Robbar

সত্যজিৎ থেকে সৃজিত: বাঙালির ব্যোমকেশ বিচিত্রা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 16, 2023 11:56 pm
  • Updated:March 30, 2024 3:28 pm  

পর্দায় ব‌্যোমকেশের জনপ্রিয়তা অমলিন। কখনও ব‌্যোমকেশ বাঙালি মধ‌্যবিত্ত পুরুষ, কখনও প্রেমিক, কখনও বুদ্ধিদীপ্ত ধারালো সত‌্যান্বেষী। ব‌্যোমকেশের নানা রূপ উঠে এসেছে নানা সিনেমায়। তারই একঝলক তুলে আনলেন শম্পালী মৌলিক।

শম্পালী মৌলিক

‘আমি নেতাও নই, অভিনেতাও নই। চিনলেন কী করে?’ নবতম ব‌্যোমকেশ-ছবির জনপ্রিয় সংলাপ। নায়ক দেবের মুখে ‘ব‌্যোমকেশ ও দুর্গরহস‌্য’-র টিজারে এমন ডায়লগে দুষ্টু ট্রোলারদের প্রতিক্রিয়া– ‘চিনলাম উচ্চারণ শুনে!’ ১১ আগস্ট অ‌্যাসিড টেস্ট পেরলেন দেব। বাঙালির পছন্দের আইকনিক চরিত্র হয়ে ওঠার জন‌্য সর্বোচ্চ ঝুঁকি তিনি নিয়ে ফেলেছেন। তবে, এ ব‌্যোমকেশ অন‌্য ধারার। সত‌্যান্বেষীর অ‌্যাকশন-অবতার ডমিনেট করেছে চরিত্রটিকে। শরদিন্দু বন্দ‌্যোপাধ‌্যায়ের সৃষ্ট সত‌্যান্বেষীর সঙ্গে তার বিস্তর ব‌্যবধান। বরং অতি নায়কত্ব আরোপ করা হয়েছে ব‌্যোমকেশে। ধুতি-পাঞ্জাবি নয়, বেশিরভাগ সময় সে শার্ট-প‌্যান্ট পরেছে। সিনেমার প্রয়োজনে উত্তেজনার মূহূর্তে সত‌্যান্বেষী হিন্দিও বলেছে। প্রশ্নোত্তর পর্বের চেয়ে তার স্মিত হাসি যেন রহস‌্যের জাল ছিড়তে যেন বেশি কার্যকর! এখন প্রশ্ন সাহিত‌্যাশ্রয়ী ছবিতে কতটা সিনেম‌্যাটিক লিবার্টি নেওয়া যায়। নবতম ব‌্যোমকেশের সঙ্গে কি বাকি ব‌্যোমকেশ অভিনেতাদের একসারিতে রাখা যাবে?

‘ব‌্যোমকেশ বক্সী’ তো শরদিন্দু বন্দ‌্যোপাধ‌্যায়ের সৃষ্ট একটি চরিত্র মাত্র নয়, এ হল বাঙালির আবেগ। উপস্থিত বুদ্ধি, অর্ন্তদৃষ্টিতে যার জুড়ি নেই। যুগে যুগে বহু অভিনেতা এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অথচ, এখনও পর্দায় ব‌্যোমকেশের জনপ্রিয়তা অমলিন। ‘চিড়িয়াখানা’-র উত্তমকুমার বাঙালির মনে চিরস্থায়ী। ১৯৬৭ সালের সেই ছবির মাধ‌্যমে গোয়েন্দা গল্প নিয়ে প্রথম সিনেমা করেন সত‌্যজিৎ রায়। ‘চিড়িয়াখানা’ মুক্তির পরে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ভাল ছিল না, ধীরগতির চিত্রনাট‌্যের কারণে। তবে উত্তমকুমারের অভিনয় দর্শক-সমালোচকের প্রশংসা পেয়েছিল। সত‌্যজিৎ সেরা পরিচালক আর শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন উত্তমকুমার। পরবর্তীকালে মধ‌্যবিত্ত-বুদ্ধিমান বাঙালির মনে যেন ব‌্যোমকেশ-বিগ্রহের স্বরূপ সেট হয়ে যায় ওই ছবির মাধ‌্যমে। এখানেই মহানায়কের সাফল‌্য। তারপরে ১৯৭৪ সালে শ‌্যামল ঘোষাল (ব‌্যোমকেশ) অভিনীত, মঞ্জু দে পরিচালিত ‘সজারুর কাঁটা’-ও দর্শকের পছন্দ হয়েছিল।

কিন্তু ব‌্যোমকেশকে দেখতে সত‌্যি কেমন? সে তো কাল্পনিক চরিত্র। শোনা যায়, শরদিন্দু তাঁর চেহারার আদলেই সত‌্যান্বেষীকে গড়েছিলেন। পরবর্তীকালে অনেকে ব‌্যোমকেশ হয়েছেন, কিন্তু ছাপ ফেলেছেন কয়েকজন মাত্র। তার মধ‌্যে হিন্দিতে রজিত কাপুরের নাম আসবেই। নয়ের দশকে বাসু চট্টোপাধ‌্যায়ের পরিচালনায় দারুণ সফল হন রজিত কাপুর। দূরদর্শনে সেই শো দেখত আট থেকে আশি। ১৯৯৩ সালে একটানা প্রায় ১৪টি এপিসোড, তারপরে ১৯৯৭ সালে সম্ভবত ২০টি পর্ব সম্প্রচারিত হয়েছিল। রজিত কাপুরকে এখনও দর্শক ভোলেনি ব‌্যোমকেশ হিসেবে।

 

 

বড়পর্দায় অঞ্জন দত্ত-র হাত ধরে ‘আবির-ভাব’ হয় ব‌্যোমকেশ বক্সীর, সেটা ২০১০ সাল। ‘আদিম রিপু’ গল্প দিয়ে শুরু, অঞ্জন-আবির জুটি তিনটি ছবি করে ‘ব‌্যোমকেশ বক্সী’, ‘আবার ব‌্যোমকেশ’ ও ‘ব‌্যোমকেশ ফিরে এল’। আবিরকে আধুনিক, বুদ্ধিদীপ্ত বাঙালির প্রতিনিধি হিসেবে সিনেপ্রেমীরা ভালবেসে ফেলেন। তাঁর স্পষ্ট সংলাপ ছোড়ার ধরন, চাউনি মনে ধরে। আর শাশ্বত চট্টোপাধ‌্যায় অজিত হিসাবে তাঁর পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন নিখুঁতভাবে। এই আবিরই যখন অরিন্দম শীলের হাত ধরে ‘হর হর ব‌্যোমকেশ’, ‘ব‌্যোমকেশ-পর্ব’, ‘ব‌্যোমকেশ-গোত্র’ বা ‘ব‌্যোমকেশ হত‌্যামঞ্চ’ করেছেন– তাঁর ইন্টেলিজেন্সের পাশাপাশি উঠে এসেছিল কেয়ারিং ইমেজ, তার প্রেমিক সত্তা। সবমিলিয়ে বড়পর্দায় সত‌্যান্বেষীরূপে আবির তর্কাতীতভাবে এ যুগের দর্শকের প্রথম পছন্দ।

যিশু সেনগুপ্ত-ও অঞ্জন দত্ত-র ব‌্যোমকেশ হয়েছিলেন তিনটি ছবিতে, ২০১৫ সাল থেকে শুরু। তিনি ছিলেন ‘ব‌্যোমকেশ বক্সী’, ‘ব‌্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা’ এবং ‘ব‌্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ’ ছবিতে। বেশ সফল হয়েছিলেন, কারণ অভিনয়ের স্বতন্ত্র ধরন। যিশু আগে থেকে কোনও আইকনিক চরিত্রের ভার বহন করেননি, ফলে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি ভদ্রলোকের ভূমিকায় তাঁকে গ্রহণ করতে অসুবিধা হয়নি এলিট দর্শকের। মার্জিত স্ক্রিন-প্রেজেন্স আর বুদ্ধির খেলায় যিশু সত‌্যান্বেষীকে ধারণ করেন সহজেই।

২০১৩ সালে সম্পূর্ণ অন‌্য ধরনের ব‌্যোমকেশ পর্দায় এনেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ‘চোরাবালি’ গল্পের বড় চমক কাস্টিং। পরিচালক সুজয় ঘোষ ব‌্যোমকেশ আর অজিতের চরিত্রে ছিলেন অনিন্দ‌্য চট্টোপাধ‌্যায়। ‘সত‌্যান্বেষী’ ঋতুপর্ণ ঘোষের শেষ ছবি। ২০১৩ সালে ৩০ মে তিনি প্রয়াত হন। ছবির সিংহভাগ কাজ তিনি শেষ করেছিলেন, তবে ‘সত‌্যান্বেষী’র সামান‌্য কাজ তখনও বাকি ছিল। তারপর ছবিটি মুক্তি পায় ওই বছরেই সেপ্টেম্বরে। সুজয় ঘোষ ব‌্যোমকেশ হিসেবে সফল হননি, কিন্তু দর্শক সেই সারপ্রাইজ কাস্টিং মনে রেখেছে এখনও।

দিবাকর বন্দ‌্যোপাধ‌্যায়ের ‘ডিটেকটিভ ব‌্যোমকেশ বক্সী’ রূপে নজর কাড়েন সুশান্ত সিং রাজপুত, ২০১৫ সালে। পরিচালকের অনবদ‌্য নির্মাণ কৌশল ছবিটিকে এগিয়ে দিয়েছিল। যদিও এরপরে দিবাকর আর ব‌্যোমকেশ করেননি, এখনও পর্যন্ত।

ওই বছরেই বাংলায় প্রবীণ ব‌্যোমকেশ হিসেবে দর্শকের সামনে আসেন ধৃতিমান চট্টোপাধ‌্যায়। শৈবাল মিত্র-র ‘শজারুর কাঁটা’ ছিল সেই ছবি। কিন্তু খুব বেশি সংখ‌্যক দর্শক বয়স্ক ব‌্যোমকেশকে গ্রহণ করতে পারেননি। এছাড়া টেলিভিশনে গৌরব চক্রবর্তী সফল হয়েছিলেন তরুণ প্রজন্মের ব‌্যোমকেশ হিসেবে (২০১৪)। শুভ্রজিৎ দত্ত ব‌্যোমকেশ রূপে পর্দায় এসেছিলেন ‘মগ্ন মৈনাক’ ছবিতে। কিন্তু দুর্বল মেকিংয়ের কারণে তা দর্শকের মনে ধরেনি। ‘মগ্ন মৈনাক’ নিয়েই সায়ন্তন ঘোষাল বানিয়েছিলেন ‘সত‌্যান্বেষী ব‌্যোমকেশ’ সিনেমা, ২০১৯ সালে। পরমব্রত মলাটচরিত্রে। কিন্তু তেমন ছাপ রাখেনি সে ছবিও। এঁরা ছাড়াও আরও কয়েকজন ‘ব‌্যোমকেশ’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তবে দর্শকমনে বিরাট দাগ কাটেনি সেই সব কাজ।

২০১৭ সাল থেকে ওয়েব প্ল‌্যাটফর্মে এল ‘ব‌্যোমকেশ’। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ধারালো অভিনয় এবং অভিনব অ‌্যাপ্রোচের কারণে বাঙালি তাঁকে গ্রহণ করেছে সত‌্যান্বেষীর চরিত্রে। বিভিন্ন সময় এই সিরিজ পরিচালনা করেছেন সায়ন্তন ঘোষাল, সৌমিক চট্টোপাধ‌্যায়, সৌমিক হালদার ও সুদীপ্ত রায়। শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ব‌্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল’ বেশ ডার্ক হওয়া সত্ত্বেও দর্শকের ভাল লেগেছে। অনির্বাণের নির্বাচন সর্বসম্মত শুরু থেকেই। তাঁর সাফল‌্যের কারণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ‌্যায়ের পরে অনির্বাণ হলেন সেই অভিনেতা, যিনি ইন্টেলেকচুয়াল কোশেন্ট ও এন্টারটেনিং কোশেন্ট সমানভাবে ধারণ করতে পেরেছেন চরিত্রে। এবার সেই ব‌্যোমকেশ সিরিজের পরিচালনায় সৃজিত মুখোপাধ‌্যায়। সোহিনী সরকার ‘সত‌্যবতী’, আর রাহুল ‘অজিত’। তাঁরা সিরিজ করছেন ‘দুর্গরহস‌্য’ গল্প নিয়ে। এই গল্পের আধারেই বিরসা দাশগুপ্তর পরিচালনায় এসেছে দেবের ব‌্যোমকেশ। সত‌্যবতী রুক্মিণী আর অজিত অম্বরীশ ভট্টাচার্য। দেব জানতেন পিছনে এতজন ব‌্যোমকেশের ছায়া, তবু তিনি চ‌্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কারণ সুপারস্টারের অদম‌্য আকাঙ্ক্ষা। ব‌্যাটে-বলে বক্স অফিসে বাউন্ডারির চেষ্টা তাঁকে করতেই হত। ফলে দুর্গরক্ষার জন‌্য ব‌্যোমকেশের স্টান্সটাই তিনি বদলে নিলেন। ফলে ব‌্যোমকেশ সন্দেহভাজনকে প্রশ্ন করার সময় ক‌্যামেরার ক্লোজ-আপ শটে তাঁকে কেমন দেখ‌াচ্ছে, সে প্রশ্ন খানিক গৌণ হয়ে গেল।