সেই সব মেয়েরা যারা দূর দেশ থেকে এসেছে, যারা ‘হিন্দি’ বা ‘ইংরেজি’ জানে না, যে মেয়েদের এখানেই সন্তান প্রসব করতে হয়, এখানেই সন্তান মানুষ করতে হয়, যে মেয়েদের উকিল নিযুক্ত করার সামর্থ নেই, ধৈর্য ধরে এই অসম্ভব ক্লান্তিকর সরকারি আইন সহায়তা ব্যবস্থার সঙ্গে যুঝতে হয়, যে মেয়েরা মাসের পর মাস তাদের পরিবার পরিজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি, শুধুমাত্র কোনও যোগাযোগের নম্বর জোগাড় করে উঠতে পারেনি বলে, তাদের ‘বাড়ির’ চিঠিরও কোনও উত্তর আসেনি কখনও, সেইসব ‘অপরাধী’ মেয়েরা, যারা কাঠামোগত শোষণের বন্দি। আমি আমার সহবন্দিদের কথা চিঠিতে লিখতে পারব না, কিন্তু এই কারাগারের একটা নাম দেওয়া যায়: ‘হম গুনেহগার আউরাতে’।
৪.
ইতিহাসের পরীক্ষার জন্য
সমস্ত কিছু মুখস্থ করে ফেলতাম
কিন্তু সব সময়েই গুলিয়ে যেত
তারিখ
আর আজকাল
প্রায় সব কিছু
গুলিয়ে যায়
শুধু মনে রয়ে যায়
তারিখ
গুলফিশা ফাতিমার ৬ নং তিহার জেল থেকে লেখা কবিতা এসে ধাক্কা দেয় আমাদের সময়ের বোধকে। এই সময়-বোধ অবশ্য শ্রমিকদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের উত্তরাধিকার। যার হাত ধরেই চলেছে মেয়েদের শ্রমের স্বীকৃতি, মেয়েদের শ্রমের সময়ের বাইরে গিয়ে বিশ্রাম এবং যা খুশি তাই হতে চাওয়ার, হতে পারার জোর লড়াই। তবু এই সমস্ত লড়াইয়ের স্রোত এসে থমকে যায় জেলের গেটে। জেলের দরজা বন্ধ হলেই যেন শুরু হয়ে যায় এক অন্য সময়। সেখানে এক দিক দিয়ে যেমন যা খুশি তাই হতে চাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনার ইতি পড়ে যায়, তেমনই সেই সম্ভাবনাকে নাড়া দেওয়ার সমস্ত কিছুর সঙ্গেও বিচ্ছেদ হয়। শুধু থেকে যায় একটাই সত্য। তারিখ পে তারিখ পে তারিখ।
‘গিনতি’-র সময় বুঝিয়ে দেয় আজকের দিন শেষ। পরের দিন শুরু। সময় কাটে এক কোর্ট ডেট থেকে অন্য কোর্ট ডেট হিসেব করে। এক মুলাকাত থেকে অন্য মুলাকাতের পথ চেয়ে। জীবন এখানে যেন সময়ের কাছে আটক। বাইরের সময়কালের ইঙ্গিতও প্রায়ই আসে দেরিতে। বাসি খবরের কাগজ পড়ে। বাইরের জগতের সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ– তার থেকেই। কিংবা টিভি দেখার সুযোগ হলে। আর শামুকের গতিতে চলতে থাকে বিচারপদ্ধতি। বছরের পর বছর বিনা বিচারে, বিচারের নামে প্রহসনে দিন কাটতে থাকে। বিচারব্যবস্থাকে শামুকের গতিতে চালনা করার জন্য হাজার হাজার পাতার চার্জশিট জমা পড়ে। প্রায়ই নানা মিথ্যে রাজসাক্ষী জুটে যায়। বিচারপদ্ধতি আরও আরও ধোঁয়াটে করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলে। তাই প্রতিদিন কী ভীষণ লড়াই চলে সময়ের সঙ্গে! এক চিঠিতে গুলফিশা লেখেন, দিনগুলো যেন এক একটা সিঁড়ির মতো। অনন্তকাল উঠতে থাকা সিঁড়ি। শেষ কোথায় কেউ জানে না। গন্তব্য কী তাও ঠিক নেই। শুধু উঠে যাওয়া, সময়ের নিয়মে বয়ে যাওয়া। সময়ের ওপর সেখানে নিজেদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। অবশ্য মেয়েদের জীবনে সময়ের নিয়ন্ত্রণ কবেই বা থেকেছে! ঘরে-বাইরে উদয়াস্ত খাটতে খাটতেই বেশিরভাগ মেয়ের দিন কেটে যায়। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে জেলে আসা মেয়েদের হাতে হঠাৎ অফুরন্ত সময় হয়ে যায়। পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এসে হঠাৎ মিলে যায় ভাবার ফুরসত, অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব করার ফুরসত, আড্ডা মারার ফুরসত। যদিও সেই হঠাৎ পাওয়া অফুরন্ত সময়ে ঘিরে রাখা চার দেওয়াল গিলে খেতে চায় সমস্ত ভাবনাকে, মনুষ্যত্বকে, সেই সমস্ত কিছু যা সে নিজের চেতনায় গড়ে তোলে। সময়ের কারাগারে তাই আসলে চলতে থাকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ, সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ। নিজের সমস্ত সত্তাকে জিইয়ে রাখার যুদ্ধ। এই গাঢ় অন্ধকারে আলো খোঁজার জান কবুল লড়ার মাঝেই।
আসলে এই ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা আপ্রাণ চেষ্টা করে রাজবন্দিদের জীবন থেকে দুর্মূল্য সময় কেড়ে নেওয়ার। তাই দশ বছর, বারো বছর অবলীলায় বিচারাধীন বন্দি থেকে যায় মানুষ। বন্ধুদের লেখা এক চিঠিতে দেবাঙ্গনা কালিতা লিখেছিলেন–
“মাঝে মাঝে মনে হয়, এই অন্ধকার সময়ে হয়তো ‘বাইরে’ থাকার থেকে ‘ভেতরে’ থাকা অনেক সহজ। ‘বাইরে’ থাকার দায়িত্ব অনেক। কিছু করার দায়িত্ব, কিছু করার বোঝা– যা এই সময়ে, আগের চেয়েও অনেক বেশি, বিপুল কাজ মনে হয়। তোমাদের জায়গায় আমি থাকলে কী করতাম, কীভাবে সামলাতাম, ভেবে পাই না। জেল আর সবরকমভাবে অচল করে দিলে, শুধু সহ্য করা আর অপেক্ষা করাই একটা রাজনৈতিক কাজ হয়ে ওঠে। সময়ের সঙ্গে এই অন্তহীন সংঘর্ষে নিজের মাথা ঠিক রাখাই একটা কাজ হয়ে যায়। শোষক যাতে কোনওভাবেই আমাদের স্বপ্নগুলো কেড়ে নিতে না পারে, আমাদের প্রতিবাদী স্পৃহা ভেঙে না ফেলে, তা নিশ্চিত করা এবং শরীর-মনকে চাগিয়ে রাখাই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে যায়… মেয়েদের সম্মিলিত বিদ্রোহই আমাদের ‘বাইরে’ বেঁচে থাকার রসদ জোগান দিত, এখন ‘ভেতরেও’ মেয়েদের প্রতিরোধই টিকে থাকতে সাহায্য করে। প্রতিদিন এখানে মেয়েদের প্রতিদিনের যাপন থেকে সাহস পাই… সেই সমস্ত মেয়েদের থেকে যারা বছরের পর বছর ধরে ‘ভেতরেই’ আছে, সেই মেয়েরা যারা শুধুই অপেক্ষা করে আছে এই অন্তহীন বিচারব্যবস্থার, সেই সব মেয়েরা যারা দূর দেশ থেকে এসেছে, যারা ‘হিন্দি’ বা ‘ইংরেজি’ জানে না, যে মেয়েদের এখানেই সন্তান প্রসব করতে হয়, এখানেই সন্তান মানুষ করতে হয়, যে মেয়েদের উকিল নিযুক্ত করার সামর্থ নেই, ধৈর্য ধরে এই অসম্ভব ক্লান্তিকর সরকারি আইন সহায়তা ব্যবস্থার সঙ্গে যুঝতে হয়, যে মেয়েরা মাসের পর মাস তাদের পরিবার পরিজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি, শুধুমাত্র কোনও যোগাযোগের নম্বর জোগাড় করে উঠতে পারেনি বলে, তাদের ‘বাড়ির’ চিঠিরও কোনও উত্তর আসেনি কখনও, সেইসব ‘অপরাধী’ মেয়েরা, যারা কাঠামোগত শোষণের বন্দি। আমি আমার সহবন্দিদের কথা চিঠিতে লিখতে পারব না, কিন্তু এই কারাগারের একটা নাম দেওয়া যায়: ‘হম গুনেহগার আউরাতে’।”
দেবাঙ্গনা, নাতাশাদের এই অপেক্ষার শেষ হলেও তাঁদের সহবন্দি, কমরেড, গুলফিশা এখনও জেলে। পাঁচ বছর কেটে গেলেও সেই মামলার শুনানি নিয়ে আজও টালবাহানা চলছে। গুলফিশার মতোই আজও জেলে ভীমা কোরেগাঁও সাজানো মামলায় বন্দি সাংস্কৃতিক কর্মী জাগতপ। এ রাজ্যের দিকে তাকালে লালগড় আন্দোলনের সময় শিলদা পুলিশ ক্যাম্প হামলার মামলায় আটক বহু রাজনৈতিক বন্দি। কল্পনা মাইতি প্রায় ১৩-১৪ বছর বন্দি থাকার পর সেই মামলার রায় বেরয়। লোয়ার কোর্টে রায় হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের। ততদিনে ঠাকুরমণি মুর্মুর প্রায় ৮ বছর কেটে গেছে। শোভা মুন্ডার ১৪ বছর, জয়ন্তী সিং সর্দারের ১৪ বছর। এই শামুকের গতিতে চলা বিচার প্রক্রিয়া তাঁদের জীবন থেকে কেড়ে নেয় সমস্ত যৌবন, তারুণ্য। পারোবাই পাটেল, হিরনদি সিং গওদে জামিনে মুক্তি পান ন’ বছর পর। আবার অনেক ক্ষেত্রেই ১০ বছর পর আদালত বেকসুর খালাস ঘোষণা করে। জীবনের ১০টা বছর কারাগারে থাকার পর কেউ যখন বাইরে আসে তখন এই ১০ বছরে পাল্টে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে সমঝোতা কীভাবে করে? এর দায় রাষ্ট্র নেয় না। যেমন কোনও দায় নেয় না জেলে থাকা রাজবন্দিদের জীবন-জীবিকার। সাজাপ্রাপ্ত হলে কারাগারে কাজ পাওয়া যায়, সেই কাজের বিনিময় নামমাত্র বেতন। সেই বেতন পেতে হলে নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে আধার কার্ড লাগে। অথচ যাঁরা ১০-১৫ বছর জেলে, তাঁদের সেই এক দশক আগে ছেড়ে আসা ভারতে আধার কার্ড ছিল না। তাই এই ন্যূন্যতম মজুরি পেতেও দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের। আবেদনের পর আবেদন করতে হয় এই সামান্য কাজগুলির জন্য। চলতে থাকে ফেলে আসা সময়, হারিয়ে যাওয়া সময় ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে জোর লড়াই।
আর যাঁদের সমগ্র জীবনটাই কাটে জেলে? নিজের জেল-জীবন থেকে লেখা নানা গল্পে একদা রাজনৈতিক বন্দি বি অনুরাধা লেখেন জেলে বড় হতে থাকা ছোটদের কথা। যাঁদের সমগ্র জগৎ জেলে। যাঁরা জীবনে কুকুর দেখেননি, পুকুর নদী পাহাড় দেখেননি, দেখেছেন শুধুই কারাগার থেকে উন্মুক্ত এক ফালি আকাশ আর লোহার গরাদ। যাঁদের বাকি পৃথিবীর সঙ্গে আলাপ শুধুই ছবিতে। তেমনই এক গল্প উঠে আসে সত্তরের রাজনৈতিক বন্দি রাজশ্রী দাশগুপ্তের জেলস্মৃতিতে। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পরে পরে বাংলাদেশ থেকে বহু হারিয়ে যাওয়া বাচ্চার ঠাঁই হয়েছিল গারদে। আবার জেলে জন্মানো, জেলে বড় হওয়া বাচ্চারাও সেখানেই থাকত। সেই বাচ্চাদের সঙ্গে কাটানো বিভিন্ন সময়ের অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা উঠে আসে। একদিন হঠাৎ শুনতে পান সেই বাচ্চারা ডাকছে, ‘মাসি মাসি তোদের শাড়ি আকাশে উড়ে গেল! লাল নীল শাড়ি উড়ে যাচ্ছে!’ রাজশ্রীদি বলেন, “আরেক দিন আমাদের ডাকছে, ‘মাসি, মাসি তোদের শাড়ি আকাশে উড়ে গেল! দেখ আকাশে উড়ছে!’ আমরা অবাক হয়ে ভাবছি, সেল থেকে আবার আমাদের শাড়ি উড়ে কি করে যাবে। সব তো বন্ধ। কিন্তু সব বাচ্চাগুলো এসে খুব উত্তেজিত হয়ে চ্যাঁচাচ্ছিল লাল, নীল সব শাড়ি আকাশে উড়ে গেল, মাসিদের শাড়ি উড়ে গেল! আমরা তো সেল থেকে আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। অনেক পরে বুঝেছিলাম আকাশে রামধনু উঠেছে। ওরা কখনও রামধনু দেখেনি। ছোট থেকেই জেলেই থেকেছে। তাই ওটাই ওরা ভেবেছে মাসিদের শাড়ি উড়ে গেছে! আবার একজন বলছিল, মন খারাপ করিস না মাসি, শাড়িটা চলে গেল, আমি বেরলে তোকে লাল নীল শাড়ি এনে দেব!” যে ছোটদের সমস্ত বড় হওয়া, সমস্ত চেতনা, সমস্ত যাপন কারাগারে– তাঁরা কখনও বাইরে আসতে পারলে তাঁদের সেই নতুন পৃথিবীর সঙ্গে আলাপ করার দায় কি এই রাষ্ট্র নেয়?
জেলাযাপনের পাঁচ বছর পূর্তিতে গুলফিশা চিঠিতে লেখেন, ‘আমি এই দিনটিকে উদ্যাপন করব এই অদ্ভুতুরে পরিস্থিতেও আমার টিকে থাকার দিন হিসেবে’। মনে পড়ে যায়, এই উপমহাদেশের কবি, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সেই জেল থেকে লেখা কবিতার অমোঘ লাইন, ‘চান্দ রোজ আউর মেরি জান’ (আর মাত্র কিছু দিন প্রিয় আমার)। জেলে বসে ফয়েজের সঙ্গে গুলফিশা তর্ক চালায় এই দুই সময়কালের ফারাক নিয়ে। ফয়েজের অটল বিশ্বাস ও এই সময়ের অনিশ্চয়তা নিয়ে। একইসঙ্গে এই তর্ক যেন আমাদের দিকে প্রশ্ন তোলে। যে দেশের মাটি বন্দিমুক্তি লড়াইয়ের শহিদ গীতা, অমিয়া, লতিকা, প্রতিভাদের লড়াইয়ে সিক্ত, আজ যখন বিশ্ব জুড়ে আওয়াজ উঠছে এই কারা-ব্যবস্থাটাকেই নির্মূল করার, আন্দোলন চলছে ‘কারার ওই লৌহকপাট’ ভেঙে ‘যত সব বন্দিশালা’ উপড়ে ফেলার– সেখানে আমরা কি সেই লড়াইয়ের ডাক দিতে পারি না, যার জোরে গুলফিশা, জ্যোতি, জয়িতা দাসদের বুকে হাত রেখে আশ্বাস দিতে পারি যে সত্যিই ‘চান্দ রোজ আউর মেরি জান’? ইতিহাসের সময় কিন্তু আমাদের একদিন এই প্রশ্ন করবে, করবেই।
…পড়ুন এই সিরিজের অন্যান্য পর্ব…
১. জেলখানার পাঁচিল টপকে কারাবন্দি মেয়েদের ছবি-গান-কবিতা পৌঁছেছে গরাদের ওপারেও
২. ব্রাহ্মণ মেয়ের হাতে অনশন ভাঙবেন– দুকড়িবালাকে জেলের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে শর্ত দিয়েছিলেন ননীবালা
৩. বিচ্ছিন্ন কারাজীবনে খানিক শ্বাসবায়ু ‘মুলাকাত’