সমান্তরাল লিঙ্গ-যৌনতার মানুষ, বিশেষত রূপান্তরকামীরা চায় তাদের কাঙ্ক্ষিত সর্বনামেই সম্বোধিত হতে। কেউ চান ‘হি-হিম’-এর পরিবর্তে ‘শি-হার’ ব্যবহৃত হোক কেউ উল্টোটা চাইতে পারেন। আবার কেউ এই দ্বৈত-দ্বৈরথে না থেকে সরাসরি তাঁদের ‘দে-দেম’ সর্বনামে ডাকা হোক, দাবি করেন। আমাদের কর্তব্য, যাঁকে সম্বোধন করছি তিনি যেভাবে সংজ্ঞায়িত, সম্বোধিত হতে চাইছেন, সেই অনুযায়ী ভাষা-শব্দ ব্যবহার করা।
২০১২ সালে প্রকাশিত ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘চিত্রাঙ্গদা: দ্য ক্রাউনিং উইশ’ সিনেমাতে দেখা যায় রুদ্র চ্যাটার্জি নামক প্রধান চরিত্র একটি হাসপাতালে গেছে লিঙ্গ-পরিবর্তনের অস্ত্রোপচার করাতে। সেখানে বেশ কয়েকদিন একটা কেবিনে রয়েছে এবং তাকে যেতে হচ্ছে মানসিক নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে, অথচ সেখানকার সেবাব্রতী নার্সই তাকে ‘স্যর’ বলে সম্বোধন করছে! আপাতভাবে মনে হতে পারে, আরে! পুরুষকে তো ‘স্যর’ বলেই ডাকবে আর নারীকে ম্যাডাম। আর রুদ্র তো পুরুষ ছিল! কিন্তু যে-মানুষটি জন্মকালে-নিরূপিত লিঙ্গচিহ্ন নিয়ে খুশি নয় এবং সে-কারণে লিঙ্গ পরিবর্তন করাতে এসেছে হাসপাতালে, নার্স মহাশয়ার সহমর্মিতা নেই যে সেই মানুষটাকে ‘স্যর’ ডাকা যায় না। সে ‘স্যর’ থাকবে না বলেই অস্ত্রপচারের সাহায্য নিচ্ছে। হাসপাতালের সেই নার্স আসলে ভারতীয় সমাজের প্রতীক।
আমাদের সমাজে আমরা মানুষের নাম ‘খ্যাঁদা-বোঁচা’, ‘কালু’ থেকে ‘কানা-ল্যাংড়া-বোবা’ রাখি। মানসিক ভারসাম্যহীন কিংবা ব্যাধি আক্রান্ত কোনও শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ককে আমরা বলি ‘পাগল’ বা ‘অ্যাবনর্মাল’। আমরা ধর্মীয় অনুষঙ্গ টেনে কাউকে ডাকি ‘মোল্লা’। জাতের পরিচয় অনুযায়ী বহু মানুষকে ‘ছোটলোক’, কাউকে ‘মেড়ো’ কিংবা ‘খোট্টা’ এমনকী ‘সাঁওতাল’ বলেও ডাকি। সুতরাং আমরাই যে অনেককে ‘হোমো’, ‘ছক্কা’, ‘হিজরা’ এসব নামে ডেকে হাসাহাসি করব, এ তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে এখন!
ব্যাকরণে বলে নামের পরিবর্তে যা আসে, তা হল সর্বনাম। ইংরেজি ভাষায় প্রথম থেকেই সর্বনামের লিঙ্গ আছে। এই ভাষার সর্বনাম পড়ে বোঝা যায়, আপনি তথাকথিত পুরুষের কথা বলছেন নাকি নারীর। ভাষায় লিঙ্গের এমন ব্যবহার দেখলে উপলব্ধি হয় যে, এই ভাষা লিঙ্গ বলতে পুরুষ এবং নারীকে বোঝে কেবল। এই ভাষা মনে করে না, পুরুষ ও নারী দ্বৈতের মধ্যেই থাকতে হবে এমন নিদান, যা অনেকে মানতে না-ও পারে। আবার নারী ও পুরুষের মধ্যে যে সামান্য শারীরিক পার্থক্য, তাকে যোজন দূরত্বের ভেদাভেদে পরিবর্তন করার দ্যুতক্রীড়াটিও ভাষা থেকেই শুরু হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সমাজ ও রাষ্ট্র মনে করে লিঙ্গ-যৌনতা আসলে স্থাবর। জন্মলগ্নে প্রাপ্ত তথাকথিত লিঙ্গ পরিচয়কে সমগ্র জীবন বয়ে নিয়ে চলতে হবে, এমনটাই সমাজ ও রাষ্ট্র ধরে নেয়। সেই জন্য নারী-পুরুষ দ্বৈতের সৃষ্টি হয় ভাষায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
লিঙ্গের যে বৈষম্য, তা ভাষা থেকে শুরু হয়ে পোশাকে, কর্মক্ষমতায় এবং পরে সামাজিক অনুশাসনে পরিণত হয়। ‘হি’ আর ‘শি’ সর্বনামে তখন ‘হি’-কে বড় করে দেখানোর রাজনীতি চালু হয়ে যায়। কিন্তু যারা মনে করে, সর্বনামের পরিচয়ে একজনের লিঙ্গপরিচিতি সংজ্ঞায়িত হবে না, যারা চায় লিঙ্গ-নিরপেক্ষ সর্বনাম, তাদের দাবি কতটা মেটাতে পারে ভাষা? যেমন, বাংলা ভাষায় সর্বনাম সব সময়ই লিঙ্গ-নিরপেক্ষ। বাংলা ভাষায় আমরা ব্যবহার করি ‘সে’। ‘সে’-এর মতো সুন্দর শব্দ বোধ করি কম আছে। এই ‘সে’ দিয়ে আমরা ব্যক্তির লিঙ্গ-নিরূপণ করতে পারি না। এবং সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু যে ভাষায় এই সুবিধাটি নেই, যথা ইংরেজি, যেখানে আপনাকে হয় ‘হি’ কিংবা ‘শি’-এর বন্ধনীতেই থাকতে হবে, সেখানে বৈয়াকরণরা বলে থাকেন ‘দে’-র কথা। যেখানে পুরো সম্বোধনটাই একটা সমষ্টি। মানুষ সামাজিক লিঙ্গের স্বার্থে অকারণ বিভাজিত নয়। কিন্তু এতসব একজন করবে কেন? কেন যেভাবে ভাষাকে জেনে এসেছি, সেভাবেই ব্যবহার করব না? ভাষাকে নিজের মতো করে ব্যবহারে কোনও বাধা নেই, কিন্তু আমার ব্যবহৃত ভাষা, শব্দ যদি অন্যের গ্লানির কারণ হয়, অন্যের অস্তিত্বকে ব্যঙ্গ করে, তবে আমাকে তো তার পরিবর্তনের কথা ভাবতেই হবে। সমান্তরাল লিঙ্গ-যৌনতার মানুষ, বিশেষত রূপান্তরকামীরা চায় তাদের কাঙ্ক্ষিত সর্বনামেই সম্বোধিত হতে। কেউ চান ‘হি-হিম’-এর পরিবর্তে ‘শি-হার’ ব্যবহৃত হোক, কেউ উল্টোটা চাইতে পারেন। আবার কেউ এই দ্বৈত-দ্বৈরথে না থেকে সরাসরি তাঁদের ‘দে-দেম’ সর্বনামে ডাকা হোক, দাবি করেন। আমাদের কর্তব্য যাঁকে সম্বোধন করছি, তিনি যেভাবে সংজ্ঞায়িত, সম্বোধিত হতে চাইছেন, সেই অনুযায়ী ভাষা-শব্দ ব্যবহার করা। আমাদের সমাজে, সমাজমাধ্যমে এই ব্যক্তিগত সর্বনাম নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ আছে। এসব ব্যঙ্গের পিছনে লুকিয়ে আছে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের বিদ্বেষ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: পাথর ছুঁয়ে পাহাড় বুঝতে শিখিয়েছিল আমার দৃষ্টিহীন বন্ধু
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সমাজ ও রাষ্ট্র মনে করে লিঙ্গ-যৌনতা আসলে স্থাবর। জন্মলগ্নে প্রাপ্ত তথাকথিত লিঙ্গপরিচয়কে সমগ্র জীবন বয়ে নিয়ে চলতে হবে, এমনটাই সমাজ ও রাষ্ট্র ধরে নেয়। সেই জন্য নারী-পুরুষ দ্বৈতের সৃষ্টি হয় ভাষায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় নারী এবং পুরুষ কেবলমাত্র শারীরিক লিঙ্গচিহ্ন নিয়েই গঠিত। বাহ্যিক সেই শারীরিক বৈশিষ্ট্যই তাদের লিঙ্গদর্শনের একমাত্র ভুবন। পুরুষ অর্থে শিশ্ন আর নারীর পরিচয় আমরা যোনিতেই বুঝি। কিন্তু পুরুষেরও ঋতুচক্র চলতে পারে এবং নারীর থাকতে পারে শিশ্ন-বীর্য– আমাদের একরৈখিক চিন্তাজগতে সেই ভাবনার জায়গা নেই। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই লিঙ্গচেতনা বহুমাত্রিক। আপাত লিঙ্গচিহ্নই কেবল লিঙ্গপরিচয় নয়। তথাকথিত নারী ও পুরুষ দ্বৈতের মধ্যে কেউ থাকতেই পারে, কিন্তু যারা এই বন্ধনীতে আবদ্ধ থাকবে না, তাদের জন্য সমাজ, রাষ্ট্র এবং ভাষাকেও যে জায়গা তৈরি করে দিতে হবে, এখন এটাও বোঝা প্রয়োজন। একজন তথাকথিত পুরুষকে ‘শি’ সম্বোধনে ডাকুন দেখি; সে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে উঠবে। ভাষার বিশেষাধিকার (প্রিভিলেজ) সে হারাতে চাইবে না। ঠিক তেমনই লিঙ্গ-যৌনতায় যারা রূপান্তরকামী, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সর্বনাম কেন চাইবে না? এবং কেন সেই ভাষা আমরা গড়ে তুলতে পারব না, যেখানে সবার জায়গা হবে?
‘চিত্রাঙ্গদা: দ্য ক্রাউনিং উইশ’ ছবিতে প্রধান চরিত্র রুদ্র চ্যাটার্জি সেই নার্সকে মানুষের কাঙ্ক্ষিত সম্বোধনের কথা বুঝিয়েছিল। বলেছিল ব্যক্তিগত সর্বনামের গল্প। সেই নার্স আর কখনও রুদ্রকে ‘স্যর’ বলে ডাকেনি। তার মধ্যে জেগেছিল সহমর্মিতার বোধ। ভারত রাষ্ট্রে ও ভারতীয় সমাজে এই বোধের জাগরণ কবে হবে?