‘আমি প্লুটো’ প্রযোজনায় অনমিত্র খাঁ বাংলার দর্শককে ড্রয়িংরুম ড্রামার ক্লান্তি থেকে প্রায় ঘাড় ধরে বের করে নিয়ে গিয়ে ফেলছেন ‘ইটি’, ‘হ্যারি পটার’, ‘প্যানস ল্যাব্রিন্থ’-এর ঝকঝকে, ফুরফুরে, ম্যাজিক-রিয়াল দুনিয়ায়।
সহজ নয়। ছোটদের দিয়ে বড়দের গল্প বলা সহজ নয়। নাটকের মতো লাইভ অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়ামে বলা তো একেবারেই সহজ নয়। বিশেষ করে তার আধার যদি হয় রূপকথা এবং কল্পবিজ্ঞান। অথচ পৃথিবীজুড়ে এমনটাই ঘটে। বড়দের যুদ্ধের ভার শিশুদের বইতে হয়। রাজনীতির যুদ্ধে, ক্ষমতার যুদ্ধে, ধর্মের যুদ্ধে, অর্থের যুদ্ধে ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ হয়ে যায় অজস্র শিশু কিংবা আরও বড় অর্থে ধরলে ইনোসেন্স, মানুষের কালেক্টিভ ইনোসেন্স। নষ্ট হয়ে যায় মানুষের ঘর, শিকড়। এই ধ্বংসের গল্পকে ফেয়ারিটেল-এর মোড়কে মঞ্চে নিয়ে এলেন ‘বিডন স্ট্রিট শুভম’ সম্প্রদায় এবং পরিচালক অনমিত্র খাঁ।
একটা লম্বা সময় ধরে বাংলা থিয়েটার প্রাচীনের ভারে, ধ্রুপদীর ভারে ধুঁকছিল। হাতে গোনা সামান্য দু’-চারটি উদাহরণ ছাড়া নাট্যের বিষয় বা ফর্মকে অভ্যেসের বাইরে, ফর্মুলার বাইরে, নিয়মের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারছিলাম না আমরা। নতুন নাটক হচ্ছিল অনেক, কিন্তু নতুন বাংলা থিয়েটার হচ্ছিল কই? কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে ক’জন যুবা পরিচালক তাদের নিজস্ব ভাষায়, নতুন ক্রাফটে, আধুনিকতায় বাংলা নাট্যের নিয়ম ভাঙতে শুরু করেছেন, তাঁদের মধ্যে অনমিত্র অন্যতম। ‘আমি প্লুটো’ প্রযোজনায় অনমিত্র বাংলার দর্শককে ড্রয়িংরুম ড্রামার ক্লান্তি থেকে প্রায় ঘাড় ধরে বের করে নিয়ে গিয়ে ফেলছেন ‘ইটি’, ‘হ্যারি পটার’, ‘প্যানস ল্যাব্রিন্থ’-এর ঝকঝকে, ফুরফুরে, ম্যাজিক-রিয়াল দুনিয়ায় এবং একদল আশ্চর্য শিশু (কেউ কেউ মনে, কেউ কেউ বয়সে) অভিনেতার দল নাচে-গানে সংলাপে সেই মায়ায় সকলকে ভাসিয়ে রাখছে সোয়া দুই ঘন্টা। এ দৃশ্য নতুন এবং আনন্দের। যে তিনটি ছবির নাম বললাম, সবগুলিতেই মানুষের লোভ, ক্ষমতার উল্লাস, ইনোসেন্সের সঙ্গে ভায়োলেন্সের বিরোধ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে, কিন্তু রূপকথার মোড়কে। ‘আমি প্লুটো’ এই কাহিনিধারার যোগ্য উত্তরসূরি। মানুষের খেয়ালে, ইচ্ছেয় ক্ষুদ্রতম গ্রহ প্লুটো তার গ্রহত্ব হারিয়ে, বাসা হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে আশ্রয় পায় পৃথিবীর শিশু প্লুটোর কাছে। কলকাতায় নেমে আসে প্লুটোর শীত। স্নো-ফল হয় ভিক্টোরিয়ায়, আসে অকাল ক্রিসমাস। কিন্তু সে মায়া ক্ষণস্থায়ী। মানুষের দাঁত-নখ বেরিয়ে আসে ক’দিনেই। নিজেদের পাপে ধ্বংস হতে বসা পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য বলি দেওয়ার আয়োজন করা হয় প্লুটোর। শুরু হয় অসম লড়াই। ক্ষমতাবান লোভী বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কয়েকজন শিশুর লড়াই। প্লুটোকে বাঁচানোর এবং তার গ্রহত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই। ইনোসেন্সের ওপর আক্রমণ দেখানো হলে মানুষের হিংসা সবচেয়ে নগ্ন হয়ে ধরা দেয় কে না জানে। তাই প্লুটোর লড়াইয়ের সঙ্গে মিশে যায় সিরিয়ার, রাশিয়ার, কলম্বিয়ার, বাংলাদেশের যুদ্ধ-আক্রান্ত শিশুদের কথা। কিন্তু উপরে উল্লেখ করা চলচ্চিত্রগুলোর মতোই অনমিত্র তার নাটকে কোথাও রূপকথার এবং কল্পবিজ্ঞানের নির্মাণ থেকে একচুল সরে আসেন না। কোথাও এই ভায়োলেন্সের দৃশ্যায়ন আমাদের ম্যাজিক দেখার আনন্দকে মাটি করে না, কিন্তু প্রশ্নগুলো উসকে দেয় ঠিক। পরবর্তী প্রজন্মকে আশা দেখায় বন্দুকের নলে গোলাপ ফুটিয়ে তোলার। মনে করিয়ে দেয় মানুষের মধ্যে যেটুকু ভাল আছে, তার জোর কতটা। লেখায়, নির্মাণে, পারফরম্যান্সে শুরু থেকে শেষ অবধি সৎ থাকতে পারে বিডন স্ট্রিট শুভমের ‘আমি প্লুটো’। এবং এই কৃতিত্ব একা অনমিত্রের নয়।
গ্রহ প্লুটোর চরিত্রে সুদীপ ধাড়ার অভিনয় এই নাটকের সম্পদ। কী আশ্চর্য ক্ষমতায় এই নাটকের বাস্তব ও অবাস্তবকে তিনি তার অভিনয়ে ধারণ করেন, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বাংলা থিয়েটারে আধুনিক অভিনয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে থাকবে সুদীপের পারফরম্যান্স। যোগ্য সঙ্গত করেছেন তিন মুখ্য শিশুশিল্পী। প্লুটো চরিত্রে দেবরূপ দত্ত ভৌমিক, নীলের চরিত্রে আসমান দত্ত এবং রূপসার ভূমিকায় স্বরগীতি মোদক। এই নাটকে বড়দের পারফরম্যান্সও চমৎকার, কিন্তু ছোটরা তাদের চেয়ে অন্তত দুই গোলে এগিয়ে থাকবেন। শুভঙ্কর দে-র আলো, ঋতব্রত জোয়ারদার ও সমরেন্দ্র সিন্হার গ্রাফিক্স, সৌমিক চক্রবর্তী ও স্বাধীন গাঙ্গুলীর মঞ্চ, অস্মিতা খাঁ-এর পোশাক এবং শেখ ইস্রাফিলের রূপসজ্জা শূন্য প্রসেনিয়ামে যে ফ্যান্টাসিল্যান্ডের জন্ম দেয়, তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য সব পেইন্টিং দেখছি বলে মনে হয়। কালার ডিস্ট্রিবিউশনের প্রতি এতখানি মনোযোগ বাংলা মঞ্চে ইদানীং বিশেষ চোখে পড়ে না। এঁদের প্রত্যেকের কাজ নিয়েই আলাদা করে এক প্যারাগ্রাফ লেখা চলে। চমকে যেতে হয় উজান চ্যাটার্জীর ভিডিওগ্রাফি এবং পর্দার দৃশ্য ও মঞ্চের অভিনয়ের সমন্বয় দেখে। ‘আমি প্লুটো’ যে বাংলা মঞ্চে ভিজুয়াল আর্টস ও প্রযুক্তির প্রয়োগকে একলাফে কয়েকধাপ এগিয়ে দিয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। প্লুটোর বিভিন্ন গ্রহদের কাছে সাহায্য চাইতে যাওয়া এবং বিতাড়িত হওয়ার দৃশ্যে, কিংবা ইন্টারভ্যালের ঠিক আগে যে দৃশ্যে নীল জোনাকি খুঁজতে খুঁজতে জোনাকিদের মধ্যেই হারিয়ে যায় আর ফিরে আসে না, স্তম্ভিত হয়ে দেখতে হয় ভাবনা এবং প্রয়োগের মেলবন্ধন ঠিক কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে। মনভোলানো কোরিওগ্রাফি করেছেন দেবকুমার পাল। নাটকের আবহ তৈরি করেছেন পরিচালক অনমিত্র নিজেই।
হয়তো স্টিভ মেটসগার অনুপ্রাণিত এই নাটকের সংলাপ মাঝে মাঝে আরেকটু মজবুত হতে পারত। হয়তো এই নাটকের ক্লাইম্যাক্স প্রথমার্ধ্বের তুলনায় সামান্য দুর্বল, কিন্তু এই দু’-একটা সামান্য অভিযোগ-অভিমান বাকি সমস্ত কিছু দিয়ে ভুলিয়ে দেয় ‘শুভম’-এর টিম। ‘আমি প্লুটো’ দেখুন। বাংলা নাট্যমঞ্চে নতুনদের ঝড় উঠুক। আরও এমন অসাধ্য সাধন হোক।
পুনশ্চ: এন্ড-ক্রেডিটটা না দেখে বেরবেন না কিন্তু।