তিনি জনি ওয়াকার। অন্যান্য কমেডিয়ানের তুলনায় প্রায়-রাতারাতি জনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেছিলেন যে, ডিস্ট্রিবিউটররা তাঁর লিপে গান বসাতে জোরাজুরি করতেন; সেজন্য বাড়তি লগ্নিও করতেন তাঁরা। জনপ্রিয়তা এতদূর যে, ‘ছুমন্তর’-এর মোটামুটি-সিরিয়াস গান ‘গরিব জান কে হাম কো না…’-তেও পাবলিক সিটি-তালি বাজিয়ে হুল্লোড় করত। ‘আনন্দ’-এ কান্নার দৃশ্যে সত্যিই কেঁদেছিলেন তিনি, ওটা গ্লিসারিন ছিল না।
বাড়িতে অনেকগুলো পেট, এদিকে বাস কনডাক্টরের চাকরিতে মাইনে মোটে ২৬ টাকা। অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে পরিবারের কয়েকজন মারা গেছিল। তবু দমেননি বদরুদ্দিন কাজি। ট্রিপের ফাঁকে ফাঁকে, দাদারের বাস টার্মিনাসে লোকজনের মনোরঞ্জন করতেন নানা অঙ্গভঙ্গি করে। একলব্য বদরুদ্দিনের দ্রোণাচার্য ছিলেন অভিনেতা নুর মহম্মদ চার্লি। একদিন কাজির কীর্তিকলাপ দেখে, বলরাজ সাহানি তাঁকে নিয়ে গেলেন গুরু দত্তর কাছে। গুরু দত্ত তখন দেব আনন্দের সঙ্গে আলোচনা করছেন ‘বাজি’ নিয়ে। স্টুডিওতে ঢুকে, মাতাল বদরুদ্দিন ঘেঁটে সব ঘ করে দিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, বিরক্ত হওয়ার বদলে গোটা ইউনিট হেসেই কুপোকাৎ!
অবাক গুরু দত্ত খোঁজ নিয়ে জানলেন, মানুষটা আসলে মাতালের অভিনয় করছেন; আদতে মদ ও তামাকের চৌহদ্দিতে থাকেন না। এর আগে কাজ করেছেন ‘আখরি পয়গাম’-এ। গুরু তখুনি ‘বাজি’-র স্ক্রিপ্টে নতুন চরিত্র বসালেন; তাঁকে কাস্ট করলেন; হুইস্কির প্রিয় ব্র্যান্ড উৎসর্গ করে নবাগতর নাম রাখলেন ‘জনি ওয়াকার’। ‘বাজি’-র সাফল্যের পর, প্রতিটা স্ক্রিপ্ট লেখার সময়ে, অবশ্যই জনির জন্য একটা চরিত্র ভাবতেন গুরু; গুরুত্ব সহকারে, জনির মতামত নিতেন। ইউনিটের প্রত্যেককে লক্ষ করতেন, জনির কোন কোন ইম্প্রোভাইজেশনে তাঁরা হাসি সামলাতে পারছেন না। শুধু হাসানো নয়; সেই চরিত্রে থাকত গান; থাকত প্রেম; ভবঘুরে, মাতাল, হকার, নায়কের বন্ধু– যা-ই হোক, সেই চরিত্র শুধু ভাঁড়ামো করত না, বরং ওতপ্রোতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেত কাহিনিকে। অন্যান্য কমেডিয়ানের তুলনায় প্রায়-রাতারাতি জনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেছিলেন যে, ডিস্ট্রিবিউটররা তাঁর লিপে গান বসাতে জোরাজুরি করতেন; সেজন্য বাড়তি লগ্নিও করতেন তাঁরা। জনপ্রিয়তা এতদূর যে, ‘ছুমন্তর’-এর মোটামুটি-সিরিয়াস গান ‘গরিব জান কে হাম কো না…’-তেও পাবলিক সিটি-তালি বাজিয়ে হুল্লোড় করত। ‘আনন্দ’-এ কান্নার দৃশ্যে সত্যিই কেঁদেছিলেন তিনি, ওটা গ্লিসারিন ছিল না।
