এ এক নতুন রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব। কবিঠাকুর থেকে ছবিঠাকুরের পথে জোরকদমে এগিয়ে যাওয়া। বিশের দশকের মাহেন্দ্রলগ্নে তাঁর চিঠির প্রবাহে স্পষ্টতর হচ্ছেন সেই অন্য রবি ঠাকুর, যিনি প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে আখর থেকে আকারের দিকে সরে যাচ্ছেন। সেকথা জানান দিচ্ছেন তিনি স্বয়ং, বলছেন, ‘আমার কলমেও আসতে চায় সেই আকারে লীলা’। কোথাও আরও তীক্ষ্ণ স্বরে, ‘আবেগ নয়, ভাব নয়, চিন্তা নয়, রূপের সমাবেশ। আশ্চর্য এই যে তাতে গভীর আনন্দ। ভারি নেশা’। তাঁর চোখে ফুটে উঠছে নতুন দেখার নেশা। প্রশ্ন উঠছে, কী সেই দৃষ্টি? কেমন সে দেখা, যা তাঁকে নেশা ধরিয়ে দেয়?
২২.
রবীন্দ্রনাথ খানিকটা সচেতন ভাবেই ছবির সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ককে এক সুতোয় গাঁথেননি। বরাবর বলে এসেছেন, ‘সাহিত্য’ হল অর্থের নিগড়ে বাঁধা, তার ভিতরে একটা মানে থাকা চাই। ছবির সে দায় নেই, সে হল চেয়ে দেখার আনন্দ। অবশ্য এ ভাবনা একেবারে গোড়ায় ছিল না, ক্রমশ ছবি আঁকার দিকে ঝুঁকে পড়লে তাঁর ভেতরের সেই মানুষ, সে ক্রমে কবি এবং চিত্রকরের দু’টি ভিন্নসত্তায় দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। নিজেকে দেখছেন সেইভাবে, আমাদেরও দেখতে বলেছেন।
বিশের দশকের মাঝামাঝি রানী মহলানবিশকে লেখা অজস্র চিঠিপত্রে লেগেছে রবীন্দ্রনাথের এই ‘নবীন মেঘের সুর’। যেখানে বলছেন, ‘আমার জীবনে নিরন্তর ভিতরে একটি সাধনা ধরে রাখতে হয়েছে। সে-সাধনা হচ্ছে আবরণ-মোচনের সাধনা, নিজেকে দূরে রাখবার সাধনা। আমাকে আমি থেকে ছাড়িয়ে নেবার সাধনা।’ চিত্রকলা যেন সেই অন্য ‘আমি’র কাছে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে। কবিত্বের আবরণ খসিয়ে গায়ে জড়িয়েছে চিত্রকরের আলখাল্লা। একদা যে বিশ্বশক্তির কল্পনাকে তিনি অন্তরে গ্রহণ করেছিলেন ‘বিশ্বকবি’ হিসেবে, যাকে ভেবেছিলেন গানের প্রতিমার মধ্যে, ক্রমে তিনি দেখা দিচ্ছেন চিত্রকরের মহিমায়। শঙ্খ ঘোষের ভাষায় বললে বলতে হয়, ‘এই বিশ্বকবি একদিন দেখা দিয়েছিলেন সুরের দীক্ষার মধ্যে দিয়ে, আর পরিণামে তিনি আসছেন এক চিত্রকরের মূর্তিতে’। সত্যিই কি তাই নয়?
মন দিয়ে খেয়াল করলে দেখি, সেই কারণেই কি তাঁর অন্দরমহল জুড়ে নিরন্তর এক ভাঙাগড়া চলেছে? কখনও তিনি আপন মনে বলে চলেন, ‘আমার আপনার মধ্যে এই নানা বিরুদ্ধতার বিষম দৌরাত্ম্য আছে বলেই আমার ভিতরে মুক্তির জন্যে এমন নিরন্তর এবং এমন প্রবল কান্না’। এই কান্না তাঁর গহন শিল্পীসত্তার কান্না। কখনও প্রবল সংশয় ঘেরা মন নিয়ে জীবনের প্রান্তে এসে স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘এবার আমার জীবনে নূতন পর্যায় আরম্ভ হল। একে বলা যেতে পারে শেষ অধ্যায়’। বলা বাহুল্য, এই শেষ অধ্যায় তাঁর চিত্রভুবন, রং-রেখা-আকারের আশ্চর্য জগৎ। যা নিয়ে তাঁর আশঙ্কা কিছু কম ছিল না, ‘এই পরিশিষ্টভাগে সমস্ত জীবনের তাৎপর্যকে যদি সংহত করে সুস্পষ্ট করে না তুলতে পারি তা হলে অসম্পূর্ণতার ভিতর দিয়ে বিদায় নিতে হবে’– একথা নিজেকেই বলছেন নিভৃত সলিলকির গোপন বেদনার মতো।
ওপরের চিঠির সমস্ত টুকরোই বিশের দশকের শেষ ভাগে, যখন সদ্য ফিরেছেন ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে। যেখানে রানী আর প্রশান্ত মহলানবিশের মতো মানুষ ছিলেন কবির সফরসঙ্গী। সেই দীর্ঘ ইউরোপ ভ্রমণের পরে রবীন্দ্রনাথের দেখার মধ্যে যেন আমূল বদল ঘটে গিয়েছে। একদা যে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমাদের চলা, এ চোখে দেখে চলা নয়, এ সুরের টানে চলা। যেটুকু চোখে দেখে চলি সে তো বুদ্ধিমানের চলা, তার হিসেব আছে, তার প্রমাণ আছে; সে ঘুরে ঘুরে কূলের মধ্যেই চলা। সে চলায় কিছু এগোয় না। আর যেটুকু বাঁশি শুনে পাগল হয়ে চলি, যে-চলায় মরা-বাঁচা জ্ঞান থাকে না, সেই পাগলের চলাতেই জগৎ এগিয়ে চলেছে’। এই পাগলের চলাই তো শিল্পীর একাকী চলা। যে আঁধার রাতে ‘বুঝিয়ে দে’ ‘বুঝিয়ে দে’ বলে আর্ত হাহাকারে ভেঙে পড়ে! কী বুঝতে চায় সে? সে বলে, ‘অন্ধকারে অস্তরবির লিপি লেখা,/ আমারে তার অর্থ শেখা’। সেই অস্তরবির লিপির অর্থ সে কি রঙের অর্থ? সে কি তিনি শিখতে পেরেছিলেন? না কি চিত্রকলা থেকে তাঁর মন তখনো অনেক দূরে? তেমনটাই মনে হয় আমাদের। এমন কি ‘ফাল্গুনী’ নাটকের সংলাপের মধ্যে জুড়ে দিয়েছিলেন আশ্চর্য এক বাক্য, ‘চিত্রপটে প্রয়োজন নেই– আমার দরকার চিত্তপট– সেইখানে শুধু সুরের তুলি বুলিয়ে ছবি জাগাব’– কিন্তু আজ বিশের দশকের শেষে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই চেতনা যাচ্ছে বদলে। এতকাল যিনি দেখাকে শোনায় অনুবাদ করে নিতে চেয়েছেন, তিনিই আজ ‘আমি দেখছি’ এই কথাটুকু সজোরে ঘোষণা করতে উদ্যত।
কীভাবে হল এই বদল? তাঁর মধ্যে চিত্রকলার বোধ যত গাঢ়তর হচ্ছে, ততই তিনি চোখের দেখার ওপরে ভরসা করছেন। বিশ্বজগতের ওপর এই ভরসাই আজ চিত্রী রবীন্দ্রনাথের নতুন অবলম্বন। বলতে বাধা নেই, এ এক নতুন রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব। কবিঠাকুর থেকে ছবিঠাকুরের পথে জোরকদমে এগিয়ে যাওয়া। বিশের দশকের মাহেন্দ্রলগ্নে তাঁর চিঠির প্রবাহে স্পষ্টতর হচ্ছেন সেই অন্য রবি ঠাকুর, যিনি প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে আখর থেকে আকারের দিকে সরে যাচ্ছেন। সেকথা জানান দিচ্ছেন তিনি স্বয়ং, বলছেন, ‘আমার কলমেও আসতে চায় সেই আকারে লীলা’। কোথাও আরও তীক্ষ্ণ স্বরে, ‘আবেগ নয়, ভাব নয়, চিন্তা নয়, রূপের সমাবেশ। আশ্চর্য এই যে তাতে গভীর আনন্দ। ভারি নেশা’। তাঁর চোখে ফুটে উঠছে নতুন দেখার নেশা। প্রশ্ন উঠছে, কী সেই দৃষ্টি? কেমন সে দেখা, যা তাঁকে নেশা ধরিয়ে দেয়?
