আটপৌরের ঘেরাটোপে সংস্কৃতিতে গোপালের শিশুকল্পটি একেবারেই বাস্তব। এই কলকাতাতেই ভাঙা ঘরে গোপাল আটকে আছে বলে মনখারাপ এলাকাবাসীর। দিনকয়েক আগের সংবাদপত্রেই সেই যশোদা-কান্না দেখা গিয়েছে। আদালতের কাছে আর্জিও জানানো হয়েছে, গোপালের একটা হিল্লে করে দেওয়ার জন্য। এই সমবেত প্রার্থনা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তা আমাদের আলাদা করে ভাবায় না। কেননা ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির বিবর্তনের ভিতরই এই আবেদনের বীজ লুকিয়ে।
গোপাল বড় সুবোধ বালক। তবে যাঁরা লেখেন, ছবি করেন– তাঁদের এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং কিঞ্চিৎ ‘রাখাল’ প্রকৃতির বলেই গোপালের সুবোধত্ব নিয়ে তাঁরা খানিক এতোলবেতোল ভাবতে ও ভাবাতে পারেন। যেমনটা ভাবাচ্ছেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য এবং তাঁর ছোট ছবি ‘আটপৌরে’।
আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যটি খানিক হাসিরই। মাঝবয়সি একজন মহিলার পুতুলকে অপত্যকল্পনা। তাঁর অন্তর বলছে, প্লাস্টিকের শিশু-অবয়বের ভিতর আছে রক্তমাংস। হয়তো নাড়ি ছিন্ন হওয়ার চিহ্নও। অতএব তাকেই তিনি কোলে তুলে নিয়ে আদর করেন, দুধ খাওয়ানোর জন্য ফিডিং বোতল হাতে নেন। তাঁর এই কল্পটির প্রতি আপত্তি জানালে তীব্র এবং ঝাঁজালো হয়ে ওঠেন। প্রায় হোয়াটবাউটারির মতো করে টেনে আনেন পিসিমার গোপাল নিয়ে একই রকম কল্পনাকে। সেই সন্তানস্নেহ, সেই অন্তরের আবেগ দিয়ে বাস্তবকে গড়ে নেওয়া। তফাত হল, এই কল্পটিতে সামাজিক অনুমোদনের অভাব হয় না। মাঝবয়সি মহিলাকে অবশ্য তাঁর ভাবনা নিয়ে আপত্তির মুখে পড়তে হয়। আর এই তুলনামূলক আলোচনায় আমাদের হাসির উদ্রেক হয় এই ভেবে যে, আদতে তা কতখানি অসার!
অথচ আটপৌরের ঘেরাটোপে সংস্কৃতিতে গোপালের শিশুকল্পটি একেবারেই বাস্তব। এই কলকাতাতেই ভাঙা ঘরে গোপাল আটকে আছে বলে মনখারাপ এলাকাবাসীর। দিনকয়েক আগের সংবাদপত্রেই সেই যশোদা-কান্না দেখা গিয়েছে। আদালতের কাছে আর্জিও জানানো হয়েছে, গোপালের একটা হিল্লে করে দেওয়ার জন্য। এই সমবেত প্রার্থনা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তা আমাদের আলাদা করে ভাবায় না। কেননা ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির বিবর্তনের ভিতরই এই আবেদনের বীজ লুকিয়ে। অশোক সেন এই স্তরের বিশ্লেষণ করতে গিয়েই বলেছিলেন, ‘এক স্তরে দেখা যায় জীবনের যাবতীয় দ্বন্দ্বে মানুষ তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর সজীব নরকল্পতা থেকে পৌরাণিক সামঞ্জস্যের ঐশ্বর্য অর্জন করেছে। সেখানে সামাজিক ভাঙাগড়ার প্রশ্ন বারবার ধর্ম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে উঠলেও কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পূর্বেই ধর্মজিজ্ঞাসায় রক্ষণশীল পথনির্দেশ মুখ্য তাৎপর্য লাভ করেছে।’ অতএব গোপালে আমাদের আপত্তির কারণ ছিল না, কেননা এই নরকল্প ও রক্ষণশীলতাই মজ্জাগত, বহুদিন। চন্দ্রিল অন্তর্ঘাত ঘটালেন পুতুলের সঙ্গে তার তুলনাটা টেনে, দুয়েরই অসারতাকে দাঁড়িপাল্লায় তুলে। এবং তখনই বোঝা গেল, যত সহজে ওই মহিলার কল্পটিকে অগ্রাহ্য করা যায়, তত সহজে গোপালকে নয়।
এই অস্বীকার না করতে পারার অংশটুকুর বিশেষ গুরুত্ব আছে। রাজনীতির আতশকাচের তলায় তা যদি এসে পড়ে, বা, সুপরিকল্পিত ভাবে কেউ যদি এনে ফেলেন, তখন স্পষ্টই দেখা যায় রাম মন্দির। শিশু রাম ঘরছাড়া, সেই বাৎসল্যের টান, অতএব আদালত এবং পরিণতি সকলেরই। আটপৌরে গোপালসেবা হয়তো হিসাবও রাখে না, যে, কী হইতে কী হতে পারে! তা কখনও বলে না, উইপোকার মতো কোনও সম্প্রদায়কে ক্রমে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। কিংবা একটি সংঘের যাবতীয় বাসনা পূরণ হবে এক এক করে। অথচ এই কল্পটিকে দিব্যি সে কাজে লাগানো যায় এবং যাচ্ছেও।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রাজনীতির আতশকাচের তলায় তা যদি এসে পড়ে, বা, সুপরিকল্পিত ভাবে কেউ যদি এনে ফেলেন, তখন স্পষ্টই দেখা যায় রাম মন্দির। শিশু রাম ঘরছাড়া, সেই বাৎসল্যের টান, অতএব আদালত এবং পরিণতি সকলেরই। আটপৌরে গোপালসেবা হয়তো হিসাবও রাখে না, যে, কী হইতে কী হতে পারে! তা কখনও বলে না, উইপোকার মতো কোনও সম্প্রদায়কে ক্রমে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এদিকে এর অন্তঃস্থ অসারতা ওই এক পুতুলেই চন্দ্রিল বুঝিয়ে দিচ্ছেন মাত্র মিনিটখানেকের মধ্যেই। তাঁর ‘Y2K’ দেখিয়েছিল, সেই বইয়ের পাতায় সরে যাচ্ছে দ্রুতগামী আঙুল। ঈশ্বরশব্দ স্পর্শ মাত্রই নেমে আসবেন স্বয়ং ভগবান। আর তিনি এলে মানুষ যে কী ল্যাজেগোবরে হয়ে ওঠে, তাও তো দেখাই গিয়েছিল। সেই সেখান থেকে আজকের পুতুলসাধনা অবধি পৌঁছলে, ধর্মাচরণের বাহ্যিক আয়োজনের আড়ম্বর, অসারতা, আর বিপদ সংক্রান্ত একটি রূপরেখা ফুটে ওঠে। যেন গত আড়াই দশকের দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক বদলের ইতিহাস-ই।
যদিও চন্দ্রিল তা কোথাও স্পষ্ট করে বলেন না। মুচকি হাসির মতো ইঙ্গিত ঝুলিয়ে রাখেন আটপৌরে দৃশ্যমালায়। ছবি জানে, তার দর্শক আছে। আর দর্শক, সাক্ষী গোপাল, অবশ্য আগেই জানত, যাঁরা লেখেন, ছবি করেন তাঁরা মোটেও কিছু সুবোধ গোপাল নন।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved