হিন্দি ‘গাইড’ রিলিজ হল। দর্শক এল না। ডিস্ট্রিবিউটররা ফোন করলেন; বললেন, লোকসান চলছে তাঁদের, ভরসা করা উচিত হয়নি সিনেমাটা নিয়ে। দেব আনন্দ সমেত সবাই মুষড়ে পড়লেন। কয়েক দিন পর, সেইসব ডিস্ট্রিবিউটরের ফোন আসতে শুরু করল আবার, ‘নবকেতন’-এর অফিসে। সিনেমা হলে দর্শক উপচে উঠছে, সারা দেশে! মানুষের মুখে মুখে ফিরছে প্রশংসা! উপর্যুপরি অনুরোধ আসছে রেডিওতে, ‘গাইড’-এর গান চালানো হোক!
ছয়ের দশকের গোড়ায়, আর. কে. নারায়ণের কাছে, একদিন একটা চিঠি এল: ‘আমার নামটা হয়তো অপরিচিত, আমি একজন অ্যাক্টর-প্রোডিউসার।’ লিখেছেন চির-নম্র দেব আনন্দ।
বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, ‘হম দোনো’ দেখানোর সময়ে, দেব আনন্দের আলাপ হয়েছিল নোবেল-জয়ী লেখিকা পার্ল বাক আর ডিরেক্টর ট্যাড ড্যানিয়েলিউস্কির সঙ্গে। তাঁরা দু’জনে তখন একটা ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি খুলেছেন; দেব আনন্দকে বললেন, ‘সম্পূর্ণ ভারতীয় কাস্ট নিয়ে, ভারতীয় লোকেশনে, একটা ভারতীয় নভেলের হলিউড ফিল্ম বানাব… উড ইউ প্লিজ জয়েন আস?’
শুনে, তিনি প্রথমে উপন্যাসটা পড়লেন, লন্ডনে। সিদ্ধান্ত নিলেন, এই বই থেকে সিনেমা হবে দুটো ভাষায়– ইংরেজিতেও, হিন্দিতেও। গল্পের কপিরাইট পেতে, খোঁজ লাগালেন লেখকের। খবর পেলেন, নারায়ণ নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক পৌঁছলেন তিনি। সেখান থেকে লস এঞ্জেলস। মোটামুটি অর্ধেক পৃথিবী ঢুঁড়ে, শেষমেশ জানতে পারলেন নারায়ণ তখন মাইসোরে। চিঠির উত্তর আসা-মাত্তর অক্লান্ত দেব আনন্দ আমেরিকা থেকে বম্বে হয়ে, বেঙ্গালুরু এসে, আরও কয়েকশো মাইল গাড়ি চালিয়ে, পৌঁছলেন ইয়ারাবাগিরি, লেখকের বাড়িতে।
নারায়ণের অধিকাংশ কাহিনির পটভূমি, মালগুড়ি; জায়গাটা দিকশূন্যপুরের মতো, বাস্তবে নেই। ওরকম অনেকগুলো গল্প নিয়ে, পরে ‘মালগুড়ি ডেজ’ হয়েছিল। ‘রেলওয়ে রাজু’-ও ছিল মালগুড়ির বাসিন্দা। পার্ল আর ট্যাডের বাহিনি নিয়ে, রাজুর এলাকা চেনাতে বেরোলেন লেখক– কাবেরি নদী, নাঞ্জাঙ্গুড়ের পথঘাট, কাবিনিতে তীর্থযাত্রীদের স্নান, গোপালস্বামীর জঙ্গল-পাহাড়…।
কয়েক মাস পর, তিনি টের পেলেন রাজুকে নিয়ে যাওয়া হবে উত্তর-পশ্চিম ভারতে। রাজু, রোজি, মার্কো– প্রত্যেকের চরিত্রে ও ঘটনায় কিছু-না-কিছু বদলও হবে, সিনেমার সুবিধার্থে। যুক্তির ঘেরাটোপে হেরে গেল লেখকের আবেগ। নারায়ণ দেখলেন, পশ্চিমি পরিচালক প্রশ্ন করেন; কিন্তু, উত্তর শোনার ধৈর্য রাখেন না। জুহুর বিলাসবহুল হোটেলে, হলিউড ইউনিটের মিটিংয়ে বসে, নারায়ণ বুঝলেন, এরা ভারতকে না জেনে ইন্ডিয়াতে পৌঁছতে চায়। কয়েক বছর আগে, কলকাতায়, তাঁর কথা হয়েছিল সত্যজিতের সঙ্গে। সত্যজিতের পছন্দ ছিল ‘গাইড’, সিনেমার বীজ হিসেবে। কিন্তু, দিকদর্শী পরিচালক সন্দেহ করেছিলেন নিজেকেই; বলেছিলেন, ‘ভারতের ওইদিকটা আমি ঠিক ফোটাতে পারব না…’।
এসবের মাঝে, দেব আনন্দের স্বপ্ন একটাই– ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্বের দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়া। তুমুল তোড়জোড়ে তিনি শুরু করলেন ‘গাইড’-এর কাজ। বাজেট বাঁচাতে, প্ল্যান করলেন, প্রতিটা সিকোয়েন্স ইংরেজিতে শুট করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দিতেও শুট হবে। হিন্দিতে পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন চেতন আনন্দ। শুটিংয়ের শুরুতেই, ঝামেলা বাঁধল ট্যাড আর চেতনের। দু’জনের ক্রিয়েটিভ ডিফারেন্সে কাজ প্রায় পণ্ড হওয়ার জোগাড়! দেব আনন্দ ঠিক করলেন, ইংরেজির কাজ শেষ করে, হিন্দিটা শুরু করবেন।
ইংরেজি ভার্সনের শুটিং চলল ৮ সপ্তাহ ধরে। ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যগুলো রাখা হল মৃতপ্রায় যমুনা-তীরে, দিল্লির ওখলায়। জায়গাটা পুরোপুরি রুক্ষ, কালেভদ্রে বৃষ্টি হয়। বিশাল সেট বানানো হল, ৩০টা ট্রাক-ভর্তি লোকজন-মালপত্র নিয়ে গিয়ে। সব রেডি; পরদিন ভোরবেলায় সন্ন্যাসী উপবাসে বসবেন। মাঝরাতে খবর এল, সিমলায় আচমকা হড়পা-বান নেমে, যমুনা ফুঁসে উঠেছে ভয়ংকর! হুড়োহুড়ি করে, হাঁটু-জল থেকে, কোনওক্রমে উদ্ধার করা হল যন্ত্রপাতি, জিনিসপত্র।
পুরো সেট আবার বানানো হল গুজরাটে, সুরেন্দ্রনগরের লিম্বড়িতে, ভোগাবো নদীর ধারে। সন্ন্যাসী উপবাসে বসলেন; শয্যাশায়ী হলেন; রেনপাইপে বর্ষা এল; গ্রামবাসীরা কলকলিয়ে উঠলেন। ঠিক যে-মুহূর্তে ঘোষণা হল ‘প্যাক আপ!’– তক্ষুনি আকাশ কালো করে, ঝাঁপিয়ে নামল ঝড়-বৃষ্টি! লিম্বড়িতে এরকম দুর্যোগ, বোধহয়, এর আগে-পরে কেউ দেখেননি।
আরও পড়ুন: ভারতের প্রথম অভিনেতা যিনি সেক্রেটারি রেখেছিলেন
অবশেষে, তৈরি হল ইংরেজি ‘গাইড’। কিন্তু, কোথাও কেউ পাত্তা দিলেন না; সিনেমাটা থুবড়ে পড়ল। উৎসাহে ভাঁটা পড়ল না দেব আনন্দের; নেমে পড়লেন হিন্দি ‘গাইড’-এর আয়োজনে। ইন্ডাস্ট্রিতে কানাঘুষো শুরু হল, ‘মাথাটা নির্ঘাত গেছে!’ তিনি অটুট; স্থির জানতেন, পাগলামি না থাকলে আর্ট হয় না।