দুয়েকটা উদাহরণ মেলে দিই। ‘যেমন আমার ছবি আঁকা তেমনি আমার চিঠি লেখা। একটা যা হয় কিছু মাথায় আসে, আমি সেটা লিখে ফেলি, প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় ছোটোবড়ো সে-সব খবর জেগে ওঠে তার সঙ্গে কোনো যোগ নেই। আমার ছবিও ঐ রকম, যা হয় কোনো একটা রূপ মনের মধ্যে হঠাৎ দেখতে পাই, চারদিকের কোনো কিছুর সঙ্গে তার সাদৃশ্য বা সংলগ্নতা থাক বা না থাক’। অর্থাৎ ফর্মের নির্মাণই এখানে বড় কথা, সাহিত্যের মত সে অর্থের বাহক নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে আমার মন আকাশে কান পেতে ছিল, বাতাস থেকে সুর আসত, কথা শুনতে পেত– আজকাল সে আছে চোখ মেলে, রূপের রাজ্যে, রেখার ভিড়ের মধ্যে। গাছপালার দিকে তাকাই, তাদের দেখতে পাই– স্পষ্ট বুঝতে পারি জগৎটা আকারের মহাযাত্রা। আমার কলমেও আসতে চায় সেই আকারের লীলা।’ কী আশ্চর্য অনুভব! এই রবীন্দ্রনাথ, যিনি কবিতার করিডোর ছেড়ে ছবির বারান্দার দিকে এগিয়ে চলেছেন। আর কেবল আকার নয়, রবীন্দ্রনাথের চোখে তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে রেখার মায়া। বেহুঁশের মতো বলে চলেছেন, ‘আজকাল রেখায় আমাকে পেয়ে বসেছে– তার হাত ছাড়াতে পারচিনে। কেবলি তার পরিচয় পাচ্চি নতুন নতুন ভঙ্গির মধ্যে দিয়ে। তার রহস্যের অন্ত নেই’। এর পরেই কবিসত্তার সেই অমোঘ সত্যটিকে ঘোষণা করেছেন তিনি। বলছেন, ‘যে বিধাতা ছবি আঁকেন এতদিন পরে তাঁর মনের কথা জানতে পারচি। অসীম অব্যক্ত রেখায় রেখায় আপন নতুন নতুন সীমা রচনা করচেন– আয়তনে সেই সীমা, কিন্তু বৈচিত্র্যে অন্তহীন। আর কিছু নয়, সুনির্দিষ্টতাতেই যথার্থ সম্পূর্ণতা। অমিতা যখন সুমিতাকে পায় তখন সে চরিতার্থ হয়। ছবিতে যে আনন্দ, সে হচ্চে সুপরিমিতির আনন্দ…’।
রেখার মধ্যে দিয়ে আকারের মধ্যে দিয়ে কী এক বিমূর্ত অনুভর রবীন্দ্রনাথের মনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে! এই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবির দরজায় প্রবল ভাবে ঘা দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তের রবীন্দ্রনাথ। চিঠির ছত্রে ছত্রে এমনি করে ছড়িয়ে আছে কবি রবীন্দ্রনাথ থেকে ছবির রবীন্দ্রনাথের যাত্রাপথের গ্রাফলাইন, প্রত্যক্ষ পথরেখা। এই পত্রসম্ভারের দিকে নেহাত অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে থাকা যায় না। এর প্রত্যেকটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ আমাদের ভাবনাকে উসকে দিতে চায়। নতুন রবি ঠাকুরকে চিনিয়ে দেয়। তাঁর মনের নিভৃত রসায়নাগারে শিল্পীচিত্তের কি আলোড়ন প্রবাহিত, তার প্রত্যক্ষ দলিল হয়ে উঠেছে এই পত্রমালা। রানী মহলানবিশকে কাছে লেখা বিপুল পরিমাণের চিঠিতে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উপচে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের জ্বলন্ত ক্রিয়েটিভ সত্তা। কখনও মনে হয়, শ্রাবণের ধারার মতো এই পত্রস্রোত ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। জীবনের প্রথম অধ্যায়ে যেখানে তিনি কবিতার ভুবনখানা শক্ত হাতে ধরেছেন, সেই সময় স্নেহের বিবিকে ছিন্নপত্রাবলির পাতায় লিখেছিলেন, ‘আমার গদ্যে পদ্যে কোথাও আমার সুখদুঃখের দিনরাত্রিগুলি এরকম করে গাঁথা নেই’। পাশাপাশি রানী মহলানবিশকে লেখা চিঠিতে রয়ে গেল, জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ‘ছবি-আঁকিয়ে’ রবীন্দ্রনাথের আরেক আত্ম-উন্মোচন। তাঁর ছবিকে তলিয়ে বুঝতে গেলে, তাঁর চিত্রভাণ্ডারের দুয়ারে কড়া নাড়তে হলে এই পথের রশিখানা আমাদের শক্ত হাতে ধরে থাকতেই হবে।