শিল্পী ও ব্যক্তি-মানুষ কতটা পৃথক হতে পারেন– সম্ভবত জনি তার উদাহরণ। জীবনযাপনে অত্যন্ত শান্ত, চুপচাপ, সিরিয়াস। তাঁর আসল কণ্ঠস্বরও ছিল আলাদা। শুধুমাত্র পর্দার জন্য ওই উচ্চারণ, ওই থ্রোয়িং তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর বিপরীতে অভিনেত্রীরা, জৌলুশে ও পারদর্শিতায়, নায়িকার থেকে কিছু কম যেতেন না। তাঁদের সঙ্গে, রোম্যান্টিক সিকোয়েন্সেও, সবসময় সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখতেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন সহ-অভিনেত্রী নুরজাহানকে, যাঁর দিদি প্রখ্যাত অভিনেত্রী শাকিলা। কিন্তু, সন্তানদের গায়ে গ্ল্যামারের আঁচ আসতে দেননি কখনও। অথচ, মহম্মদ রফি, মেহমুদ, শাম্মি কাপুর, গুরু দত্ত, মজরুহ সুলতানপুরি, নৌশাদ, দিলীপ কুমার, সায়রা বানুর মতো স্টারদের সঙ্গে ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। ইদের দিন ‘গ্যালাক্সি’ সিনেমাহলে পুরো পরিবারের জন্য কেটে ফেলতেন ৩০-৪০টা টিকিট। আবার, ছেলে-মেয়েদের বলতেন, পাড়ার পুরনো ‘পকোড়েওয়ালে চাচা’-র দোকান থেকেই শিঙাড়া নিয়ে আসতে; যাতে সেই গরিব মানুষটারও দু’-পয়সা রোজগার হয়।
বন্ধুত্ব আর পরিবার– এ দুইয়ের আগে কিছুই ছিল না তাঁর জীবনে। মিডিয়ায় লেখালেখি হত, ‘মেহমুদ খা গয়া জনি ওয়াকার কো…’ সঙ্গোপনে, দু’জনেই এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। পরিচিত বৃত্তে কেউ অসুস্থ হলে বা কারও দুঃসংবাদ এলে, দুয়া পড়তেন তাঁর নামে। গুরু দত্তর হঠাৎ মৃত্যুর সময়ে, জনি আর ওয়াহিদা রেহমান শুটিং করছিলেন চেন্নাইতে (তখন, মাদ্রাজ)। কাজ থামিয়ে, দু’জনেই হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসেছিলেন চির-পিয়াসার পাশে। জনির মারা যাওয়ার খবর শুনে, মেহমুদ কেঁদে ফেলেছিলেন, ‘ভাইজান কি ইয়াদ আয়ি…’
জীবনের শুরুতে সবজিও বেচেছেন জনি। দারিদ্রের কারণে ক্লাস সিক্সের বেশি পড়তে পারেননি, সে নিয়ে আফসোসও করতেন; তাই, নিজের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা সুনিশ্চিত করেছিলেন। ফিল্মি রোশনাইতে ধাঁধিয়ে যাননি; অথচ, যেকোনও স্টারকে টেক্কা দিতে পারতেন। তিনি ছিলেন দেশের প্রথম অভিনেতা, যিনি সেক্রেটারি রেখেছিলেন। তিনিই ইন্ডাস্ট্রির প্রথম, যিনি রবিবারে কাজ করা বন্ধ করেছিলেন। একটা সময় বম্বের রাস্তায় চলন্ত ট্যাক্সির ৮০ শতাংশের মালিক ছিলেন জনি ওয়াকার।
***
শিশুর মতো এসব বলছিলেন জনি-কন্যা তাসনিম। বলছিলেন, “আব্বু থামতে জানতেন; বলতেন, ‘এভারেস্টে উঠেছি, এবার নামতে তো হবে!’… বলতেন, ‘ঘর হ্যায়, বাচ্চে হ্যায়, গাড়ি হ্যায়, টেলিফোন হ্যায়… অর ক্যা চাহিয়ে?’… ছাত্রী-জীবনে যখন বাড়ি ফিরতাম, বান্দ্রার পেরি ক্রস রোডের মোড়ে বাসটা দাঁড়ালে, কনডাক্টর চেঁচাতেন, ‘জনি ওয়াকার বাসস্টপ, জনি ওয়াকার বাসস্টপ!’… ঠিক উলটোদিকেই আমাদের বাড়ি ছিল ‘নুর ভিলা’… ভাবতাম, কয়েক বছর আগে আব্বুও হয়তো এই বাসেই কনডাক্টর ছিলেন, এই স্টপেজেই হয়তো প্যাসেঞ্জারদের নামাতেন…”
বলতে বলতে ক্রমশ ভারি হচ্ছিল তাসনিমের স্বর; ঝাপসা হচ্ছিল আমাদের দৃষ্টি। আমরা আশপাশে একটা মানুষকে আপ্রাণ খুঁজছিলাম, যাকে আচমকা আঁকড়ে ধরে বলতে পারি, ‘আরেঃ, মুরারিলাল! চিনতে পারছিস?’
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved