Robbar

দিশেহারা কলকাতা শহরের এক বিধ্বস্ত এপিটাফ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 12, 2025 10:06 pm
  • Updated:February 13, 2025 7:14 pm  

শুরু হয় একটা জ্বলন্ত চিতার দৃশ্য দিয়ে, এলা আর শিশিরের একমাত্র মেয়ের মৃত্যুকে সঙ্গে করে, এই কলকাতা শহরের সব মায়া, পিছুটান, স্মৃতিকে চিতার আগুনে রুটির মতো সেঁকে নিয়ে কথক ঠাকুর তাঁর গল্প বলা শুরু করেন। ধীরে ধীরে গল্পে ঢুকে পড়ে একজোড়া উদয়াস্ত খেটে খাওয়া ছেলেমেয়ে, যারা ধ্বংস হয়ে যাওয়া কলকাতার ওপর নিজেদের নড়বড়ে সংসার গড়ে তুলতে চায়, এই মৃতপ্রায় শহরের বুকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় খিলখিল ভালোবাসাদের। কিন্তু ‘মহানগর’ বা ‘মর্ডান টাইমস্’ কিংবা সাম্প্রতিক ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সিনেমাতেও আমরা যেমন দেখি, শহুরে জীবনের এত কিছু ভাঙাচোরার পরেও ভালোবাসার মানুষ দু’জন একে অপরের হাত ছেড়ে দেয় না, তারা স্বপ্নের ওপর বিশ্বাস রাখে, মায়ানগরের পরিচালক সে পথে হাঁটেন না।

নিলয় সমীরণ নন্দী

গালিব বলেছিল, সারা ব্রহ্মাণ্ডে খুঁজলেও ‘কলকাত্তা’-র মতো একটা শহর আর তুমি কোত্থাও পাবে না, এই শহরের কথা উঠলেই একটা তীর এসে যেন বুকে লাগে, এখানকার বাঙালিরা অদ্ভুতভাবে ১০০ বছর আগে এবং ১০০ বছর পরে একইসঙ্গে বাঁচে। ‘কলিকাতা’ থেকে ‘ক্যালকাটা’ থেকে আজকের ‘কলকাতা’ হয়ে ওঠার নেপথ্যের গল্পটাতে আমরা অনেক কিছু হারিয়ে ফেললেও, এই ১০০ বছর আগে এবং ১০০ বছর পরে একইসঙ্গে বাঁচার ম্যাজিকটা, এখনও এই শহর, আমরা, কীভাবে যেন ধরে রাখতে পেরেছি। আদিত্য বিক্রম তাঁর নতুন সিনেমা ‘মায়ানগর’ জুড়ে একটু একটু করে যেন সেই কথাটাই ‘আলোকেরই ঝর্নাধারা’-র লাল-নীল, হলুদ-সবুজ, সাদা-কালো, সোনালি-রুপালি, এই সকল সুতো দিয়ে সূক্ষ্মভাবে বুনে গিয়েছেন। পরিচালকের আগের দুটো সিনেমার চলন এবং গল্প এই সিনেমায় এসে একটা নির্দিষ্ট বাঁক নিয়েছে। প্রথম সিনেমায় দেখা ধীর লয়ের শহর এবং দ্বিতীয় সিনেমার বিমূর্ত নগর, এইখানে এসে হাত ধরাধরি করে রূপকথা হয়ে উঠছে, যেখানে গল্পের শেষে ভিলেনরা শাস্তি পায়, নায়িকা ফিরে আসে নায়কের কাছে। সে ফেরা হয়তো সুখের নয়, অনেকটাই বাধ্য হয়ে, তবু তাতে মায়া থাকে, পুরনো অভ্যাস থাকে।

সিনেমা শুরু হয় একটা জ্বলন্ত চিতার দৃশ্য দিয়ে, এলা আর শিশিরের একমাত্র মেয়ের মৃত্যুকে সঙ্গে করে, এই কলকাতা শহরের সব মায়া, পিছুটান, স্মৃতিকে চিতার আগুনে রুটির মতো সেঁকে নিয়ে কথক ঠাকুর তাঁর গল্প বলা শুরু করেন। ধীরে ধীরে গল্পে ঢুকে পড়ে একজোড়া উদয়াস্ত খেটে খাওয়া ছেলেমেয়ে, যারা ধ্বংস হয়ে যাওয়া কলকাতার ওপর নিজেদের নড়বড়ে সংসার গড়ে তুলতে চায়, এই মৃতপ্রায় শহরের বুকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় খিলখিল ভালোবাসাদের। কিন্তু ‘মহানগর’ বা ‘মর্ডান টাইমস্’ কিংবা সাম্প্রতিক ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সিনেমাতেও আমরা যেমন দেখি, শহুরে জীবনের এত কিছু ভাঙাচোরার পরেও ভালোবাসার মানুষ দু’জন একে অপরের হাত ছেড়ে দেয় না, তারা স্বপ্নের ওপর বিশ্বাস রাখে, মায়ানগরের পরিচালক সে পথে হাঁটেন না। তিনি শুরু থেকে যে বিষাদময় শহরের ইতিকথা লিখতে শুরু করেছিলেন, যেখানে এক আধ পাগল সৎ ভাই বুবুদা একটা মৃত থিয়েটার হল আঁকড়ে পড়ে থাকে, যেখানে থরে থরে সাজানো সাদা সাদা রবীন্দ্রনাথ শুধু নিষ্পলক মূর্তি হয়েই রয়ে যায়, যেখানে এক আদিম অতিকায় প্রাণী ডায়নোসরকেও শহরের বুক থেকে উপড়ে ফেলা হয়, সেখানে পরিচালক একজোড়া নতুন প্রেমিক-প্রেমিকাকে শেষমেশ আর জিতিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারেন না।

Mayanagar Review | Aditya Vikram Sengupta paints a picture of a city in a flux - Telegraph India

‘মায়ানগর’ দেখতে দেখতে যে দু’টি সিনেমার কথা বারবার মনে আসতে বাধ্য, তা হল এক ‘ইন্টারভিউ’ এবং দুই “বো ব্যারাকস ফরএভার’’। এই দুটো সিনেমাতেই দুটো আলাদা আলাদা সময়ে যেভাবে কলকাতার গতিময়তা উঠে এসেছে, তা এই সিনেমায় অনুপস্থিত, বরং এই সিনেমায় পরিচালক দিশেহারা কলকাতা শহরের এক বিধ্বস্ত এপিটাফ রচনা করেছেন। ফলে যখন এই সিনেমায় আমরা আমনতকারীদের একটা বিক্ষোভ দৃশ্যকে দেখি ট্রলি শটে খুব কাছ থেকে, খুব জরুরি একজন চরিত্রের মুখের ওপর গিয়ে শটটি শেষ হয়, তখন মনটা একটু অতৃপ্তিতে ভরে যায়। যেখানে সারা সিনেমা জুড়ে বিভিন্ন ওয়াইড শটে সারা কলকাতার ক্লান্তি আর শ্রান্তি দেখতে থাকি, সেখানে এই দৃশ্যের এমন ট্রিটমেন্ট মনটাকে একটু খারাপই করে দেয়, দৃশ্যটি বেলা টারের ‘প্রোলগ’ হয়ে উঠতে উঠতেও হয় না। আবার যখন নতুন হাইরাইজের সামনে দিয়ে একপাল গরুর পাল ধুলো উড়িয়ে চলে যায়, তখন পরিচালক একজন কবির মতোই এই ছন্নছাড়া শহরটার পাশে এসে যেন দু’-দণ্ড বসেন।

