কিছু ছবি পরিচালকরা বানান শুধুমাত্র বড় পর্দার জন্য, কিছু পর্দা তৈরি হয় শুধুমাত্র কিছু ছবির জন্য। ঠিক পর্দা আর ঠিক ছবির মিলন যখন হয়, তখন তৈরি হয় এপিক। নন্দন ১-এর মতো আন্তর্জাতিক স্তরের পর্দা, প্রোজেকশন, সাউন্ড সিস্টেম আর ড্যানিশ পরিচালক নিকলাজ আরসেল-এর সাম্প্রতিক ছবি ‘দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’, পর্দা আর সিনেমার মেলবন্ধনের মারমার কাটকাট দাপট।
মাঝে মাঝেই শুনি শোরগোল ওঠে ‘নন্দন এক চাই, নন্দন এক চাই’; বলতে একটুও সংশয় নেই পরে দেখি ছবিটি মোবাইল বা খুব বেশি হলে টিভির পর্দার জন্য বানানো। একটি কম্পোজিশনও বড় পর্দার জন্য নয়। শ্যালো ফোকাসে টেলিলেন্সে ক্লোজ আপের ছড়াছড়ি, নিদেনপক্ষে কিছু মাস্টার শট, মিড-লং-এ। তাতে আমার অসুবিধে নেই, কিন্তু নন্দনের পর্দার যদি প্রাণ থাকত, তাহলে সে ম্রিয়মান হয়ে পড়ত। আর গতকাল, আরসেল-এর ছবির পর পর্দা তৃপ্ত, চওড়া হাসি হাসছিল। বস্তুত, ‘দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমি প্রথমেই বলব ছবিটির অনবদ্য ক্লাসিক ভিসুয়াল ন্যারেটিভের কথা।
সত্যি বলতে, এই ছবি যেন ভিসুয়াল স্টোরি টেলিং-এর বাইবেল। বস্তুত এমন নিটোল, নিখুঁত, অনবদ্য একটি গল্প গড়ে তোলা– সময় নিয়ে, প্লট এবং চরিত্র ধরে, জিওগ্রাফি এবং ক্লাইমেটকে সঙ্গে নিয়ে, নিখুঁত ডিটেইলিং– অনেকদিন পর কনটেম্পোরারি কোনও ছবিতে দেখলাম। ছবিটি ক্লাসিক্যাল ইউরোপিয়ান জঁরের। যে জঁর আর নেই বললেই চলে। সবচেয়ে যেটা ভালো লাগল, হলিউড পিরিয়োডিক সিনেমার যে স্টাইল; এত বছর হলিউডে রমরমিয়ে কাজ করার পরেও পরিচালক নিকোলাজ আরসেল তার ধারপাশ দিয়েও যাননি। তাঁর ছবি যাবতীয় হলিউডি মালমশলা দূরে রেখে মৌলিক স্বকীয় রেসিপিতে বানানো।
১৭৫৫-এ, এক রিটায়ার্ড সোলজার, লুডভিগ কেহলান ডেনমার্কের এক অনুর্বর, অভিশপ্ত জমিতে ফসল ফলানোর মিশন নিয়ে আসেন। একরের পর একর বিস্তৃত এই জমি কাঁকর আর বালিতে ভরা, কিছু আগাছা ছাড়া আর অন্য কোনও কিছু ফলাতে অক্ষম। অথচ এই ‘হিথ’ ডেনমার্কের রাজার বড় প্রিয়। বছরের পর বছর রাজার ইচ্ছেতে এখানে চাষ-আবাদের চেষ্টা হয়েছে এবং বারবার সব প্রকল্পই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমত সময়ে লুডভিগের আবির্ভাব– সে এই জমিতে ফসল ফলানোর জন্য তৈরি, তার নিজস্ব সামান্য জমানো পুঁজিতেই। বরাবরই রাজার চেয়ে তাঁর পরিষদদের ল্যাজ বেশি মোটা, মন্ত্রীদের দুর্নীতির ইতিহাসের কোনও শুরু নেই, কোনও শেষও নেই। এক্ষেত্রেও প্রধান মন্ত্রী একটি বিশাল বড় কাঠি নিয়ে লুডভিগের পিছনে পড়ে গেল। কিছুটা বাধ্য হয়েই তাকে ‘হিথ’-এ পাঠাল বটে, কিন্তু কোনও রকম ব্যবস্থাপনা এবং সাহায্য ছাড়াই। এদিকে, ‘হিথ’-এ যার সাম্রাজ্য, সেই ফ্রেডরিক ডি সিনকেল শাসকের মূর্তিমান প্রতিভূ, সে মনে করে ওই হিথ তার, ওই জল-জমি-জঙ্গল তার, এই পৃথিবী তার, পৃথিবীর সব নারী তার ভোগ্য, পুরুষগুলো ছারপোকা, গরম কল ঢেলে তাদের মেরে সরিয়ে দিতে পারলেই ব্যস কেল্লা ফতে। এমন কিছুই যা তার পাওয়ার বা ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, তা সে মেনে নেবে না। সিনকেল, ঠিক যেমন শাসকদের হয়, ভয় পেয়ে যায় লুডভিগের আগমনে– সত্যিই যদি এই গরিব জেদি লোকটা রাজার পেয়ারের হিথে ফসল ফলাতে পারে, তাহলে রাজা এখানে নতুন সেটেলমেন্টের পত্তন করবেন, লুডভিগ হবে সেই সেটেলমেন্টের ব্যারন, তারই মতো বা তার চেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী। তা তো হতে দেওয়া যায় না। লুডভিগকে আঁটকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে সিনকেল। সিনকেলের চরিত্র, তার কীর্তিকলাপ দেখে শিউরে চোখ বন্ধ করতে হয়; সিনকেলের চরিত্র, তার কীর্তিকলাপ আমাদের চোখ খুলে দেয়– ক্ষমতার লোভ যে কী ভয়ংকর, শাসকের মুখ যে কত বীভৎস, রুখে দাঁড়ানো যে কত জরুরি, তা বুঝিয়ে ছাড়ে।
লুডভিগের চরিত্রে ডাকসাইটে ড্যানিশ অভিনেতা ম্যাডস মিকেলসেন এক কথায় ‘পারফেক্ট’! অনবদ্য এক পরিশীলিত এবং ইন্টেন্স অভিনয় করেছেন তিনি। আন্ডার অ্যাক্টিং-এর শেষ কথা। লুডভিগ-এর অ্যামবিশন, নিজেকে প্রমাণ করার জন্য, নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য তার নীরব, অবসেসিভ জেদ, যা মাঝে মাঝে স্বার্থপর পাগলামি হয়ে ওঠে, আবার একই সঙ্গে তার আশ্চর্য দৃঢ়চেতা আদর্শবাদ, কিছুতেই মাথা না নোয়ানো, তার কোমল-কঠোর হৃদয়টি তাকে সত্যিই শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক নায়ক করে তোলে। প্রসঙ্গত, ‘দ্য প্রমিসড ল্যান্ড’-এর আসল নাম, ড্যানিশ নাম, ‘Bastarden’, অর্থাৎ ‘বাস্টার্ড’– পিতৃপরিচয়হীন জারজ সন্তান। লুডভিগের মা কোনও ব্যারনের মহলের পরিচারিকা ছিলেন, বাবা সেই ব্যারন। লুডভিগের দাঁতে দাঁত চাপা ব্যক্তি লড়াই ঘিরে তৈরি হয় শাসক আর সাধারণের লড়াইয়ের গল্প, অবদমনের বিদ্রোহের গল্প– এই ছবির পৃথিবী, যুদ্ধ। সবচেয়ে মজা লেগেছে এই ছবির আশ্চর্য একটি ট্যুইস্টে। এপিক হিরো লুডভিগ কিন্তু ছবিটির আসল হিরো নয়। সে হল আরও নিভৃতে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠা এক আপামর নারী, আনা বারবারা; শয়তানের নিধনকারী। আনা বারবারা-র চরিত্রে আমান্ডা কলিন-এর অভিনয় চাবুকের মতো। সিনকেলকে যে চড়টি সে কষায়, তার জো়ড় না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, এবং সেই শটের অনবদ্য অ্যাঙ্গেল, লো অ্যাঙ্গেল, ওয়াইড লেন্স, মিড-লং শট বা কাউবয় শট– Masterful technical execution of idea. ‘Bastarden’ একটি অনুচ্চারিত শক্তিশালী প্রেমের গল্পও বটে। এত অপূর্ব সুন্দর এক মিলন দৃশ্য সৃষ্টির জন্য পরিচালককে সাধুবাদ। আনা বারবারা-র চরিত্রটি, কালো ছোট্ট বেজাতের মেয়েটি আনমাই মুস– যে এই ছবিটির প্রাণ, ছবিটিকে ভায়োলেন্স নির্ভর না করে জার্নি-কেন্দ্রিক করা, বীরগাথা না বানিয়ে মানুষের গল্প করে তোলা, এই সবই নিকোলাজ আরসেলের মাস্টার স্ট্রোক বা শিল্পীর সিগনেচার আখর, যেগুলি ছবিটিকে দিয়েছে নতুন মাত্রা, করে তুলেছে contemporary বা fragmented classic অথবা new age epic– যেখানে লড়াইয়ের থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায় মানুষ।
দ্য প্রমিসড ল্যান্ড
পরিচালক: নিকোলাজ আরসেল