মনোজ বাজপাই বলেছিলেন, ‘Once a migrant, always a migrant…’. আগরতলা বা কুমিল্লা, ছেড়ে এসে, কলকাতায় মন টিকত না শচীন দেব বর্মনের। অবাক হতেন, এখানে মাটিও বিক্রি হয়, এ কেমন জায়গা! বম্বে এসেও হাঁপিয়ে গেলেন। কোথাও একটা নদী নেই! সুর বাঁধবেন কেমনে!
হিন্দুস্তান রোড জায়গাটা তখন জংলা, নির্জন। কবি যতীন বাগচির বাড়ি ছিল সেখানে। প্রায়দিন বিকেলে আড্ডা বসত তাঁর বৈঠকখানায়। আসতেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো নক্ষত্ররা। একদিন, রাত ৯টায়, বাড়ির পিছনদিকের জানলায় খুটখুট! কী ব্যাপার? জানলা খুলে দেখা গেল, হেমেন রায়, হাসছেন; সঙ্গে রোগা-পাতলা একজন, অচেনা। হেমেন জানালেন, তিনি কয়েকটা গান লিখেছেন, ইনি গেয়ে শোনাবেন। জমায়েত ভাঙার মুখে, ফেরার জোগাড়ে বাকিরা; তবুও, ভদ্রতায় নিমরাজি, ‘আচ্ছা, গাও!’ একটার পর একটা গান শুরু করলেন আগরতলার তরুণ। আর, সুরস্নিগ্ধ হতে থাকল কলকাতার রাত।
আরও কয়েক বছর পর। যোধপুরের মহারাজা উমেদ সিংয়ের প্রাসাদে, এক বিশাল সংগীত মহাসভা। মুখ্য দায়িত্বে, আলি আকবর খাঁ। মেহফিল-এ-অঞ্জুমে আছেন ফৈয়াজ খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, নিখিল ঘোষ, পান্নালাল ঘোষ, আহমেদ জান থিরক্ওয়া…। এঁদের মাঝে, পল্লিগীতি গাইবেন সেই বাঙাল যুবক। অনুষ্ঠানের দিন সকালে, হারমোনিয়াম নিয়ে, রিহার্সালে বসলেন তিনি; সঙ্গতে নিখিল, পান্নালাল, আহমেদ জান।
দুপুরের কাছাকাছি, সারেঙ্গির ঈশ্বর বন্দু খাঁ, লোটা হাতে, বেরিয়েছিলেন প্রাকৃতিক কম্মে। তখনকার দিনে, ‘অ্যাটাচড টয়লেট’ জিনিসটা মোটামুটি ব্রাত্য। প্রাসাদের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে, শিল্পী-অতিথিদের তাঁবু পেরিয়ে, দূরের ঝোপঝাড়ে যেতে হবে তাঁকে। হাঁটতে হাঁটতে কানে এল, হাই-পিচ্ড কণ্ঠে ভেসে আসছে, ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে…’ মুহূর্তে মন্ত্রমুগ্ধ ঈশ্বর, ভুলে গেলেন কোথায় যাচ্ছিলেন! লোটা ফেলে দিয়ে, তাঁবুতে ফিরে, তুলে নিলেন বাদ্যযন্ত্র; ঢুকে পড়লেন যুবক শচীনের তাঁবুতে। সংগীত সম্বন্ধে কণা-ধারণা থাকলে, পাঠক নিশ্চয়ই আন্দাজ করছেন, এরপর সেখানে কী অমৃতনদী…!
কুমিল্লায় থাকাকালীন শচীন দেববর্মণের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রপাত নজরুল ইসলামের। নজরুলকে তিনি ডাকতেন, ‘কাজিদা’। নজরুল তাঁকে বলতেন, ‘চাটগেঁয়ে’; যদিও চট্টগ্রামের সঙ্গে শচীনের কোনও সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। কুমিল্লায় এলে, নজরুল যেতেন ইয়ং মেন’স ক্লাবে; শচীনও পৌঁছতেন সেখানে। কান্দিরপাড় আর তালপুকুরের আশপাশে জমে উঠত দু’জনের আড্ডা। শোনা যায়, এখানেই নজরুল লিখেছিলেন, ‘বাবুদের তালপুকুরে…’।
চরিত্রে ও ভূগোলে, দু’জন দুই মেরুর– একজন সুদূর পুববাংলার, অন্যজন সুদূর পশ্চিমবাংলার। শচীন ধীর-স্থির, নজরুল উদ্দাম। কোথাও গেলে, নজরুল জমকালো সাজতেন; বলতেন, ‘আমি মানুষকে বিভ্রান্ত করব, আমার সম্ভ্রান্ত হওয়ার দরকার নেই…।’ আর, শচীনের পোশাক সাদামাটা, চিরকাল। এত অমিলেও, দু’জনের মিল সুরেলা হৃদয়ে, সংগীতে। শচীনের সুরারোপিত বহু গানে ছিল নজরুলের উচ্চকিত ছোঁয়া।
এহেন দুই বন্ধুকে বাঁধতে চাইলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, ‘নন্দিনী’ সিনেমায়। শচীন আবদার করলেন, ‘টিকলিশ’ টিউনে গান বাঁধতে হবে। মাত্র কয়েক মিনিটে লিখে, সুর বসালেন নজরুল, ‘চোখ গেল, চোখ গেল…’। রেকর্ডিংয়ে, কাজিসাহেবের নাকানিচোবানি। শচীন কিছুতেই কলকাতার ‘মান্য’ বাংলা ধরতে পারছেন না; পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে বারবার গাইছেন, ‘চক গেল, চক গেল…’ (এখানে, ‘চক’-টা লিখে বোঝানো মুশকিল; পাঠক, প্লিজ, বুঝে নিন)। ঠিকঠাক রেকর্ড করতে, নজরুল নাজেহাল। শচীনের পুরো কেরিয়ারে, এটাই একমাত্র গান, যেটা অন্য কারও সুরে কোনও সিনেমায় তিনি গেয়েছিলেন।
রাজবাড়ির নিশ্চিন্ত আরাম ছেড়ে, কলকাতায় এসেছিলেন শচীন। বাবা মারা যেতে, বন্ধ হল রাজকোষের মাসোহারা। একখানা ঘর ভাড়া নিলেন ভবানীপুরে। ক’দিন পর, রেওয়াজ শুনে, বাড়িওলা ধমকালেন, ‘সাতসকালে কাকের মতো চেঁচাও কেন!’ ধাক্কা খেয়ে, এলেন পালিত স্ট্রিটে, ভাড়াবাড়িতে। শুরু করলেন গানের টিউশনি। সঙ্গে, নানা জলসায়, জমায়েতে, সুযোগ পেলেই, গাওয়া। সুযোগ আসছিল বাংলা গান গাওয়ার, গাইছিলেনও; তবে, চাইছিলেন হিন্দি গানেও ট্রাই করতে। রেকর্ডিংয়ের পর জানলেন, তাঁর বদলে গাইবেন পাহাড়ি সান্যাল; প্রবাসী হিসেবে তাঁর হিন্দি, স্বাভাবিকভাবেই, শচীনের থেকে ভাল। নিউ থিয়েটার্সে চেষ্টা করলেন মিউজিক ডিরেক্টর হওয়ার; কিন্তু, সেখানে আগেই আছেন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক।
ব্যর্থতা ছিল ঢের। ডাহা ফেল করলেন এইচএমভি-র অডিশনে, ১৯৩১-এ; বলা হল, তাঁর উচ্চারণ ও কণ্ঠস্বর রেকর্ডিংয়ের অনুপযুক্ত। যদিও, ততদিনে, তাঁর প্রতিভা জেনে গেছে সংগীতমহল। ঠিক পরের বছর, চণ্ডীচরণ সাহার নতুন কোম্পানি ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’ (এখন, ‘ইনরেকো’) থেকে বেরল তাঁর প্রথম গ্রামোফোন। কয়েক বছরের মধ্যে, শচীন হয়ে উঠলেন কলকাতার ব্যস্ততম গায়ক। তিনের দশকে, এ শহরে, এমন জলসা দুর্লভ, যেখানে তিনি গাননি। জনপ্রিয়তার দৌলতে, বিজ্ঞাপনের মডেলও হয়েছিলেন তিনি।
নাম-যশ-অর্থ সবই হল, বছর দশেকের মধ্যে। বাড়ি বানালেন, বিয়ে করলেন, সন্তান হল। কিন্তু, ওই… মাথায় কী-একটা পোকা কামড়ায়! যেরকম কাজ করতে চাইছিলেন, অনেক চেষ্টা করেও, কলকাতায় সেটা হচ্ছিল না। বম্বে যাওয়ার ডাক ফিরিয়ে দিলেন প্রথমবার; দ্বিতীয়বার আর ভাবলেন না। কল্লোলিনীর প্রতি খানিক ক্ষোভ নিয়েই, প্রতিষ্ঠিত জীবন ফেলে, উঠে পড়লেন বম্বের ট্রেনে। সঙ্গে, সদ্য-সাজানো সংসার আর এক টলমল শিশু। ভারত সমেত সারা দুনিয়ার অবস্থা তখন দ্বিধা-মগ্ন।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে গেলেন তাঁদের, বম্বের শেষমাথায়, বোরিভেলিতে (তখন পাণ্ডববর্জিত), ছোট্ট আস্তানায়। কিছুদিন পর, এক গুজরাতি পরিবারে, ফ্ল্যাট ভাড়া পেলেন। গুজরাতি সংস্কারে সাধারণত আমিষ খাওয়াটা খুনের শামিল। এদিকে, চিরবাঙালি শচীনের মাছ ছাড়া চলে না। একদিন সকালে রান্নার সময়ে, ঢুকে পড়লেন বাড়িওলি! কত্তা-গিন্নি আর কাজের মেয়ে সূর্যমণি, হুড়োতাড়া করে, ধুপ জ্বালিয়ে, মাছের গন্ধ তাড়ানোর চেষ্টায়!
মনোজ বাজপাই বলেছিলেন, ‘Once a migrant, always a migrant…’. আগরতলা বা কুমিল্লা, ছেড়ে এসে, কলকাতায় মন টিকত না শচীনের। অবাক হতেন, এখানে মাটিও বিক্রি হয়, এ কেমন জায়গা! বম্বে এসেও হাঁপিয়ে গেলেন। কোথাও একটা নদী নেই! সুর বাঁধবেন কেমনে! গুরু দত্ত তাঁকে একটা গাড়ি দিলেন। ফাঁক পেলেই, সেই গাড়ি নিয়ে চলে যেতেন পওয়াই। সারাদিন লেকে ছিপ ফেলে, বসে থাকতেন জলের দিকে তাকিয়ে। বারবার ভাবতেন, আবার কলকাতায় ফিরে যাবেন। তাঁরই একটা গান, যেন তাঁর জীবনেরই প্রতিধ্বনি: ‘ওহাঁ কন হ্যায় তেরা, মুসাফির, যায়েগা কাহাঁ…’
কিশোর কুমারকে ‘বড় ছেলে’ মানতেন শচীন। রাহুল আর কিশোর ছিলেন গাঢ় বন্ধু। দুই ছেলের কাছে, শচীন স্মৃতিচারণ করতেন ফেলে-আসা উন্মুক্ত সবুজ, নদীনালা, অপার নীলিমা; বোঝাতে চাইতেন ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার চলন। এদিকে, রাহুল আর কিশোর, শচীনের মুখে ‘ভাটিয়ালি’ শব্দটা শুনলেই, নিজেদের মধ্যে কিছু-একটা ইশারা করে, হো হো হাসতেন। সে ইশারার নিহিতার্থ কী ছিল, আশা ভোঁসলে কখনও টের পাননি।