এই সিরিজ আমাদের ফিরিয়ে দিল হেমন্তের বিষাদ, বসন্তের হাহারব, যা একটা বয়সের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে। আমাদেরও জীবনের সমান্তরালে ছিল বন্দুকের নল আর বকুলতলা, আমাদের নিজস্ব ‘গানস অ্যান্ড গুলাবস’।
‘একটি দিনের একটি বিকেল
একটি ছাদের, একটি কোণে
একটি কিশোর আকাশটাকে
মাখছে গায়ে, মাখছে মনে
সে দৃশ্যটাই দেখতে দেখতে
সময় যখন অন্যমনা
সেই সময়ের শরিক হতে
আমার এমন কাঙালপনা’
গোধূলিবেলা। বেসামাল আকাশ। ‘কনে দেখা আলো’ নামটা কখনও পছন্দ হয়নি আমাদের। আমরা ওইরকম বিকেলে আকাশরাঙানো আলোয় নিজেদের দেখেছি। দেখেছি, শৈশবের রোদেলা দিন আলো থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে নিকষ কালোয়, মাঝে ওইটুকু আমাদের শ্বাস নেওয়ার জায়গা। ভারী কথায়, ‘বয়ঃসন্ধি’। আমাদের কাছে দিন-রাতের ইন্টারভাল। হাফটাইম। বিরতি। আর ওই বিরতিতেই আমাদের যাবতীয় ভালবাসা এবং হারাকিরি, কাম-রাঙা ঠোঁট কামড়ানো এবং ঠোঁটের কোণের রক্ত চেনা, দগদগে ক্ষতচিহ্ন এবং কাল্পনিক লিপস্টিকের ছোপ নিয়ে আমাদের লালচে কৈশোর-বিকেল। আমরা যখন রাজনৈতিকভাবে উত্তাল চারপাশ দেখছি, তখন আমাদের একটা খেলনা পিস্তল ছিল। নামেই খেলনা, চেহারায় আসলি, হাতে নিলেই ভারিক্কি। ভরা হরতালের দিন উত্তর কলকাতার রাস্তায় দু’জন ক.পু., অর্থাৎ কলকাতা পুলিশের নাকের ডগায় সেই পিস্তল আংটি করে আমরা শিস দিয়ে বেরিয়েছি, আরও সন্ত্রাস বাড়াতে রাস্তার মাঝখানে রেখে দিয়ে এসেছি সেই প্রক্সির পিস্তল। পুলিশরা আমাদের বেয়াদবি দেখেছিল নিস্পৃহভাবে। আগের প্রজন্মের থেকে শোনা, নকশাল আমলে কারফিউর মাঝে রকে বসে আড্ডা মারা কিশোরদের তুলে নিয়ে যাওয়া কালান্তক পুলিশ জিপ কোথায়, আর কোথায় দেড় দশক আগের সেই বনধের দিনের পুলিশ!
আর এমন ধুলোখেলা বন্দুকবাজির সময়ই আমরা ব্যথাতুর হয়েছিলাম। প্রেম নীরবে আসেনি, একবারও নয়। কিন্তু যতবার এসেছে, এসেছে গোপনে। তা প্রকাশ করার ধক যাদের ছিল, তারাই তো আমাদের সুপারহিরো! উল্টো করে ঝোলা স্পাইডারম্যানের চুম্বনের মতো দুঃসাহসী! আর আমরা ছিলাম জমায়েতে। যে জমায়েত হাঁ করে দেখত প্রেম-করিয়েদের। যে জমায়েত ব্যর্থতাটুকু গিলে নিত, প্রত্যাখ্যানে মুখ চুন করত কয়েক লহমা, তারপরেই মেতে উঠত আলগা খিস্তি অথবা বন্ধু-সমভিব্যহারে পাড়াবাজিতে। এই ছিল আমাদের বন্দুকজীবন, হাপিত্যেশ, আদতে অহিংস, শুধু খানিক হিংসার ছলাকলা, বিজ্ঞাপনের ভাষায়, ‘আম জিন্দেগি’। আর উল্টোস্রোতে ছিল বাকিদের গোলাপজীবন। যা আদতে আমাদের মতো নিরীহ নয়, আসল বন্দুক তাদেরই হাতে মানাবে, ভালবাসার দিব্যি খেয়ে তারা দুনিয়া কাঁপাতে পারে, বেপরোয়া।
আর এই দুই জীবনের বাইরে ছিল প্রকৃত টেরর। যাদের মুখ দেখলে বোঝা যেত, এদের সঙ্গে কিচাইন করা যাবে না মোটেও। এমনই কেউ একবার কোনও স্কুলের হেডস্যরকে গিয়ে সপাট বলেছিল, ‘চারটে অবধি স্কুলটা আপনার, পাঁচটার পর থেকে রাস্তাটা আমাদের।’ মাঠেও এদের সঙ্গে ফাউল করা যায় না, মাঠের বাইরেও নয়। করলেই পেনাল্টি অবধারিত!
নেটফ্লিক্সে রাজ এবং ডিকে-র ‘গানস অ্যান্ড গুলাবস’-এর রঙে আমাদের সেইসব বিকেল উঠল রাঙা হয়ে। আমাদের জীবনে বিস্তীর্ণ আফিমখেত ছিল না, তবে নেশা ছিল। লোকাল কোনও দাউদ নিশ্চয়ই ছিল, তারা গাঞ্চি বা নাবিদের চেয়ে কম খতরনাক, এটুকুই। আমাদের জীবনে হাড়হিম করা আগন্তুক ভাড়াটে খুনি ছিল না, তবে এসব বিপজ্জনক ঘটলে, তা ততটাই রোমান্টিক হত, যতটা রোমাঞ্চকর। আমাদের জীবনে ছোটু বা জুগনু অবশ্যই ছিল, আমরা তাদের চিনতেও পারিনি। অর্জুনের মতো দুঁদে পুলিশ ছিল না, তবে অমন অনেক ঘরোয়া বা সরকারি মাস্টারমশায় ছিল। আর নিশ্চয়ই ছিল কোনও দিলদার টিপু, কোনও ‘বন্ধুর প্রেম আমাদের প্রেম’ কসম খাওয়া সুনীলের মতো হরিহর আত্মা বন্ধু, নান্নু-গঙ্গারামের মতো ফার্স্ট বয় এবং ফেল মারার জুটি, জো-এর মতো ভিনদেশি তারারা, বান্টির মতো নতুন বন্ধুরা, এবং আমাদের স্বপ্নের চন্দ্রলেখারা। যাদের জন্য আমরা কেঁদেছি, কিন্তু মনে হয়েছে, তাদের সামনেই কাঁদলে বুঝি মনের ভার নামত অনেকটা।
রাজ এবং ডিকে-র এই সিরিজের গুলাবগঞ্জ আমাদের হয়তো কোয়েন ব্রাদার্সের ছবি এবং নোয়া হলের সিরিজ ‘ফার্গো’ মনে করাতে পারে, হয়তো ব্ল্যাক কমেডির প্রতিটি পরতে অনায়াস রক্তাভ খুনখারাপি আমাদের মনে করিয়ে দেবে তারান্তিনোর কালজয়ী ‘পাল্প ফিকশন’, হয়তো কোথাও উঁকিঝুঁকি মারছেন স্টিফেন কিং, খুব সূক্ষ্মভাবে; কিন্তু এই গুলাবগঞ্জের শরীরে দানা বেঁধে আছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, তাঁর অদ্ভুতুড়ে ইউনিভার্স নিয়ে, এখানে খেলে বেড়াচ্ছে অঞ্জন দত্ত-র ‘চ্যাপটা গোলাপ’-এর সুর, একচিলতে স্বপনকুমার, দু’-ছটাক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় টেনিদাসুলভ কেরামতিতে, হয়তো কোথাও ঘাপটি মেরেছেন সত্যজিৎ, সবসময়ই ছোটবেলাকে শর্তহীনভাবে জিতিয়ে দেওয়ার মঙ্গলময়তা নিয়ে। গুলাবগঞ্জে শুরুতেই রক্ত ঝরে, তখনই আশপাশে নিজের শরীরে আগুনের ছাপে দুই ব্যর্থ কিশোর ভালবাসার নাম লিখতে চাইছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মস্তানের নামের শেষে টাইগার। তাকেই খতম করে নতুন ত্রাস, যে এসেছে বাইরে থেকে, তার নাম আত্মারাম। এভাবে মাইক্রো স্তরে ক্ষমতার বদলের সাক্ষী হয় গঙ্গারাম, যে ‘সৎ পাত্র’-র মতোই উনিশবার এবং ম্যাট্রিকে না হলেও, ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায় অনেকবার ঘায়েল। তাকে টাইগার কিছু বলে কানে কানে। ফার্স্ট বয় নান্নুও সুপারি নেয়, তবে খুনের নয়, ভালবাসার। সে প্রাক-মোবাইল, বিশ্বায়নের ছোঁয়াচ বাঁচানো গুলাবগঞ্জে বসে ইংরেজি গান শুনতে শুনতে সাহেবদের ভাষায় লেখে প্রেমপত্র, সেই প্রেমপত্রে ছড়িয়ে দেয় দিদির পিঙ্ক মাম্বা। পরে বোঝা যাবে এক ডাক্তার ও নার্সের সংলাপে, এই পিঙ্ক মাম্বা চুপিসারে গুলাবগঞ্জের ইশকের সুগন্ধি, অভিসারের আতর। নান্নু প্রেমে পড়ে ইংরেজি উপন্যাস পড়তে চায়। আফিম-মাফিয়াদের বেতাজ নরক-সাম্রাজ্যে আসে নতুন, সৎ, আদর্শবান পুলিশ অফিসার, যে আবার ফ্যামিলি ম্যানও বটে। সেই অঞ্জন চৌধুরী-রঞ্জিত মল্লিক সমন্বয় মনে পড়তেই পারত, যদি না গিরগিটির মতো সেই পুলিশও রং বদলাত। আর লাস্ট বেঞ্চের পুরুষকেন্দ্রিক বাস্তুতন্ত্র ভাঙতে আসে জো, নান্নুর মতো চৌকস ভাল ছাত্রও তার সামনে ইংরেজি বলতে গিয়ে থমকায়। গাঞ্চি সস্তায় সিঁড়ি বানাতে গিয়ে পপাত চ এবং প্রায় মমার চ হয়। আর রহস্যময়তায়, টেনশনে জুগনু আস্তে আস্তে কাঁধে নেয় সেই সাম্রাজ্য। টিপু নেহাত আশিক মেকানিক থেকে আস্তে আস্তে রাজা হয়। আবার গাঞ্চি-নাবিদ চিরকালীন দ্বন্দ্বের এই কুরুক্ষেত্রে কলকাতার ডন এসে ঢোকে, একেবারে শোভরাজীয় পোশাকে। আর আসে আত্মারাম, যার নাম শুনেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় সকলের। তার সাতটা জীবন, ভিডিও গেমের মতোই। শীর্ষেন্দুসুলভ ক্লাইম্যাক্সেই ছোট্ট গ্রামে শুরু হয় তুমুল নৈরাজ্য।
রাজকুমার রাও হয়তো ‘লুডো’-তে তাঁর চরিত্রের মতোই, কিন্তু তাঁর জন্যই টিপুকে ভালবেসে ফেলা যায়। গুলশন দেভাইয়া-র আত্মারাম তাঁর মতো অভিনেতাকে জাত চেনানোর সুযোগ দেয়, এরকম অভিনয় নিয়ে শব্দ খরচ নিরর্থক, বারবার দেখেও তারিফ কম পড়বে। দুলকার সলমন তীক্ষ্ণ। সতীশ কৌশিক, টি. জে ভানু পার্বতীমূর্তি এই সিরিজের প্রাপ্তি। তবে সবাইকেই ছাপিয়ে লাইমলাইট কেড়েছেন আদর্শ গৌরব। তাঁর হয়ে উঠতে চাওয়া গ্যাংস্টারের নখ কখনও শানানো, কখনও বা দ্রব চোখের জলে। আর এই সিরিজের মেরুদণ্ড হয়ে ওঠা কিশোর চরিত্রে কৃশ রাও, তানিশক্ চৌধুরী, সুহানি শেঠিদের ভোলার নয়। আর বাঙালি হিসেবে ছাতি ফুলবেই রজতাভ দত্তর জন্য। ‘কামিনে’-তে কয়েক ঝলক তাঁকে দেখেছিল জাতীয় স্তরের দর্শক, এই সিরিজ জুড়ে তাঁর চমকপ্রদ উপস্থিতি অপূর্ব আনন্দ দিল।
ভয় নয়, অভিমানে শুকিয়ে আসে গলা। দমবন্ধ থ্রিলের মধ্যেও হাসির ছররা, ভালবাসার টোটা জমায় ‘গানস অ্যান্ড গুলাবস’, হত্যা এবং প্রতিহিংসাও এখানে রঙিন হয়, পুরুষ চরিত্রে ভরা সিরিজে পিতৃতন্ত্র পিছলে যায় অন্য দ্রোহে। আলো এবং রঙের ব্যবহার থেকে সংগীত-ভাবনা, চিত্রনাট্য থেকে সম্পাদনা, টাইটেল কার্ডের অবিশ্বাস্য প্রয়োগ– জমজমাট নির্মাণে এই সিরিজ যা দিল, তা অনেকটা শিল্পের তৃপ্তি, বাকিটা ব্যক্তিগত। আমাদের এই সিরিজ ফিরিয়ে দিল হেমন্তের বিষাদ, বসন্তের হাহারব, যা একটা বয়সের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে। আমাদেরও জীবনের সমান্তরালে ছিল বন্দুকের নল আর বকুলতলা, আমাদের নিজস্ব ‘গানস অ্যান্ড গুলাবস’।
‘একটি বিকেল শেষ হল যেই,
একটি তারা উঠল জ্বলে
হয়তো তোমার জানলা খোলা
সেই তারাটাই দেখবে বলে’