আমার ট্রান্সম্যান বন্ধুটিকে, যেহেতু তিনি এই মুহূর্তে ট্রানজিশনের অধীন– তাঁকে দেখে কিন্তু প্রথমে আক্রমণকারীরা বুঝতেই পারেনি যে, তিনি রূপান্তরকামী পুরুষ বা ট্রান্সম্যান। সেই সময় গালাগালির ভাষা ছিল যৌনতার ইঙ্গিতমুক্ত। কিন্তু যে মুহূর্তে তাদের সামনে ট্রান্স প্রোটেকশন অ্যাক্টের কথা পাড়া হয়, অর্থাৎ তাঁরা চিহ্নিত করতে পারলেন ট্রান্সম্যান হিসেবে; সেই মুহূর্তে আক্রোশ অন্য মাত্রা পেল চোখের সামনেই। একে প্রান্তিক, হয়ে উঠতে চাইছে সমানে সমানে পুরুষ, এবং তার ওপর তাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইন রয়েছে– এই রোষে আরও খেপে উঠলেন মানুষজন।
‘পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান আমার মায়ের বাড়ি’
লীলা মজুমদারের উপন্যাসের শুরুর এই লাইনটা আমাদের জীবনচর্যায় কেবলমাত্র ‘মায়ের বাড়ি’ অবধি সীমাবদ্ধ থাকে না। সেই বাড়ির বারান্দার একটা কোণ হয়ে দাঁড়ায় কখনও প্রিয় ক্যাফের একটা চেনা সিট, কখনও বন্ধুবৃত্ত, কখনও চেনা পাড়া। চেনা সিগারেটের দোকান বন্ধ থাকলে সেই রাতটা সিগারেট না কিনেই চালিয়ে দিই। কেন? কারণ নিজের মায়ের বাড়ির আরাম, নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা আমাদের বিস্তৃত হয়ে থাকে যা কিছু চিরচেনা, তার মধ্যেও। এই নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে আমি, আমার পছন্দের পোশাক-চুলের কেতা-আমার যৌনতা নিয়ে বেশ থাকি।
কিন্তু, এই পরিধির মধ্যে একটা আক্রমণ হয়েছে। যোধপুর পার্কের ‘পড়শি’ ক্যান্টিনের কিছু জিনিস কিনতে যায় আমার বন্ধু (ট্রান্সম্যান) যিনি পড়শির একজন কর্মচারীও। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য কাউন্টারের বচসা জনৈকা মহিলার সঙ্গে, ভীষণ আকার ধারণ করে। আমার বন্ধুটি মহিলাকে নিজের জায়গা ছেড়ে আগে বিল মেটাতে দেয়নি তার জেরে বচসা, এবং বচসার জেরে মহিলা ফোনে জড়ো করে ফেললেন এলাকার জনা ২০-২৫ পুরুষকে, তারা ডেকে আনল এলাকার অনেক মহিলাকে। সেই ট্রান্স মানুষটিকে মাটিতে ফেলে মারধর করার সময়, ভেসে আসছিল ‘মদ্দা মেয়েমানুষ, তোরা কেমনভাবে করিস?’ ‘হিজড়ে, তোরা মেয়ে না ছেলে আগে দেখব, রেপ করতে পারি’ এগুলোর সময়; তাকে বাঁচানোর জন্য পড়শি থেকে ছুটে আসা আমার আরেক বন্ধুর (নন বাইনারি কুইয়ার) লম্বা চুল ধরে টেনে রাখে এলাকার মানুষজন, আরেক বন্ধুর (নন বাইনারি কুইয়ার) পিঠে অস্ত্রের মতো নেমে আসে তাদের হাতের হেলমেট। যোধপুর পার্কের একটি সুপরিচিত দোকানের কাউন্টারে সূত্রপাত এই বচসার, সেই দোকান থেকে বের করে দেওয়া হয় আমার বন্ধুদের, বলা হয়, ‘নিজেদের মধ্যেকার ঝামেলা নিজেরা বাইরে গিয়ে মেটান।’ প্রচণ্ড মারধরের পর পুলিশ আসে, মেডিক্যাল, এফআইআর হয় এবং ক্রমশ…।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটল আমাদের পাড়ায়! আমার, আমার বন্ধুদের, ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’র সাথীদের, রোজকার যাতায়াতের পথে, বহুচেনা সিগারেটের দোকানের সামনে; আমাদের নিরাপদ স্থানের মধ্যেই। এবং এলাকাবাসী মানুষেরা কিন্তু এগিয়ে এলেন না কেউই।
………………………………………..
আমার ট্রান্সম্যান বন্ধুটিকে, যেহেতু তিনি এই মুহূর্তে ট্রানজিশনের অধীন– তাঁকে দেখে কিন্তু প্রথমে আক্রমণকারীরা বুঝতেই পারেনি যে, তিনি রূপান্তরকামী পুরুষ বা ট্রান্সম্যান। সেই সময় গালাগালির ভাষা ছিল যৌনতার ইঙ্গিতমুক্ত। কিন্তু যে মুহূর্তে তাদের সামনে ট্রান্স প্রোটেকশন অ্যাক্টের কথা পাড়া হয়, অর্থাৎ তাঁরা চিহ্নিত করতে পারলেন ট্রান্সম্যান হিসেবে; সেই মুহূর্তে আক্রোশ অন্য মাত্রা পেল চোখের সামনেই। একে প্রান্তিক, হয়ে উঠতে চাইছে সমানে সমানে পুরুষ, এবং তার ওপর তাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইন রয়েছে– এই রোষে আরও খেপে উঠলেন মানুষজন।
………………………………………..
গভীর হতাশা আর বিস্ময় নিয়ে ভাবতে বসলে মনে হয়, রাতারাতি এই জনরোষ তৈরি হওয়া কেমন করে সম্ভব? যেসব মানুষ কাল এই আক্রমণে হাত গরম করলেন, বন্যা ডাকলেন অশ্রাব্য ভাষার, তাঁরা আমাদের পড়শির বন্ধুদের দেখছেন ২০২৩ জুলাই থেকে। পড়শি, যোধপুর পার্কে শুরু হয় একটি কুইয়ার ক্যাফে-ক্যান্টিন হিসেবে, তাঁরা দেখেছেন বিভিন্ন যৌনতার মানুষ, পুরুষ-নারী-ট্রান্সদের এখানে আড্ডা হয়, তাঁরা বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খান, তাঁদের কেউ কেউ ট্রানজিশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে, ২০২৩-এ শুধুমাত্র পোশাকে পুরুষ মানুষটির গোঁফদাড়ি গজাল, পাল্টাচ্ছে গলার স্বর, টেস্টোস্টেরনের প্রভাবে চওড়া হচ্ছে কাঁধ। নিজেদের বন্দি দেহ থেকে বেরিয়ে এসে, কিছু মানুষ স্বাবলম্বী হচ্ছেন, বাজারে আসছেন, আবার পুরুষও হয়ে উঠছেন স্বেচ্ছায়! এই ধৃষ্টতার একটা শিক্ষা দরকার ছিল বলে মনে করলেন কি মানুষেরা? তা না-হলে মারের অনুষঙ্গ হিসেবে ওই ভাষার প্রয়োগ দরকার পড়ত না। পকেটমারের গণপিটুনি, আর এই জনরোষ এক নয়! আর সেটাই ভয়ংকর।
যে কোনও বচসার সময় যৌন সম্পর্কিত গালাগাল হচ্ছে তীব্রতম আক্রমণ, এবং ট্রান্স কুইয়ার সম্প্রদায়ের প্রতি এই আক্রমণের উদ্দেশ্য তাঁদের অন্যরকম যৌনতাকে অস্বাভাবিক, অসুস্থতা, এবং অগ্রহণীয় করার জন্য। এই শব্দচয়নের মূল উদ্দেশ্যই তাঁদের ‘অসভ্য’ বা ‘নোংরা’ হিসেবে চিহ্নিত করা, যাতে সমাজ সহজেই তাঁদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে।
আমার ট্রান্সম্যান বন্ধুটিকে, যেহেতু তিনি এই মুহূর্তে ট্রানজিশনের অধীন– তাঁকে দেখে কিন্তু প্রথমে আক্রমণকারীরা বুঝতেই পারেনি যে, তিনি রূপান্তরকামী পুরুষ বা ট্রান্সম্যান। সেই সময় গালাগালির ভাষা ছিল যৌনতার ইঙ্গিতমুক্ত। কিন্তু যে মুহূর্তে তাদের সামনে ট্রান্স প্রোটেকশন অ্যাক্টের কথা পাড়া হয়, অর্থাৎ তাঁরা চিহ্নিত করতে পারলেন ট্রান্সম্যান হিসেবে; সেই মুহূর্তে আক্রোশ অন্য মাত্রা পেল চোখের সামনেই। একে প্রান্তিক, হয়ে উঠতে চাইছে সমানে সমানে পুরুষ, এবং তার ওপর তাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইন রয়েছে– এই রোষে আরও খেপে উঠলেন মানুষজন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাদারা দিনের পর দিন, চায়ের ভাঁড় হাতে দেখে গেলেন পড়শির মানুষগুলোকে, AFAB (assigned female at birth) মানুষগুলোর পৌরুষের বিকাশ তাদের মনে হল ‘আস্ফালন’– সমান হওয়ার চেষ্টা। ঠিক যে-কারণে একই যোগ্যতার দুই কর্পোরেট কর্মচারী– যদি তার মধ্যে একজন AFAB হন; তার প্রমোশনের সিঁড়ি দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়; ঠিক যে কারণে ট্রান্স মানুষদের খেলাধুলোর পৃথিবীতেও সমতাকে অস্বীকার করা হয়। কখনও তাঁরা যথেষ্ট ‘পুরুষ’ নন, কখনও তাঁরা ‘অতি পুরুষ’। আর এই ‘ট্রান্সফোবিয়া’ যখন গণ-মানসিকতা পরিচালনা করে, তখন সেই রাগ বা ক্ষোভের আগ্রাসী হয়ে ওঠা ভারি সহজ। কুইয়ার বা ট্রান্স মানুষকে এই আগ্রাসনের শিকার বানানো আরও সহজ কারণ তাঁরা এমনিই প্রথাগত কাঠামোর বাইরে।
এছাড়াও আছে যা কিছু অচেনা বা অপরিচিত, তার প্রতি মানুষের ভয়। যে কথা আগেও উল্লেখ করলাম; ট্রান্স বা নন বাইনারি মানুষ যদি তাঁর প্রথাগত সত্তা ছেড়ে অন্য সত্তা হয়ে উঠতে চায়, তখন আমরা সেটাকে আত্মপরিচয়ের ওপর বিপদ বা হুমকি হিসেবে দেখি, ভয় পাই নিজের অস্তিত্বের খাটো হওয়ার। কাজেই যে কোনও কারণেই যখন এই প্রশ্ন উদ্রেককারীদের হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে, তখন সহজেই তাদের মারধর করা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বুকে-পিঠে-পাছায় আক্রমণ করে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে সমস্ত কৌতূহলের।
এই ঘটনা, কোনও একটি ঘটনা, বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; পড়শির ইলেক্ট্রিকের লাইন কাটা হয়েছে আগেও, টেনে ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যানার। দেশের সর্বত্র নানাভাবে নানা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন অন্য যৌনতার মানুষরা। এই ঘটনার পরে পুলিশকে ‘ট্রান্সজেন্ডার প্রোটেকশন অ্যাক্ট’-এর কথা বলে বোঝাতে হল। এই নিস্পৃহতার দায় কার? ভারতে ‘ট্রান্স রাইটস’ বলে কিছু আইন আছে, কিন্তু তার বাস্তবে প্রয়োগমূল্য শূন্য। কারণ কেউই মনে করে না ট্রান্স-কুইয়ার মানুষগুলোর সুরক্ষার আইন, মানুষের জানা প্রয়োজন! কাজেই পরিবর্তন দরকার সামাজিক, মানসিক এবং প্রশাসনিক স্তরেও।
আমার বন্ধুরা পড়শিকে বাড়ি মনে করে, ভালোবাসে, কাজ করে, আড্ডা দেয়। পড়শি ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও বটে; এখানে বিভিন্ন ওয়ার্কশপের মাঝখানে চা-কফি-ফিশ ফ্রাই। পড়শি আমাদের পড়শিই! চাপা কান্না, অনেকটা হতাশা আর নীরবতা নিয়ে বলতে হয়– আমাদের জন্য নিরাপদ স্থান বলে কিছু নেই!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved