Robbar

‘জোরাম’ আসলে দাসরুর সেই ব্যর্থ বিপ্লব, যে বিপ্লবকে ছবিজুড়ে সে বয়ে বেড়াচ্ছে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 9, 2024 8:33 pm
  • Updated:February 10, 2024 7:59 pm  

দাসরু গ্রামে ফিরে এসে যখন মৃত শালগাছের শরীরে সন্তানস্নেহে হাত বোলায়, যখন লুকিয়ে বাজারে যায়, আর পুরনো কমরেডকে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যামসন! আমাদের কম্যান্ডার কোথায়?’ গায়ে কাঁটা দেয়। মনে পড়ে নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস: ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’। মনে পড়ে, একদিন রাতে মেন্টাল অ্যাসাইলাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিল রণজয়— সাতের দশকের একজন নকশাল। বর্তমানে উন্মাদ। বিপ্লবের ভূত ধাওয়া করে অবিরত। সেদিন রাতে রণজয়, দাসরুর মতোই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সুশীল, আমাদের রাইফেলগুলো কোথায়?’

রোদ্দুর মিত্র

‘‘আমরা যখন শান্ত আছি, তোমরা তখন বলো:
‘শান্ত থেকো বাবা’–
সে ধ্বনিতে কাঁপতে থাকি, ভাবতে থাকি ভয়ে
আছে কোথাও থাবা।

কেউ-বা তখন পালাই দূরে, কেউ-বা ঘরে ঘরে
অস্ত্র করি জড়ো
যে-অশান্তি ছিলই না সেই অশান্তিরও বীজ
এমনি রোপণ করো…’’

অতএব, সে পালাচ্ছে। গরিব। সংখ্যালঘু। কিংবা ক্ষমতাহীন। পালিয়ে বেড়ানোই যেন নিয়তি। থিতু হচ্ছে না কোথাও। থিতু হতে দিচ্ছে না রাষ্ট্র। ধাওয়া করছে। এমন প্রেক্ষিতে ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’ ছবিটির কথা যদি প্রথমে না বলি, মস্ত পাপ হয়। ছবির প্রথম দৃশ্যে– ‘জিউ হান্টার’ কর্ণেল হান্স লান্ডা, হত্যা করেছে একটি ইহুদি পরিবারকে। মৃত্যু এড়িয়ে কেবল সোশানা, বাড়ির বড় মেয়েটি, পালিয়ে যাচ্ছে। সোশানার শরীরে প্রিয়জনেদের রক্ত। এরপর, হান্স লান্ডার বিখ্যাত সংলাপ– ‘Au revoir, Shosanna!’ অর্থ হয়, ‘আবার দেখা হবে সোশানা!’

Ashima Avasthi on LinkedIn: 'Joram', our next film from Zee ...

তাই, দেখা হয়েই যায়। হতে বাধ্য। রাষ্ট্র খুঁজে নেবে সোশানাকে। চাইবে হত্যা করতে। যেমন চেয়েছিল দাসরুকে। দাসরু একজন আদিবাসী। ঝাড়খণ্ডের ঝিনপিড়ি গ্রামের সনাতন গরিব মানুষ। আছে বলতে কৃষিজমি। অরণ্য। শ্রেণিশৃঙ্খল। একটা গানের সুর।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

দেবাশিস মাখিজার ‘ভোঁসলে’, ‘আজ্জি’-র মতো দুরন্ত ছবি পেরিয়ে এখানে বলা যাক তাঁর একটি শর্ট-ফিল্মের কথা। নাম ‘আগলি বার’। সাত মিনিটের ছবি। যেখানে স্পষ্ট হচ্ছে, একটি চরিত্র জাস্ট খুন করে দিয়েছে দুই মুসলিমকে। কপালে গেরুয়া তিলক। পরবর্তী টার্গেট— আপনি! ছবিটা এখানেই শেষ। এও তো এক ভারতের নির্মাণ— দারুণ অ্যাকশান-সমৃদ্ধ স্পাই ইউনিভার্স, দারুণ ভ্রান্ত ‘কেরালা স্টোরি’ আর দারুণ দারুণ রোম্যান্টিক বলিউডের বাইরের এক ভারত।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

দেউচা-পাঁচামি হোক। বস্তার হোক। আমরা দেখছি, একুশ শতকে কর্পোরেট পুঁজির হাঁ-মুখ গিলে গিলে খাচ্ছে অরণ্য। খাদ্যপ্রক্রিয়ায় নির্লজ্জ মদত দিয়ে চলেছে  শাসক। পুলিশ। দাসরু বুঝতে পারছিল, নিজের জমি ‘আগারওয়াল’-এর হাতে চলে যাবেই। কতকটা বিভ্রান্ত হয়েই সে তখন হাঁটে মাওবাদের পথে। ঘর ছাড়ে। তারপর এক অসম যুদ্ধ। জমির জন্য লড়াই। রাষ্ট্রের সামনে, কর্পোরেট পুঁজির এক ফুঁ-তে উড়ে যায় সমস্ত মাওবাদী। আদিবাসী ভিটেমাটি। এবং দাসরু। আবার সে ঘর ছেড়ে যায়। পালিয়ে আসে মুম্বইতে। সেখানেই, কোনও আকস্মিকতায়, এমএলএ ফুলো কার্মা খুঁজে নেয় দাসরুকে। রাষ্ট্রের তাড়া খেয়ে ফের একবার দৌড়! পরিচালক দেবাশিষ মাখিজার ছবি ‘জোরাম’– এই অভিবাসনেরই আখ্যান। হয়তো থ্রিলারধর্মী। কিন্তু দাসরুর মতো অগণিত ‘অপর’-এর অভিবাসন ভারতের মাটিতে যে ভীষণরকম সত্যি এবং উপেক্ষিত! দেবাশিস মাখিজা ধাক্কা দিচ্ছেন সেখানেই। প্রশ্ন করছেন রাষ্ট্রকে।

Manoj Bajpayee is displeased that people didn't watch Joram in theatres: 'It made Rs 15-20 lakh per day; we wanted to experiment' | Bollywood News - The Indian Express

শিল্প এ মারণ ক্ষমতা ধারণ করে। দেবাশিস মাখিজার ‘ভোঁসলে’, ‘আজ্জি’-র মতো দুরন্ত ছবি পেরিয়ে এখানে বলা যাক তাঁর একটি শর্ট-ফিল্মের কথা। নাম ‘আগলি বার’। সাত মিনিটের ছবি। যেখানে স্পষ্ট হচ্ছে, একটি চরিত্র জাস্ট খুন করে দিয়েছে দুই মুসলিমকে। কপালে গেরুয়া তিলক। পরবর্তী টার্গেট– আপনি! ছবিটা এখানেই শেষ। এও তো এক ভারতের নির্মাণ– দারুণ অ্যাকশান-সমৃদ্ধ স্পাই ইউনিভার্স, দারুণ ভ্রান্ত ‘কেরালা স্টোরি’ আর দারুণ দারুণ রোম্যান্টিক বলিউডের বাইরের এক ভারত। দেবাশিসের নির্মোহ দৃষ্টি সেই ভারতের ওপর। যে ভারতের গা থেকে কাপড়চোপড় খুলতে খুলতে, এখন নগ্ন। ‘জোরাম’-এর একটি দৃশ্যের কথা বলি। ঝাড়খণ্ডের পুলিশ স্টেশন। সন্ধেবেলার মোচ্ছবে একজন পুলিশ অফিসারই মেয়ে সেজেছে। উদ্দাম খ্যামটা নাচ। মদ। মাংস। ফোয়ারা। পুলিশ স্টেশনে কারেন্ট চলে যাচ্ছে। তবু তারা থামছে না। এবং এই উদ্দামতায়, ধীরে ধীরে, সকলের যৌনসম্ভোগের বস্তু হয়ে উঠছে, সেই নারীরূপী পুরুষ পুলিশ অফিসার। যেন তাকে ছিঁড়ে খেতে আসছে সবাই। সে চিনতে পারছে না এ বিকৃতি। ভয় পাচ্ছে খুব। এর চেয়েও বেশি রাজনৈতিক অভিঘাত সম্পন্ন দৃশ্য ‘জোরাম’-এ আছে অবশ্যই! তবু এ দৃশ্যের অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলা অসম্ভব। নাজিম হিকমত যেমন বলেছিলেন, ‘সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প, যা মানুষকে জীবন সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা দেয় না!’