Mayanagar (2025) - Movie | Reviews, Cast & Release Date in vapi- BookMyShow

এই সিনেমার চিত্রগ্রাহক তুরস্কের গোখান তিরিয়াকি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালক নুরি বিলজে সেইলানের সঙ্গে কাজ করেছেন। ‘ওয়ান্স আপনে টাইম ইন এনাটোলিয়া’ সিনেমাটির চিত্রগ্রাহকও তিনি। ফলে ‘ওয়ান্স আপনে টাইম ইন ক্যালকাটা’ সিনেমায় উনি আলো-আঁধারিতে যেভাবে কলকাতাকে দেখেন, যে রঙে কলকাতা তার কাছে ধরা দেয়, তাতে এক চেনা বিষাদ থাকে, শহরের একটা সোঁদা গন্ধ আর অসম্পূর্ণতা তাঁর লেন্সে সহজেই ধরা পড়ে যায়। তবে সবচেয়ে বুকে এসে বাজে, যখন আমরা দেখি এলা তার বসের সঙ্গে নির্জন হোটেলে দেখা করতে যায় আর উল্টোদিকে শিশিরের কুকুরের সঙ্গে বেবিদা আরেকটা কুকুরকে ব্রিড করাতে নিয়ে আসে। এই দৃশ্যে ক্যামেরার চলন, শব্দ, আবহসংগীত, সব মিলেমিশে দর্শকের ঘেঁটি ধরে নাড়িয়ে দেয়। আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতার সামনে পরিচালক যেন একটা আয়না নিয়ে দাঁড়ান। ছবির শেষে মৃত ক্যাবারে ডান্সারের মেয়ে এক টুকরো আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে, বিভিন্ন ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে যখন সেই থিয়েটার হলে তার মায়ের ছবির সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন আবার গালিবের সেই বলা ১০০ বছর আগে পরের কথাগুলোকেই পরিচালক সত্যি করে দেন।

ছবির নির্মাণশৈলীতে ইউরোপীয় ঘরানার ছাপ স্পষ্ট থাকলেও, তাতে করে এই গল্পে কলকাতাকে খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। আমরা দু’জনের কথোপকথনের দৃশ্যে প্রথামাফিক প্রায়শই দু’জনের একজনের রিয়াকশন বা ডায়লগ দেখতে পাই না, তার ফলে বড় পর্দা জুড়ে একটা সচেতন অস্বস্তির সৃষ্টি করেন পরিচালক। ব্রিজ ভেঙে পড়ার দৃশ্যটির ট্রিটমেন্ট নিয়ে এখানে বিশেষভাবে বলতেই হয়, পরিচালক এখানে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিগুলোকে যেভাবে ফিরিয়ে আনেন, তা রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেয়।

Mayanagar (Once Upon A Time In Calcutta) Official Trailer

এই সিনেমাটি শ্রীলেখা মিত্রের সিনেমা, ফলে তাঁকে নিয়ে যা কিছুই বলা হবে, কম বলা হবে। সারা সিনেমা জুড়ে আমরা যাকে দেখি, তাকে বা তাদেরকে আমি আমার উত্তর কলকাতার দীর্ঘ ১৪ বছরের মেস-জীবনে প্রতিদিন দেখেছি। এলার চলা, বলা, খাওয়া, ঘুমানো, স্নান করা– সব কিছুর মধ্য দিয়েই শ্রীলেখা এক ভবিষ্যৎহীন, থেমে যাওয়া, ক্লান্ত এই কলকাতার আত্মা হয়ে উঠেছেন যেন। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ভাস্করের চরিত্রে অরিন্দম ঘোষ এবং রাজার চরিত্রে সায়ক রায়।

আলাদা করে বলতে গেলে, সেই ‘স্থানীয় সংবাদ’ সিনেমার পর বুবুদার চরিত্রে ব্রাত্য বসু আবার চমকে দিয়েছেন। তাঁকে আরও বেশি বেশি করে বড় পর্দায় দেখার ইচ্ছে রইল। এছাড়াও আরও দু’জনের কথা বলতেই হয়, এক হল কল্পতরুর মালিক প্রদীপ্ত-র চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী এবং পিঙ্কির চরিত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী রিকিতা নন্দিনী শিমু। দু’জনেই বুঝিয়ে দেন চরিত্র কখনওই ছোট-বড় হয় না, ভালো অভিনেতার গুণে চরিত্ররা ঠিক দর্শকের মনে জায়গা করে নেবেই।

সবশেষে বলব, বাংলা সিনেমা বাংলা সিনেমার মতোই হবে, তাকে মালায়লি, ইরানি বা হলিউডের মতো হতে হবে না, সে যেমন একটু একটু করে তার নিজের মতো করে মন্থর গতিতে পথ চলছে চলুক, তাতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই, যতদিন আদিত্য বিক্রমের মতো হাতেগোনা কয়েকজন পরিচালক এখনও আছেন, ততদিন চিন্তা নেই।

……………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………..