এক সময় পুরুষের প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছিল বিশ্বের এই আদিম পেশার। যে দেশে পুরুষ নেই, সে দেশে পতিতাও নেই। অথচ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘৃণাই তাঁদের একমাত্র ভবিতব্য। এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেলজিয়াম সরকার। দেশের শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যৌনকর্মীদেরও। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে এই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করল বেলজিয়াম। এবার চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে কাজ করবেন যৌনকর্মীরা। স্বাস্থ্যবিমা, পেনশন, বেকার ভাতা পাবেন। এছাড়া ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটিও পাবেন যৌনকর্মীরা। কোনও গ্রাহককে ‘না’ বলার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। চাইলে যে কোনও সময়েই চুক্তি ভেঙে দিতে পারেন তাঁরা।
সদ্য ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে সঞ্জয় লীলা বনসালির ওয়েব সিরিজ ‘হীরামন্ডি’। তারপর থেকেই নানা কারণে আলোচনায় সেটি। তবে ‘হীরামন্ডি’ প্রসঙ্গের অবতারণা অন্য কারণে।
কী সেটা? প্রথমত, ‘হীরামন্ডি’ পাকিস্তানের জনপ্রিয় একটি যৌনপল্লি। লাহোরে অবস্থিত। দেশভাগের আগে লাহোরের প্রেক্ষাপটে সিরিজটি তৈরি। তারই একটি দৃশ্যে মনীষা কৈরালার মুখে শোনা যাচ্ছে, হীরামন্ডির উসুল-মুজরা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা থামবে না। তাই নাচ থামানো বাইজিকে ফের নাচঘরের মাঝে গিয়ে মুজরা শেষ করতে হয়। অর্থাৎ ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’। বিশ্বের সর্বত্র এই পেশায় নিয়োজিত সকলের জন্য একই নিয়ম। তা বাইজি-তওয়ায়েফ-বেশ্যা-বারাঙ্গনা-গণিকা-প্রস্টিটিউট-সেক্স ওয়ার্কার– যা-ই বলুন না কেন, গ্রাহকের মনোরঞ্জনই তাঁদের দায়িত্ব, গ্রাহকই শেষ কথা। সেখানে নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও দাম নেই।
বস্তুত, এক সময় পুরুষের প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছিল বিশ্বের এই আদিম পেশার। যে দেশে পুরুষ নেই, সে দেশে পতিতাও নেই। অথচ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘৃণাই তাঁদের একমাত্র ভবিতব্য। অন্য পেশায় যুক্ত ব্যক্তিদের মতো কোনও সুযোগ-সুবিধা তাঁদের ভাগ্যে জোটে না। প্রাপ্য শুধু নির্মম অত্যাচার, পুরুষের অবদমিত কামের হিংস্র বহিঃপ্রকাশ সহ্য করে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাওয়া। শিল্প-সাহিত্য-কবিতায় কখনও তাঁদের মহিমান্বিত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের জীবন বহু ক্ষেত্রেই নরকের চেয়েও অধম।
শাস্ত্রমতে, দেবী দুর্গার আরাধনায় প্রয়োজন হয় নিষিদ্ধপল্লির মাটি। কিন্তু পুজোমণ্ডপে তাঁদের ঠাঁই হয় না। অবজ্ঞা আর বঞ্চনার অন্ধকারে বাস করতে হয় তাঁদের। ঘৃণা আর নোংরা দৃষ্টি ছাড়া সেই উপেক্ষিতাদের কপালে আর কিছুই জোটে না। শ্রম আইন, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তো তাঁদের কাছে সোনার পাথরবাটি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বস্তুত, এক সময় পুরুষের প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছিল বিশ্বের এই আদিম পেশার। যে দেশে পুরুষ নেই, সে দেশে পতিতাও নেই। অথচ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঘৃণাই তাঁদের একমাত্র ভবিতব্য। অন্য পেশায় যুক্ত ব্যক্তিদের মতো কোনও সুযোগ-সুবিধা তাঁদের ভাগ্যে জোটে না। প্রাপ্য শুধু নির্মম অত্যাচার, পুরুষের অবদমিত কামের হিংস্র বহিঃপ্রকাশ সহ্য করে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাওয়া।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
১৯৭৮ সালে যৌনকর্মী-অধিকারবাদী ক্যারল লেই প্রথম ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ফ্রেডেরিক ডেলাকোস্ট ও প্রিসিলা আলেকজান্ডার সম্পাদিত মহিলা যৌনকর্মীদের লেখা কবিতা সংকলন ‘সেক্স ওয়ার্ক’ ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়। তার পর থেকেই ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। এমনকী, তা ঠাঁই পায় অক্সফোর্ড ও ওয়েবস্টার অভিধানেও। অর্থাৎ, সেই সময় থেকে নগরবধূ-দেবদাসীদের যেন সামাজিক বৃত্তে উত্তরণের রাস্তা একটা তৈরি হল। কিন্তু বাস্তবের ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টো। কিছু আইনি সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিমার সুবিধার মতো ব্যতিক্রম বাদ দিলে এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই প্রথম বিশ্বের দেশগুলিও।
এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেলজিয়াম সরকার। দেশের শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যৌনকর্মীদেরও। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে এই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করল বেলজিয়াম। এবার চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে কাজ করবেন যৌনকর্মীরা। স্বাস্থ্যবিমা, পেনশন, বেকার ভাতা পাবেন। এছাড়া ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটিও পাবেন যৌনকর্মীরা। কোনও গ্রাহককে ‘না’ বলার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। চাইলে যে কোনও সময়েই চুক্তি ভেঙে দিতে পারেন তাঁরা। এক্ষেত্রে তাঁদের কোনও নোটিস পিরিয়ড দিতে হবে না। পরিচয় গোপন রাখার অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে পেশা বদল করলেও কোনও সমস্যায় পড়তে না হয়। গ্রাহকের কাছ থেকে বিপদের আশঙ্কা করলে বাজাবেন অ্যালার্ম বাটন। তাঁদের সুরক্ষিতভাবে বের করে আনতে হবে ‘পিম্প’ বা ‘দালাল’দের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ‘মেয়ে চাই?’ আর ‘মেয়ে কই!’ শহরের দেওয়াল লিখন যেন মেয়েদেরই ভাগ্যলিপি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এ কথা মেনে নেওয়াই যায় যে, সমাজ থেকে পতিতাবৃত্তি নির্মূল করা যাবে না। এই ধরনের চিন্তাভাবনা অবাস্তব। খ্রিস্ট জন্মের বহু আগে থেকে তা চলে আসছে বিভিন্নভাবে, নামে। যতদিন মানুষ থাকবে, ততদিনই বিশ্বময় এই বৃত্তি ছড়িয়ে থাকবে। কিন্তু আইন করে তা বন্ধ করা না গেলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর সম্ভব, এই পেশায় যুক্ত মহিলাদের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্য ও সম্মানের ব্যবস্থা করা। পুরুষদের আদিম মনোবৃত্তির কারণেই এই অভিশপ্ত পেশা বন্ধ করা অসম্ভব। তাদের কুৎসিত লালসা, কামনার বিষ গ্রহণ করেন ‘পতিতা’রা। সমাজকে শুদ্ধ ও পবিত্র রাখেন। তার ওপর অনুন্নত দেশে দারিদ্রও একটা বড় কারণ। ফলে, এই পেশায় যুক্ত মহিলাদের বিরাট আকারে পুনর্বাসন হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার চাইলেই তাঁদের সন্তানদের স্বাস্থ্য-শিক্ষার দায়িত্ব নিতে পারে। এগিয়ে আসতে পারে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যাতে একালের ‘সত্যকাম’রা বিকল্প পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ‘জবালা’-দের এই জগৎ থেকে বের করতে পারেন।
কোনও রাষ্ট্র সবকিছুর সুরাহা করতে পারে না। সে জন্য প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা, অংশগ্রহণ। একবিংশ শতব্দীতে এসে আমাদের মানসিকতা বদলের দরকার সর্বাগ্রে। একজন চিকিৎসক যেমন অর্থের বিনিময়ে রোগীকে চিকিৎসা পরিষেবা দেন, তেমনই একজন যৌনকর্মী অর্থের বিনিময়ে গ্রাহককে পরিতৃপ্তি দিচ্ছেন। এ-ও তো পরিষেবাই। বরং তুলনা করলে দেখা যায়, তাঁরা কিছুটা হলেও নিজস্ব সিদ্ধান্তেই চলেন। গ্রাহককে ‘না’ বলার অধিকার রয়েছে তাঁদের। সে তুলনায় পারিবারিক চৌহদ্দিতে মহিলারা অনেক ক্ষেত্রেই সেই স্বাধীনতা পান না। যৌন সম্পর্কের ধরন পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন স্বামী ও পুরুষরা।
সুতরাং, আর পাঁচজন নাগরিকের মতো যৌনকর্মীদেরও ‘মানুষের মতো’ বাঁচার অধিকার রয়েছে। মানুষ হিসেবে সভ্যজগতে বেঁচে থাকার ন্যায্য অধিকার আজ তাঁরা বহু প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়ে অর্জনও করেছেন। সচেতন নাগরিক হিসেবে সে লড়াইয়ে সকলের পাশে থাকা আমাদের দায়িত্ব।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved