সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা নিয়ে যখন হলিউডের মূলধারায় সিনেমা নির্মাণ শুরু হল তখন তথাকথিত বিসমকামী মানুষরাই সমকামী-রূপান্তরকামী চরিত্রে অভিনয় করতেন। শুধু তাই নয়, বহু পুরস্কার তাঁরা জিতে সেসব চরিত্রকে আমেরিকার সিনেমাতিহাসে উজ্জ্বল করে গিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ‘কিস অফ দ্য স্পাইডার’ ছবিতে এক সমকামী লেখকের চরিত্রে অভিনয় করে উইলিয়াম হার্ট শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার জিতেছিলেন।
বিশ্বফিল্মের আঙিনায় অস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। হলিউডকে হেয় করা কিংবা এক্কেবারে পাত্তা না দেওয়া ফিল্মবোদ্ধাও ছবি-উৎকর্ষের সূচক তৈরি করেন আমেরিকান সিনেমার তুলনাতে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের ফিল্মপরিচালক বা সিনেমাগোষ্ঠীর কাছে সাফল্যের শেষ ধাপের নাম নিঃসন্দেহে অস্কার পুরস্কার।
অস্কার যাঁরা পেয়েছেন, কিংবা পুরস্কারে মনোনীত হয়েছেন, তাঁরা অচিরেই সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছেন, বিশেষত অভিনয় ক্ষেত্রে। আবার অস্কার কর্তৃপক্ষ কোন ধারণায় অস্কার কিংবা তার মনোনয়ন দিয়েছেন, তাতে সকলের অংশগ্রহণ আছে, নাকি একটি বিশেষ ক্ষমতাবান গোষ্ঠী তা কুক্ষিগত করে রেখেছে– আমরাও প্রতিবার সেসব বিচার করে দেখি বা দেখেছি। খুশির খবর, ২০২৪ সালের অস্কারে শ্রেষ্ঠ পুরুষ-অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছেন কোলম্যান ডোমিঙ্গো তাঁর ‘রাস্টিন’ ছবির জন্য। বেয়ার্ড রাস্টিন ছিলেন আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একজন প্রখ্যাত মুখ এবং বলা হয় ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘ওয়াশিংটন চলো’ ডাকের প্রধান পুরোহিত ছিলেন তিনি। রাস্টিন না থাকলে সেই আন্দোলন হয়তো এতটা গতি পেত না, এমন মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক। বেয়ার্ড রাস্টিনের জীবনী নিয়েই ‘রাস্টিন’ ছবি এবং নাম ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য কোলম্যান ডোমিঙ্গো পেয়েছেন অস্কারে মনোনয়ন। তবে এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল বেয়ার্ড রাস্টিন ছিলেন সমকামী এবং কোলম্যান ডোমিঙ্গোও সমকামী। এবং এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। অস্কারের ইতিহাসে ডোমিঙ্গো দ্বিতীয় ঘোষিত-সমকামী অভিনেতা, যিনি মনোনয়ন পেলেন। এর আগে একমাত্র স্যর ইয়ান ম্যাকেলেন পেয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে ‘গডস অ্যান্ড মনস্টার্স’ ছবির জন্য। তবে কৃষ্ণাঙ্গ-সমকামী অভিনেতা হিসেবে ডোমিঙ্গো অবশ্যই প্রথম।
আমেরিকার মতো তথাকথিত উন্নত মহাদেশ ও সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জীবন কখনওই সুখের ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা আমেরিকার নানা সমকামী-রূপান্তরকামী আন্দোলন থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই মহাদেশেই বর্ণবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ সমাজের পরতে পরতে থেকেছে। ঠিক তেমনই ছিল সমকাম-বিদ্বেষ। বহু মানুষকে তার যৌনতার প্রকৃত পরিচয় সারাটা জীবন গোপন করে বেঁচে থাকতে হত। না হলে সামাজিক হেনস্থা-হিংসার