‘পোচার’-এর সমগ্র ন্যারেটিভেই নানা দৃশ্যান্তরে আমরা নানা ধরনের বন্যপ্রাণকে দেখতে পাই। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী সেসব মুহূর্তে প্রধান হয়ে ওঠে। পথের ধারে শুয়ে থাকা কুকুর, যানজটে ভরা শহরের ওপরে ছেয়ে থাকা ইলেকট্রিক তার ধরে চুপিচুপি হাঁটতে থাকা হনুমান, জঙ্গলের মধ্যে বাঘ, চিলেকোঠার কার্নিশে বসে থাকা পেঁচা প্রভৃতি প্রাণীর নিরীহ রোজনামচা বা মানুষের নির্বোধ কার্যকলাপ দেখা– প্রায় প্রতিটি এপিসোডেই দৃশ্যান্তর ঘটাতে বা কোনও দৃশ্যের শুরুতে এরকম বেশ কিছু মুহূর্ত রাখা হয়েছে, যা সিরিজটিকে করে তুলেছে আরও বেশি মানবিক।
রিচি মেহতার আট-পর্বের মালয়ালম ওয়েব সিরিজ ‘পোচার’-এ প্রকৃতি ও সভ্যতার চিরন্তন দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্ব থেকে উত্থিত সমস্যা নিয়ে যেমন বলা হয়েছে, তেমনই নিরপেক্ষ স্বরে এখানে এমন সব স্তরের উন্মোচন ঘটিয়েছেন সিরিজ-মেকার, যা খুব সহজে ভারতীয় কাজকর্মে দেখতে পাওয়া যায় না।
চোরাশিকার নিয়ে এমন সাহসী ও সচেতন কাজ সত্যিই নজরকাড়া। কেরলের বনদপ্তরের মলয়াট্টুর ডিভিশনের ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসারের কাছে আরাকু নামে এক ফরেস্ট ওয়াচার এসে বনদপ্তরের নাকের নীচে বহুদিন ধরে চলতে থাকা হাতি চোরাশিকার চক্রের ব্যাপারে তথ্য জোগান দেয়। ফিল্ড ডিরেক্টর নীল ব্যানার্জির (দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য) তত্ত্বাবধানে রেঞ্জ ফরেস্ট অফিসার মালা যোগী (নিমিষা সজয়ন) এবং ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার ক্রাইম কন্ট্রোল ডিভিশনের কর্মী অ্যালান জোসেফ (রোশন ম্যাথিউ) এই ঘটনার তদন্তে নামে। প্রথমে ছোট মাথা, তারপরে মিডল ম্যান এবং অবশেষে রাঘব বোয়াল অবধি পৌঁছানোর জীবন-মরণ খেলায় কোন পক্ষ জয়ী হয়– সেই নিয়ে এই সিরিজ। কিন্তু এই খুব সহজ-সরল বিবরণে আদতে কিছুই বোঝানো হল না, বরং কেউ যদি শুধু এই অনুচ্ছেদটুকু পড়েন, তবে তার এই সিরিজটিকে আর পাঁচটা প্রশাসনিক গর্ব প্রদর্শনমূলক কাজের মতো বলে মনে হতে পারে। আদতে তা একেবারেই নয়। অতিনাটকীয়তা, ঘটনার অবিশ্বাস্য ঘনঘটা, আত্মগর্বের পরিসর– সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে রিচি মেহতা এই সিরিজের প্রতিটি এপিসোড এমনভাবে সাজিয়েছেন, যা দেখে তাক লেগে যায়!
নির্মাতা গোটা সিরিজটিকে নির্দিষ্ট একটি কাঠামোতে ভেঙে পরপর সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন। প্রতিটি এপিসোডের শুরুতে একটি আলগা ন্যারেটিভ ধারাবাহিকভাবে দেখানো হতে থাকে– প্রথম এপিসোডে জঙ্গলের মধ্যে এক চলমান হাতিকে গুলি মেরে হত্যা করা, দ্বিতীয় এপিসোডে মৃত হাতির শবদেহ দেখে একটি বাঘের ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাওয়া, তৃতীয় এপিসোডে মৃত হাতির শুঁড়ের দু’পাশে থাকা দাঁত বের করে নেওয়ার পরে পড়ে থাকা রক্তাক্ত শবদেহ এইভাবে আমরা এক বন্যপ্রাণের নির্মম হত্যা এবং হত্যা-পরবর্তী ঘটনার বিনির্মাণ দেখতে পাই। প্রতিটি এপিসোডে এরপরেই আছে টাইটেল কার্ড ও তৎসংলগ্ন বিজিএম, যেখানে গজদন্ত দিয়ে বানানো অপরূপ সুন্দর শ্বেতশুভ্র গণেশ মূর্তির অবয়ব দেখানো হয়। হত্যার বিনিময়ে নির্মিত ভাস্কর্য, যা সুশীল সমাজের ড্রয়িংরুমে শোভাবর্ধক আর্টপিস হিসেবে সাজানো থাকে। সিরিজের মূল ন্যারেটিভগত চলন আগের অনুচ্ছেদেই উল্লেখ করা হয়েছে– নীল ব্যানার্জি, মালা যোগী ও অ্যালান জোসেফের তরফে জীবনকে বাজি রেখে হলেও, চোরাশিকারীদের ধরার আপ্রাণ প্রচেষ্টা, সেইসঙ্গে তাদের তিনজনের পারিবারিক জীবনে চলা ওঠানামা ও অনিশ্চয়তার আবহ। তদন্তসূত্রে ক্রমশ মালারা বুঝতে পারে, চোরাশিকারের আপাত সহজচক্র আদতে ড্রাগস, মাফিয়া, টেররিজম ইত্যাদি নানা কিছুর সঙ্গে যোগসূত্রে আবদ্ধ, যেখানে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিও এমনতর অপরাধে স্বচ্ছন্দে শামিল। সূত্র ধরে ন্যারেটিভে আসে দেশের ভোট-কেন্দ্রিক সুবিধাবাদী রাজনীতি, আর্ট নামক উজ্জ্বল প্রদীপের তলায় থাকা চোরাশিকার নামক অন্ধকার, র (RAW) থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের নিজস্ব কূটনীতি এবং নিরক্ষর মানুষদের সহজে মগজধোলাইয়ের ইতিবৃত্তান্ত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নির্মাতা গোটা সিরিজটিকে নির্দিষ্ট একটি কাঠামোতে ভেঙে পরপর সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন। প্রতিটি এপিসোডের শুরুতে একটি আলগা ন্যারেটিভ ধারাবাহিকভাবে দেখানো হতে থাকে– প্রথম এপিসোডে জঙ্গলের মাঝে এক চলমান হাতিকে গুলি মেরে হত্যা করা, দ্বিতীয় এপিসোডে মৃত হাতির শবদেহ দেখে একটি বাঘের ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাওয়া, তৃতীয় এপিসোডে মৃত হাতির শুঁড়ের দু’-পাশে থাকা দাঁত বের করে নেওয়ার পরে পড়ে থাকা রক্তাক্ত শবদেহ এইভাবে আমরা এক বন্যপ্রাণের নির্মম হত্যা এবং হত্যা-পরবর্তী ঘটনার বিনির্মাণ দেখতে পাই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে এসব দেখাতে গিয়ে রিচি মেহতা সত্যভাষণে কোথাও কার্পণ্য করেননি। চরিত্রদের মুখ দিয়ে যেখানে যা বলানোর, বলিয়েছেন। কাহিনির গতিপথ অন্যত্র না ঘুরিয়ে যতটুকু দেখানো যায়, দেখিয়েছেন। চরিত্রের দিক থেকে এই সিরিজটি কিয়দংশে অমিত মসুরকরের ‘শেরনি’ (২০২১) চলচ্চিত্রটির সমধর্মী। সেখানেও মানব-বন্যপ্রাণ সংঘর্ষ এবং প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে যুগের পর যুগ ধরে থেকে যাওয়া ঘুণপোকার মতো দুর্নীতিকে একজন আম-নাগরিক বনকর্মী বিদ্যার মধ্য দিয়ে নির্দেশক অমিত দর্শকদের দেখিয়েছিলেন। যদিও ‘শেরনি’ ছবিটি চোরাশিকার কেন্দ্রিক ছিল না, কিন্তু বনের সম্পদ পশু-পাখিদের নিয়ে মানুষ নামের আরেকটি জীবের তুচ্ছতাচ্ছিল্য খেলা এবং সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা করার প্রতি চূড়ান্ত অনীহা– এই সূত্রে দু’টি কাজের লক্ষ্যই এক। মূলত ২০১৯-’২০ থেকে ওয়েব সিরিজের অপরিসীম বাড়বাড়ন্ত এবং অডিও-ভিসুয়াল ড্রামাটিকস দেখার পরিসর কেবল ছোট স্ক্রিনের ওটিটি-তে আটকে যাওয়ার কুফল যেমন আছে, তেমনই সুফল হিসেবে পাওয়া গেছে ‘শেরনি’ (২০২১; সরাসরি ওটিটি-তে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র), ‘পোচার’ (২০২৪; ওয়েব সিরিজ), ‘পাতাললোক’ (২০২০) ইত্যাদির মতো বহুস্তরীয় কাজ, যেখানে ভারতীয় রাজনীতি তথা সমাজব্যবস্থার এমন সব আঙ্গিককে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে ভয়-ডরহীনভাবে, যা আগে এত সহজে খুব একটা করতে দেখা যেত না। ‘পাতাললোক’ একেবারেই অন্য বিষয় নিয়ে, ট্রিটমেন্টের দিক থেকেও আলাদা, তবে গো-বলয়ের নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে সিরিজটি কড়া ভাষায় প্রশ্ন করে, যেখানে অপরাধী ও অপরাধের সাবঅল্টার্ন তত্ত্ব খুব সহজেই অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমে তুলে ধরেন সুদীপ শর্মা। এইসব কাজ আশা জাগায়, ভারতীয় ফিল্ম-সিরিজের ওপরে ভরসা রাখতে শেখায়।
আলোচ্য সিরিজটির মূল বিশেষত্ব আরও একটি ক্ষেত্রে। সমগ্র ন্যারেটিভেই নানা দৃশ্যান্তরে আমরা নানা ধরনের বন্যপ্রাণকে দেখতে পাই। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী সেসব মুহূর্তে প্রধান হয়ে ওঠে। পথের ধারে শুয়ে থাকা কুকুর, যানজটে ভরা শহরের ওপরে ছেয়ে থাকা ইলেকট্রিক তার ধরে চুপিচুপি হাঁটতে থাকা হনুমান, জঙ্গলের মধ্যে বাঘ, চিলেকোঠার কার্নিশে বসে থাকা পেঁচা প্রভৃতি প্রাণীর নিরীহ রোজনামচা বা মানুষের নির্বোধ কার্যকলাপ দেখা– প্রায় প্রতিটি এপিসোডেই দৃশ্যান্তর ঘটাতে বা কোনও দৃশ্যের শুরুতে এরকম বেশ কিছু মুহূর্ত রাখা হয়েছে, যা সিরিজটিকে করে তুলেছে আরও বেশি মানবিক। এই দৃশ্যগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ স্পষ্ট হবে তখনই, যখন কেউ সিরিজটি দেখবেন। লেখায় রয়েছে অঢেল বৈচিত্র ও সূক্ষ তারতম্য, যা সুশৃঙ্খল ও নির্মেদ লিখনকৌশলেই সম্ভবপর হয়েছে। এক্ষেত্রে রিচি মেহতা ভরপুর ধন্যবাদপ্রাপ্য। সিরিজটি মূলত মালয়ালম ভাষায় হলেও, অনেক এমন