শর্মিষ্ঠা ও রাজদীপ বাণিজ্যিক ছবিও বানাতে চান। মনে করেন, একটা ছবি আর্থিকভাবে ফলদায়ী না হলে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। শেষ দশ বছরে বাংলার নতুন প্রজন্মের জন্য ছবি তৈরি হয় না। সবাই কেন বাংলা সিনেমা বিমুখ হয়ে পড়েছে? আক্ষেপ জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক শর্মিষ্ঠা ও রাজদীপের।
জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে ‘কালকক্ষ’র ঝুলিতে সেরা বাংলা ছবির স্বীকৃতি। তারপর এই ক’টা দিন কেমন কাটল?
রাজদীপ : আস্তে আস্তে বিষয়টা সিংক ইন করছে। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি তবু মানলাম, কিন্তু যে ক্যাটেগরিতে পেয়েছি, সেটা সত্যি অবিশ্বাস্য। বলা যেতে পারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিরোপা। শ্রেষ্ঠ ছবির স্বীকৃতির পরেই। মিডিয়া বা চেনা লোকজনের ফোন তো ঠিক আছে, ফ্রেটারনিটির অনেকে যারা আমাদের চেনে না বা আমরাও চিনি না, তারা অদ্ভুতভাবে সেলিব্রেট করছে। সোশ্যাাল মিডিয়ায় ‘কালকক্ষ’র পোস্টার দিয়েছে বা লিখেছে এমনভাবে, যেন তাদের জয়। সেটা খুবই আনন্দদায়ক।
ইন্ডাস্ট্রি ফ্রেটারনিটি, টলিউড থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া?
শর্মিষ্ঠা : হ্যাঁ, আমরা কিছুদিন ধরে কাজ করছি ঠিকই, তবে এটা আমাদের ডেবিউ ফিচার। সেই অর্থে এখনও ইন্টারনাল লোক নই। ছোট মাপের কিছু কাজ করেছি আমরা। নিশ্চয়ই অনেকে ফোন করেছে, একটু যারা আমাদের মতো কাজ করছে, তাদের থেকে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। তবে টলিউড ইন্ডাস্ট্রি থেকে সেভাবে প্রতিক্রিয়া পাইনি। রঞ্জন ঘোষ, ইন্দ্রাশিস আচার্য, অর্জুন দত্ত সরাসরি তাদের ভাললাগার কথা জানিয়েছে। আর অঞ্জনদাকে (বসু, প্রযোজক ‘অরোরা’র কর্ণধার) বেশ কিছু মানুষ জানিয়েছেন, ওঁর মাধ্যামে সেগুলো আমরা জেনেছি।
এই স্বীকৃতি কেরিয়ারে বদল আনতে পারে মনে হয়?
শর্মিষ্ঠা : একটা পুরস্কার সব পাল্টে দেবে, তা কখনওই সম্ভব নয়। এটা একটা রিওয়ার্ডিং মোমেন্ট। আমরাও উদ্যাপন করছি কিন্তু জানি আগামী দিন কঠিন। প্রতিকূলতা সবসময় থাকবে। কারণ, স্বীকৃতির সঙ্গে জুড়ে যায় দায়িত্ব। সেইটা বাড়লে আকাঙ্খা-ও বাড়বে। কিন্তু একটা ধাপে এলাম আমরা, সেটা সামনে এগোতে কিছুটা সাহায্য করলেও করতে পারে।
এরপর কি ছবি তৈরি এবং প্রযোজক পাওয়ার পথ একটু সহজ হতে পারে?
রাজদীপ : এটা বলা খুব শক্ত। আমরা দশ বছর ধরে এই ধরনের কাজ করার চেষ্টা করছি। আমাদের কাজে একটা ‘সিগনেচার’ আছে। আবার এটাও নয়, আমরা মেনস্ট্রিম বা কমার্শিয়াল কাজ করতে ইচ্ছুক নই। আমাদের তেমন স্ক্রিপ্টও রেডি আছে। আমরা একটা ছবিকে মেনস্ট্রিম বা আর্টহাউস ওরকম ভাবে দেখি না, বরং ভাবি আমরা নতুন কী দিতে পারছি। যখনই কেউ নতুন কিছু দেওয়ার চেষ্টা করে, সে যে কোনও ফিল্ডেই হোক, তখনই সেই জার্নিটা আরও শক্ত হয়ে ওঠে। মনে আছে ‘শোলে’ যখন বানানো হয়, সেই নতুন ধরনকে চলমান ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু রিজেক্ট করেছিল। পরে সেটা ক্লিক করে। কাজেই প্রযোজক পাওয়া সহজ হবে কি না শুধু ভবিষ্যৎ বলতে পারবে।
এর আগে আপনারা ‘মালাই’ আর ‘কায়ান্তর’ নামে দু’টি শর্ট ফিল্ম করেছিলেন। আরও বেশকিছু কাজ, তবে একটি তথ্যচিত্রের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাই না?
শর্মিষ্ঠা : হ্যাঁ, ‘অ্যাট দ্য ক্রস রোডস: নন্দন বাগচী লাইফ অ্যান্ড লিভিং’-এর জন্য। তবে ফিচার ফিল্মের জন্য এটাই প্রথমবার।
ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যফকে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেন? সেখানে ‘কালকক্ষ’-র বাণিজ্যিক দিক যদি বলি সেটা প্রায় শূন্য।
শর্মিষ্ঠা : এখনও পর্যন্ত তাই-ই।
বাণিজ্যিক সাফল্য আর ফেস্টিভ্যাল-পুরস্কারের স্বীকৃতি দুটোর তো বিরোধ থাকার কথা নয়…
শর্মিষ্ঠা : আইডিয়ালিস্টিকালি তো এটাই হওয়া উচিত। যদি একটা ছবি ফেস্টিভ্যালে বা দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পায়, তার মানে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু ছবিটা জনসাধারণের কাছে পৌঁছবে না, যদি সেটা প্রেক্ষাগৃহে না রাখা হয়। তখন ঠিক বিচার হবে না।
‘কালকক্ষ’ রিলিজের পর খুব কম সংখ্যক দর্শক ছবিটা দেখেছে। সেই ছবিটা সেরা বাংলা ছবি নির্বাচিত হল। আজকে আক্ষেপ হয় না, তখন যদি আরেকটু বেশি দর্শক দেখত ছবিটা?
রাজদীপ-শর্মিষ্ঠা : অবশ্যই, সেটা মনে হচ্ছে।
শর্মিষ্ঠা : শেষ কিছুদিন ধরে আমি এটাই বলেছি। ‘কালকক্ষ’ নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেই এসেছে। ছবিটা কখনওই হত না, যদি না করোনার সংকট আসত। যখন ছবিটা বানাচ্ছি, আমরা বেঁচে থাকব কি না সেই ক্রাইসিস চলছে। ছবিটা বানাতে পারব কি না ভাবছি, একটা করে দিন কাটছে। সেখান থেকে ছবিটা যখন শেষের মুখে, কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ আসে। আমাদের হিউজ সেটব্যাক হয়। তারপর ফেস্টিভ্যালে পাঠানো শুরু করি। বুসানে ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার ঘোষণা হয়। কিন্তু কোয়ারেন্টিন প্রোটোকলের জন্য আমরা যেতে পারিনি। তারপর ছবিটা বিভিন্ন উৎসবে সমাদৃত হয়। শেষে ২০২২-এর আগস্টে রিলিজ হয়। যারা দেখেছিল এবং ইয়াং জেনারেশনের অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালিখি করেছিল। কিন্তু এ ধরনের ছবি যে যে প্রেক্ষাগৃহে থাকলে ভাল হয়, সেই প্রেক্ষাগৃহগুলো কিন্তু সেভাবে আমাদের জায়গা দেয়নি। দু’সপ্তাহ পরে ছবিটা তুলে নেওয়া হয়েছিল। নানা বাণিজ্যিক ছবির কারণে। এবারও আমরা পুনর্মুক্তির জন্য এগিয়েছিলাম, কিন্তু সেভাবে প্রেক্ষাগৃহ না পাওয়ায়, পছন্দমতো শো-টাইমও না থাকায় আমরা সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখি। পরে নিশ্চয়ই আবারও ছবিটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
রাজদীপ : এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আর একটু যোগ করতে চাই, আমরা বাণিজ্যিক ছবিও বানাতে চাই। একটা ছবি আর্থিকভাবে ফলদায়ী না হলে তো বেশিদিন রান করতে পারবে না। শেষ দশ বছরে কিন্তু বেঙ্গলের ইয়ং জেনারেশনের জন্য ছবি তৈরি হয় না। তারাও বাংলা সিনেমা বিমুখ হয়ে পড়েছে। গ্রামেগঞ্জে কময়বসিরা তামিল-তেলুগু ছবি দেখতে বেশি পছন্দ করে। সেটাও মোবাইলে দ্যাখে। আবার শহরকেন্দ্রিক দর্শক দ্যাখে নেটফ্লিক্স বা বিদেশি কনটেন্ট। এই দর্শক বাংলা ছবি বিমুখ হল কী করে? কারণ, অ্যাজ আ ইন্ডাস্ট্রি বা অ্যাজ আ মেকার, আমরা সেই দর্শকের চাহিদা ফুলফিল করতে পারছি না। একটা জেনারেশন নতুন ধরনের কিছু আনার চেষ্টা করছি আমরা। কিন্তু একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। মুষ্টিমেয় দর্শক ‘কালকক্ষ’-কে এক্সপেরিমেন্টাল ছবি মনে করেনি, যারা ‘ডার্ক’ দেখেছে বা নোলানের ছবি দেখেছে। অন্যদিকে সবাই সেই এক্সপেরিমেন্টাল শব্দটাই ব্যবহার করেছে। তখন বেশ কিছু মানুষ প্রথমেই নস্যাৎ করে দিয়েছে, ধুর, ও বাংলা ছবি কী আর হবে!
‘কালকক্ষ’-র সে অর্থে কোনও স্টার কাস্টিং ছিল না। ছবি বিক্রির জন্য তারকাকে প্রয়োজন কনটেন্টের পাশাপাশি। কী বলবেন?
রাজদীপ : অ্যাবসোলিউটলি। এখন আরও বেশি তারকার গুরুত্ব, একটা কনটেন্ট বিক্রি করার জন্য। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, আমরা যদি নতুনদের সুযোগ না দিই তাহলে নতুন তারকা তৈরি হবে কী করে।
আপনারা জুটি বেঁধে কাজ করবেন এটা কীভাবে ঠিক হয়েছিল?
শর্মিষ্ঠা : আমরা যখন এসআরএফটিআই-এ ভর্তি হই, রাজদীপ পরিচালনা আর চিত্রনাট্য বিভাগে ছিল, আমি এডিটিংয়ে। সেকেন্ড ইয়ার থেকে আমরা কাজ শুরু করি। আমি রাজদীপের এডিটর ছিলাম, ওর প্রথম ছোট ছবি থেকে। পরে পরিচালনায় আসি। রাজদীপের থেকে পরিচালনার দিকটা শেখা আমার (হাসি)। আমাদের টিমটা ফর্ম হয়, একেবারে সিমবায়োটিক রিলেশনশিপ গড়ে ওঠে। আমরা প্রথম দু’জনে একসঙ্গে একটা ডকুমেন্টারি করেছিলাম। তারপর একটু একটু করে সাহস হয় ইন্ডিপেনডেন্টলি ছবি করার।
আপনি লোকাল ট্রেনে যাতায়াতও করেছেন কাজ করতে করতে?
শর্মিষ্ঠা : হ্যাঁ, (হাসি)। যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়াশোনার পর আমি কর্পোরেট জগতে চাকরি করতাম। আর তারকেশ্বর লোকাল বা ব্যান্ডেল লোকাল ধরে শ্রীরামপুরে বাড়ি ফিরতাম। তারপর একসময় মনে হয় থাক চাকরি।
রাজদীপ : ‘কালকক্ষ’ দেখার পর সবাই আমাকে আঁতেল ভাবছে, আমি আঁতলামি ভয় পাই। নাগেশ কুকুনুরের ছবি না দেখলে আমি সিনেমা করতে আসতাম না। আমার অনুপ্রেরণা উনি। নাগেশও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে সিনেমাই বানাতে চেয়েছিলাম। শেষে ইনফোসিস ছেড়ে এসআরএফটিআই জয়েন করি। (হাসি)
আপনাদের দ্বিতীয় ছবি ‘মন পতঙ্গ’-র কাজও তো প্রায় শেষ?
শর্মিষ্ঠা : হ্যাঁ, প্রায় অনেকটা। সবকিছু ঠিকঠাক চললে সামনের বছর রিলিজের ইচ্ছে।