পরিচালনার জন্য এবার ভাবা হল রাজ খোসলার কথা। শুনেই, বেঁকে বসলেন ওয়াহিদা। ‘সোলওয়াঁ সাল’-এর সময় থেকেই দু’জনের মনোমালিন্য চলছিল। দেব আনন্দ বোঝালেন, ‘পুরনো কথা ভুলে যাও।’ ওয়াহিদা একরোখা। এর আগে, ইংরেজি ভার্সনে যৌন-দৃশ্যগুলো করতে চাননি তিনি; সেগুলোতে বডি ডাবল নিতে হয়েছিল। হিন্দি ভার্সনে, রোজির চরিত্রে একে-একে ভাবা হল, সায়রা বানু বা বৈজয়ন্তীমালা। কিন্তু, ব্যাপারটা জমল না। কিছুদিন পর, খোসলা ছেড়ে দিলেন কাজটা। শেষমেশ ওয়াহিদাকে নিয়েই, পরিচালনায় এলেন বিজয় আনন্দ। ওদিকে, অসুস্থ হয়ে, শয্যা নিলেন শচীন কত্তা। অন্য কেউ হলে, হয়তো, এরকম অবস্থায় সুরারোপের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতেন। দেব আনন্দ অটল, ‘মিউজিক তো দাদা হি করেঙ্গে…’।
ঝামেলা কি-আর ফুরোয়! এবার কেন্দ্রীয় সরকারের নজর পড়ল এদিকে। পরকীয়া নিয়ে আপত্তি জানালেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী সত্যনারায়ণ সিনহা। দেব আনন্দ যুক্তি দিলেন, ‘যে উপন্যাসের জন্য লেখক সাহিত্য অ্যাকাডেমি পেলেন, সেই কাহিনি থেকেই ফিল্ম বানালে কী অসুবিধে!’ দিল্লি থেকে আজ্ঞা এল, স্বামীকে ছেড়ে রোজি কেন রাজুর সঙ্গে থাকবে, জাস্টিফাই করা দরকার। নইলে, ‘ভারতীয় নারীত্বে’ ছিঃ ছিঃ পড়ে যাবে। মার্কোকে তাই, নতুন স্ক্রিপ্টে, আরও নিষ্ঠুর করে তোলা হল।
হিন্দি ‘গাইড’ রিলিজ হল। দর্শক এল না। ডিস্ট্রিবিউটররা ফোন করলেন; বললেন, লোকসান চলছে তাঁদের, ভরসা করা উচিত হয়নি সিনেমাটা নিয়ে। দেব আনন্দ সমেত সবাই মুষড়ে পড়লেন। কয়েক দিন পর, সেইসব ডিস্ট্রিবিউটরের ফোন আসতে শুরু করল আবার, ‘নবকেতন’-এর অফিসে। সিনেমাহলে দর্শক উপচে উঠছে, সারা দেশে! মানুষের মুখে মুখে ফিরছে প্রশংসা! উপর্যুপরি অনুরোধ আসছে রেডিওতে, ‘গাইড’-এর গান চালানো হোক!
ঝিন্টি আদৌ বৃষ্টি হতে পেরেছিল কি না, বলা মুশকিল। তবে, বৃষ্টির আশ্চর্য নিবিড় সম্পর্ক ছিল ‘গাইড’-এর সঙ্গে। বম্বেতে, সে বছর, মনসুন আসতে খুব দেরি হচ্ছিল; গরমে সকলে হাঁসফাঁস; সারা শহরে সাংঘাতিক জলকষ্ট। ঠিক ‘গাইড’ রিলিজের দিন, মায়ানগরীর মাথায়, আছড়ে পড়ল যুবতী মেঘের দল। রাতারাতি নতুন পোস্টার ছাপানো হল, ক্যাচলাইনে লেখা হল: ‘বর্ষা এনেছে গাইড!’