চরিত্র রয়েছে, যাদের মাতৃভাষা মালয়ালম নয়। ফলে তাদের ব্যক্তিগত পরিসরে কথাবার্তা নিজস্ব ভাষাতেই বলেছে তারা, নির্দেশক এক্ষেত্রে প্রত্যেক ভাষার সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ‘জোরাম’ আসলে দাসরুর সেই ব্যর্থ বিপ্লব, যে বিপ্লবকে ছবিজুড়ে সে বয়ে বেড়াচ্ছে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কেবল যদি কেউ অভিনয়ের মাস্টারক্লাস দেখতে চান, তাহলেও ‘পোচার’ অতি অবশ্যই দেখার মতো একটি কাজ। জিও বেবির ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ (২০২১) খ্যাত অভিনয়কর্মী নিমিষা সজয়ন মালা যোগীর চরিত্রে শুরু থেকে শেষ অবধি ছক্কা হাঁকিয়েছেন একের পর এক। এমন নির্মেদ, ভণিতাহীন, সচেতন ও উপযুক্ত অভিনয় দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। মালা চরিত্রটির অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভয়, সত্যকে প্রকাশ্যে আনার অদম্য ইচ্ছে ইত্যাদি সমস্ত কিছু মসৃণভাবে নাটকীয়তা বর্জন করে নিমিষা অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। নিমিষা পোড়খাওয়া অভিনয়কর্মী, কাজ করেন যথেষ্ট বেছে-বুছে। দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য এখানে নিমিষার মতোই সমান তালে কাজ করেছেন, স্বতস্ফূর্ত অভিনয় শৈলীর একদম প্রখর প্রভায় নীল ব্যানার্জির চরিত্রটিকে তিনি আলোকিত করে তুলেছেন। হাঁ হয়ে তাকিয়ে দেখার মতো তাঁর কাজ। এত যথাযথভাবে এর আগে দিব্যেন্দুকে অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা হয়নি। অ্যালান জোসেফের চরিত্রে রোশন ম্যাথিউও বেশ ভালোই এবং দর্শকের পক্ষে বেশি করে কানেক্ট করার সুযোগ এই চরিত্রটিই দিয়েছে গোটা সিরিজে। সাজিন বাবুর মালয়ালম ছবি ‘বিরিয়ানি’ (২০২০)-খ্যাত অভিনয়কর্মী কোনি কুশ্রুতিকে এই সিরিজে সেভাবে ব্যবহার না করার অভিযোগে কিন্তু রিচি মেহতা দুষ্ট হবেন, কারণ এমন চমৎকার অভিনয় দেখার সুযোগ কেবল প্রথম এপিসোডেই মেলে, বাকি এপিসোডে তার অভিনীত চরিত্রটিকে ন্যারেটিভের প্রয়োজনেই স্ক্রিনে আনা হয় না। এই সিরিজে কারওর অভিনয়ই দুর্বল নয়, বেছেবুছে হিরে-জহরত নেওয়া হয়েছে গুরুত্ব ব্যতিরেকে যেকোনও চরিত্রের জন্যেই। বিশেষ করে উল্লেখ করতেই হয় স্বপ্না স্যান্ড, সাভি কুন্দ্রা, অঙ্কিত মাধব, সুরজ পপসের অভিনয় প্রতিভার কথা।
রিচি মেহতা এর আগে ‘দিল্লি ক্রাইম’ (২০১৯)-এর প্রথম সিজনটি নির্মাণ করেছিলেন। ‘পোচার’-এর মতোই সেই কাজটিও ছিল যথেষ্ট নির্মেদ ও বাহুল্যবর্জিত, তবে ‘পোচার’ অনেক বেশি গ্রাউন্ডেড কাজ, যেখানে বিন্দুমাত্র কৃত্রিমতা বাদ দিয়ে ফিল্টারহীনভাবে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। সাদা-কালোর চিরচেনা ন্যারেটিভ ট্রোপের বাইরে বেরিয়ে ধূসর-অন্ধকার দিকগুলো এভাবে দেখানো সত্যিই প্রশংসাযোগ্য প্রচেষ্টা।