান্সি– এই দুয়ের মৃত্যুও অর্জুনের কাছে একটা রিমাইন্ডার হয়ে থাকে। তার বাকি পথটুকু চলার পাথেয় হয়ে থাকে। ন্যান্সি মারা যাচ্ছে তার যন্ত্রণার কথা একটাও মানুষকে বলতে না পেরে, নিজেকে এতটাই অপাংক্তেয় ভেবে সে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে– এই শোক অর্জুনকেও ফালাফালা করে দেয়। অতএব, ‘আই ওয়ান্ট টু টক’– এই নাম আরও বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। পাশের মানুষটার সঙ্গে যদি কথাই না বলতে পারি, কেবলই কথা বলতে চাইছি বলে শব্দ উচ্চারণ করে চলেছি কি না বুঝতে না পারি– তাহলে আর কিসেরই বা অর্থ-যশ-সামাজিক প্রতিপত্তি-পদোন্নতি!

‘পিকু’-তে যে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়নি, সেই কাহিনি অবশেষে পূর্ণতা পাচ্ছে ‘আই ওয়ান্ট টু টক’-এ অর্জুন এবং তার কন্যা রেয়ার বাকি জীবনের পথ চলাটুকুর মধ্যে দিয়ে– এমন সম্ভাবনা রেখে দেন সুজিত সরকার। এ-এক আশ্চর্য সমাপতন!

সমস্ত কোলাহলের বিপ্রতীপে এই ছবির দৃশ্য-শব্দও বড় অনু্চ্চকিত। ‘অক্টোবর’, ‘গুলাবো সিতাবো’-র মতো এই ছবিতেও একেকটা দৃশ্য বুকে এসে ধাক্কা মারে। যেমন, বাগানের একটা বেঞ্চে বসে সুবোধ আর অর্জুন কথাবার্তা বলছিলেন, সেই দৃশ্যটা এই ছবির ক্যামেরা দেখায় ঘরের ভেতর থেকে– কাচের জানালার দু’টি পাল্লার একটিতে দেখা যাচ্ছে সুবোধের মুখ, আরেকটিতে অর্জুনের অবয়ব। কিন্তু সুবোধকাকা মারা যাওয়ার পর ক্যামেরা আবারও ওই শটেই ফিরে আসে, বাগানে নিশ্চুপ বসে আছেন অর্জুন সেন, তাঁকে দেখা যাচ্ছে জানালার একটি পাল্লায়; কিন্তু, পাশের পাল্লাটি ফাঁকা। সুবোধকাকার মৃত্যুজনিত শূন্যতাটি দর্শকের অপ্রস্তুত হৃদয়ে আকস্মিক ধাক্কা মারে। যেন, বালিতে আছড়ে পড়ল বিষাদের বিপুল এক তরঙ্গ। আবার, যখন হ্রদের ধারে মেয়ে বাবাকে বলে, ‘আমি মায়ের মতো নই বুঝলে, মায়েরই প্রতিলিপি। ভুলছ কেন, আমার সঙ্গে তোমার থেকে মায়ের মিল বেশি?’ তখন ক্যামেরা একটা ওয়াইড শটে যায়, ফ্রেমটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ডানপাশে বসে আছেন অর্জুন সেন, মাঝে কন্যা রেয়া আর ফ্রেমের বাঁদিকে একটা তরতাজা, সবুজ গাছ। যেন, মা আছেন ঠিক এই দুয়ের সঙ্গে– গাছের ছায়ার মতো।

মনে পড়ে ‘অক্টোবর’-এর কথা। যার সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন হল সামাজিকভাবে ডিভোর্স পেপারের মাধ্যমে, সে চলে গেলেও রয়ে গেল তার স্মৃতি একটা গাছ হয়ে। তার পাতা এসে গায়ে পড়লে মনে হয় সে ক্লান্ত মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ন্যান্সির মৃত্যুর পর হ্রদের ধারে পেলব গোলাপি আলোয় অর্জুনের ছল-ছল চোখ দেখে বুকটা মুচড়ে ওঠে। গোটা ছবি জুড়ে ফল্গুস্রোতের মতো ভেসে বেড়ায়, উড়ে আসে পিয়ানোর সুর; চাপা ফিসফিসানির মতো গান। অনুভূতির কী এক অন্তঃসলিলা বয়ে চলে ছবি জুড়ে।

লার্জার-দ্যান-লাইফ স্পেকট্যাকলের যুগ এসেছে, ঝাঁ-চকচকে, মারকাটারি সিজিআইয়ের জয়জয়কার এখন। এই ধরনের ছবিগুলো জরুরি, তাছাড়াও, দক্ষিণ দেখাচ্ছে এই ওভার-দ্য-টপ বা এপিকধর্মী ছবির মধ্যে দিয়ে আরও বেশি দর্শকের কাছে সমাজচিত্র তুলে ধরা যায়। এই ছবিগুলো রমরমিয়ে চলুক, তাতে ইন্ডাস্ট্রির লাভ। এর পাশাপাশি ‘আই ওয়ান্ট টু টক’-এর মতো শান্ত শীতলপাটির মতো ছবিগুলিও থাক। যে নীরবতায় বুকের বাঁ-পাশে হৃদয়ের লাবডুব স্পষ্ট শোনা যায়, পারিপার্শ্বিক কোলাহল কমিয়ে সেই নীরবতাটি ফিল্মের পর্দায় তৈরি করতে পারেন সুজিত সরকার; তাঁর ছবি ফিল্মে, মানুষে আস্থা ফিরিয়ে দেয় আবার।

সুজিত সরকার, আপনি ফিল্মের মাধ্যমে আরও, আরও, আরও কথা বলুন।

………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………