এমএলএ ফুলো কার্মা প্রতিশোধের নেশায় উন্মাদ। দাসরু খুঁজছে একটা আশ্রয়। দুইয়ের মাঝখানে– রত্নাকর বাগুল। মুম্বইয়ের পুলিশ। রাষ্ট্রের একজন এজেন্ট। যে নিজে রাষ্ট্রের কাছে অবদমিত।তিনপক্ষই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে, কী এক মায়াবী খেলায় সামিল! সাম্প্রতিক সময়ে, রাষ্ট্র যে ধরনের অ্যাপারেটাস ব্যবহার করছে, মনুষ্যজাতিনিয়ন্ত্রণের খাতিরে, সেসবের মধ্যে অন্যতম– বুলডোজার! প্রকাণ্ড, দৈত্যাকার বুলডোজার যে নিদর্শন দেবাশিস এই ছবিতে রেখেছেন, তার সামনে দাসরু যেন অতিক্ষুদ্র। মানবসভ্যতাও। ছবি যত এগোয়, ক্রমে টের পাই, আমাদের প্রত্যেকের টিকিই কোথাও না কোথাও বাঁধা। স্বাধীনতা আসলে খিল্লি। ছবির কিছু সংলাপ গোদা লেগেছে বটে, কিন্তু চমকে দিল দাসরু চরিত্রটি। সে গ্রামে ফিরে এসে যখন মৃত শালগাছের শরীরে সন্তানস্নেহে হাত বোলায়, যখন লুকিয়ে বাজারে যায়, আর পুরনো কমরেডকে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যামসন! আমাদের কম্যান্ডার কোথায়?’ গায়ে কাঁটা দেয় আমার। মনে পড়ে নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস: ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’। মনে পড়ে, একদিন রাতে মেন্টাল অ্যাসাইলাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিল রণজয়— সাতের দশকের একজন নকশাল। বর্তমানে উন্মাদ। বিপ্লবের ভূত ধাওয়া করে অবিরত। সেদিন রাতে রণজয়, দাসরুর মতোই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সুশীল, আমাদের রাইফেলগুলো কোথায়?’

বিপ্লবের প্রশ্নে দেবাশিস নিশ্চিত কোনও উত্তর দেন না। যেহেতু হিংসার পথ, রাইফেলের পথ ছেড়ে এসেছিল দাসরু নিজেই। দেবাশিসের দার্শনিক সত্ত্বা শুধু কতগুলো ইমেজ এবং শব্দের ইঙ্গিতে নির্মাণ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্তসারশূন্যতা। পরিহাসের ভঙ্গিতে। কারণ, দাসরুর মতো প্রান্তিক মানুষের জীবনকে যে রাষ্ট্র ভয় পায় ভীষণ! কারণ, প্রান্তিক মানুষ চিৎকার করে বলে, ‘আদিবাসীদের মাটিতে পুঁতে দিলে বীজ হয়ে উঠবে!’ কিছুদিন আগেই একটি দক্ষিণ ভারতীয় ছবি এ-কথা বলেছে। কার্তিক সুব্বারাজ পরিচালিত ‘জিগারথাণ্ডা ডাবলএক্স’। অরণ্যের জন্য মরণপণ লড়াইয়ে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল, একটা ক্যামেরা। সিনেমা। আর্ট।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

আরও পড়ুন: রক্তে ভেজা ওটিটি দুনিয়ার থেকে সরে সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষের ছবি

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

‘জোরাম’, এ ছবিতে, প্রতিটি চেজ-সিকোয়েন্সই হ্যান্ডহেল্ডশট! ফলে একটা কেওটিক আবহ যেমন সৃষ্টি হয় পর্দায়, তেমনই চরিত্রের রিয়েলিটিকে আরও ঘন করে দেওয়া যায়। তেমনই দেবাশিস ব্যবহার করেছেন তিন মুখ্য চরিত্রের ক্লোজ আপ। যে কারণে সংলাপ ছাড়াও চরিত্রগুলোর বহু অভিপ্রায় ও যাত্রাপথ– পড়ে নিতে পেরেছি আমরা। দেবাশিসকে কুর্নিশ! কুর্নিশ মনোজ বাজপেয়ীকে। মহম্মদ জিশান আইয়ুবকে। এবং স্মিতা তাম্বে-কে।

তবে এতক্ষণ যা বলিনি! শেষ করি জোরামের কথা বলে। জোরাম, দাসরুর তিন মাসের কন্যাসন্তান। নিবিড় মনে যদি ভাবি, মনে হয় ‘জোরাম’ আসলে দাসরুর সেই ব্যর্থ বিপ্লব! যে বিপ্লবকে ছবিজুড়ে দাসরু বয়ে বেড়াচ্ছে। বুকে। পিঠে। কোলে। ভারতের সংবিধানের কাছে গিয়ে বসছে। হয়তো সংহতি জানাতে। নইলে জীবনের তাগিদে। যে বিপ্লবকে দাসরু পুষ্টি দেয়। দুধ খাওয়ায়। মাছ পুড়িয়ে মুখে তুলে দেয়। সেই আশ্চর্য গানের সঙ্গে নাচে। আর বুকে করে মিলিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলে। একহাতে ধরা বন্দুক। রাষ্ট্রের কাছে ‘স্যারেন্ডার’ করবে না দাসরু। কোনওমতেই না। পুনরায় অরণ্যের অধিকার দখলের স্বপ্নে?

 

কবিতাঋণ: শঙ্খ ঘোষ