খাড়া নেমে আসত তাদের গর্দানে। একইরকম অবস্থা হত সিনেমাশিল্পীদের। কারও সমকামিতার কথা জানতে পারা গেলে অচিরেই কাজ হারাতে হত সেই ব্যক্তিকে। একটা সূক্ষ্ম বয়কট শুরু হত তার বিরুদ্ধে। আজ জেমস ডিন থেকে শুরু করে মার্লোন ব্র্যান্ডোর ভিন্ন যৌনতা নিয়ে কথা হয়, জানা যায় তাঁরা হয়তো কেউই ঠিক বিসমকামী ছিলেন না, কিন্তু জীবদ্দশায় সেই যৌন-আকাঙ্ক্ষার কথা তাঁরা মুখ ফুটে বলতে পারেননি। তাঁদের যৌনতার ইতিহাস তথাকথিত স্বাভাবিক যৌনচাহিদা বা পরিচয়ের ইতিহাস নয়, হলদে-সাংবাদিকতার রগরগে কেচ্ছা হয়ে থেকেছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমেরিকার মতো তথাকথিত উন্নত মহাদেশ ও সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জীবন কখনওই সুখের ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা আমেরিকার নানা সমকামী-রূপান্তরকামী আন্দোলন থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই মহাদেশেই বর্ণবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ সমাজের পরতে পরতে থেকেছে। ঠিক তেমনই ছিল সমকাম-বিদ্বেষ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরেকটি বিষয় লক্ষ করা গিয়েছে যে, সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা নিয়ে যখন হলিউডের মূলধারায় সিনেমা নির্মাণ শুরু হল, তখন তথাকথিত বিসমকামী মানুষরাই সমকামী-রূপান্তরকামী চরিত্রে অভিনয় করতেন। শুধু তাই নয়, বহু পুরস্কার তাঁরা জিতে সেসব চরিত্রকে আমেরিকার সিনেমাতিহাসে উজ্জ্বল করে গিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ‘কিস অফ দ্য স্পাইডার’ ছবিতে এক সমকামী লেখকের চরিত্রে অভিনয় করে উইলিয়াম হার্ট শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার জিতেছিলেন। ‘ফিলাডেলফিয়া’ ছবিতে সমকামী এডস রোগীর চরিত্রে অভিনয় করে একই পুরস্কার পান অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস ১৯৯৩ সালে। কয়েক বছর পর শঁ পেন অস্কার পান ‘মিল্ক’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য এবং তার পর রামি ম্যালেক ২০১৮-তে ‘বোহেমিয়ান রাপসোডি’ ছবিতে সমকামী গায়ক ফ্রেডি মারকারির চরিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার জিতে নেন। কিন্তু সেসব চরিত্রের নির্ভেজালত্ব রক্ষা করতে, কেন সমকামী-রূপান্তরকামী যৌনতার কেউ সেই ছবিগুলোতে অভিনয় করল না, সেই প্রশ্ন কখনও ওঠেনি। বিশ্বের নানা প্রান্তের নাটক-থিয়েটারে এক সময় ছেলেরা মেয়েদের চরিত্র অভিনয় করত। এখন কি তা কোনওভাবে সম্ভব? তেমনই সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা যাঁদের যৌনতাই নয়, সেই অভিনেতারা কীভাবে সেইসব চরিত্রের প্রতি সুবিচার করবেন, এই প্রশ্ন কেন উঠল না, তা ভাবা দরকার।
অন্যদিকে, এটাও লক্ষ করা যায় যে সমকামী বা বিসমকামী– যে অভিনেতাই অভিনয় করুক, হলিউডের ইতিহাসে সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী বিষয় নিয়ে খুব বেশি সংখ্যক সিনেমা তৈরি হয়েছে কিংবা সেই সিনেমা নিয়ে ভালোরকম আলোচনা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, তাও নয়। অস্কার, হলিউড এবং আপামর আমেরিকান ছবির দলিল ঘাঁটলে উঠে আসে কেবল অ্যাং লি পরিচালিত ২০০৫-এর ‘ব্রোক ব্যাক মাউন্টেন’ কিংবা ২০১৭-তে নির্মিত ‘মুনলাইট’-এর কথা। আর কখনও ইতিউতি দু’-চারটে ছবি ও তাতে অভিনীত চরিত্র কিছু। সুতরাং, সমকামিতা-উভকামিতা-রূপান্তরকামিতাকে বিষয় করে হলিউডে ছবিই যদি কম তৈরি হয়, তাহলে সমকামী-রূপান্তরকামী অভিনেতারা উঠে আসার নতুন নতুন সুযোগ পাবে সেটা আশা করাও বাতুলতা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ক্যানভাসে খেলার ছবি, ধরে রাখছে সংগ্রামের ইতিহাস
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এবার প্রশ্ন হল, মনোনয়ন পেলেও যৌন-সংখ্যালঘু মানুষরা অস্কার কখনও জিতেছেন কি না। আন্তর্জাতিক-ছবি বিভাগে পেদ্রো আলমোদোভার অস্কার নিয়ে গেছেন স্পেনে তাঁর ‘তো দো সোব্রে মি মাদ্রে’ (১৯৯৯) ছবির জন্য, যিনি ব্যক্তিগত জীবনে একজন সমকামী। জুডি ফস্টার দু’বার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর অস্কার জিতেছেন এবং মনোনয়ন পেয়েছেন চারবার। তবে তিনি নিজের যৌনপরিচয় খোলসা করেছেন অনেক পরে। এছাড়া, রব এপস্টাইন একজন ঘোষিত-সমকামী যিনি শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারির অস্কার পেয়েছেন কয়েকবার। এর সঙ্গে ধরা যেতে পারে ‘বেস্ট ওরিজিনাল সং’ বিভাগে ভিন্ন যৌনপরিচয়ের এল্টন জন, মেলিসা এথেরিজ এবং স্যাম স্মিথ অস্কার পেয়েছেন। আর বাকি রয়ে যায় অ্যালান বল (আমেরিকান বিউটি) এবং ডাস্টিন ল্যান্স ব্ল্যাক (মিল্ক)–যাঁরা শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের অস্কার পেয়েছেন সমকামী হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু এই কয়েকটি সাফল্যে সমাজের গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ কিছু কমে যাইনি। বরং নতুন সব কায়দায় আমেরিকার মতো রাষ্ট্র ও সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের ওপর হেনস্থা-হিংসার ঘটনা বেড়ে চলেছে।
আগামী ১১ মার্চ অস্কার-পুরস্কারের চূড়ান্ত ঘোষণা। সমগ্র বিশ্ব ওইদিনটির জন্য মুখিয়ে আছে এটা বললে সত্যের অপলাপ হয় না। কোলম্যান ডোমিঙ্গো ‘রাস্টিন’ ছবির জন্য অস্কার পাবেন কি না সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু একজন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মানুষের কথা এত গভীর করে সবাই জানতে পারছে এই ছবির সূত্রে। তাঁর যৌনতাও এখন আলোচ্য বিষয়। এবং সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরাও যে দিন-বদলের বিপ্লবে সমান নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা রাখেন তা ‘রাস্টিন’ সিনেমাটি (সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে এসেছে) দেখলে টের পাওয়া যায়। তবে সেই সাফল্য এবং খোদ হলিউডেই অনেক বাঁধা অতিক্রম করে এসে কোলম্যান ডোমিঙ্গো-র অনন্যসাধারণ অভিনয় অস্কার লাভ করে কি না, এখন সেটাই দেখার। সেরকম কিছু হলে নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে আরও একটা নতুন ইতিহাসের জন্ম হবে।
এই সহস্রাব্দীতে বিশ্বের যে তিনটি বড় সংঘর্ষ, ইরাক, ইউক্রেন এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, সবক’টাই কূটনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ‘নিয়ন্ত্রিত’ভাবে যুদ্ধ জিইয়ে রাখা হয়েছে। আর তার জন্য বিশ্বজুড়ে নির্মিত হয়েছে বিপুলায়তন স্যাটেলাইট-টিভি নামক এক অ্যাম্ফিথিয়েটার।