এক কিশোরীকে দেখা যাচ্ছে দর্শক-শ্রোতার সামনে হরিনামের ব্যঞ্জন মিশিয়ে উসকে দিচ্ছে নারীবিদ্বেষ আর ধর্মের মোড়লি। যে ধর্ম মানুষের সামনে প্রতিনিয়ত লক্ষ্মণরেখা টেনে দিতে চায়, এই কিশোরী সেই নিয়ন্ত্রকের সুরেই কথা বলে। ধর্মই বলা হোক কি পিতৃতন্ত্র– শিশুকেও ছাড়ল না তাদের ফুট সোলজার হিসাবে ব্যবহৃত করতে।
মাস দুই আগেই উত্তরপ্রদেশের একটি খবর সামনে এসেছিল, যেখানে দেখা গিয়েছিল বছর ষোলোর এক কিশোরীকে সরাসরি বহিষ্কার করেছে মিরাটের এক স্কুল। জানা গিয়েছিল, ধর্মকে আক্ষরিক অর্থে ধারণ করতে গিয়েই এহেন শাস্তির মুখে পড়েছে ওই ছাত্রী। হ্যাঁ, তার মা-বাবা জানিয়েছিলেন, সে হিন্দু ধর্মের নানারকম প্রতীক নিজের শরীরে ধারণ করে থাকে। কপালে তিলক কাটে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে। এদিকে বেসরকারি স্কুলটিতে ইউনিফর্মের সঙ্গে অন্য কিছু পরার নিয়ম নেই। তার চেয়েও বড় কথা হল, কেবল নিজের মতো ধর্মীয় আচারবিচার পালন করেই ক্ষান্ত দেয়নি মেয়েটি। অন্যান্য পড়ুয়াকে হিন্দু ধর্মের গুরুত্ব বোঝাতে সে যেমন বদ্ধপরিকর, তেমনই ‘কাশ্মীর ফাইলস’ কি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’-র মতো সিনেমার উদাহরণ দিয়ে সে বন্ধুদের লাভ জিহাদ নিয়েও অবহিত করে, আর মুসলিমদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রথমে মনে হয়েছিল, যোগীরাজ্য তো! কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় চোখ রাখতেই দেখা গেল, এগিয়ে বাংলা। পশ্চিমবঙ্গেই এমন একটি বাঙালি কিশোরীর খোঁজ মিলল, যে নিয়মিত ভার্চুয়াল মিডিয়ার তাবত দর্শক-শ্রোতার সামনে হরিনামের ব্যঞ্জন মিশিয়ে এহেন বাণী বিতরণ করে থাকে। কখনও সে সতর্কবাণী শোনাচ্ছে যে, ছাগলের মাংস খেলে অন্তঃসত্ত্বা নারীর সন্তানের বোধবুদ্ধিও তথৈবচ হবে, কখনও প্রেমপর্বে যুগলদের গলাগলি নিয়ে ব্যঙ্গ শানাতে ছাড়ছে না, কখনও আবার সারদা কাণ্ডে ‘ভাইপো’-র দিকে ইঙ্গিত করে বসছে। তবে সবকিছুর মধ্যে থেকে ঘন ঘন উসকে উঠছে নারীবিদ্বেষ আর ধর্মের মোড়লি। যে ধর্ম মানুষের সামনে প্রতিনিয়ত লক্ষ্মণরেখা টেনে দিতে চায়, এই কিশোরী সেই নিয়ন্ত্রকের সুরেই কথা বলে। যদিও বয়সের সাপেক্ষে স্পষ্ট, এসব কথা বলার এবং এভাবে কথা বলার নিজস্ব বোধে সে এখনও পৌঁছয়নি। শিশুদের মানসিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশের যে চারটি স্তরের কথা বলেছিলেন মনস্তত্ত্ববিদ জাঁ পিয়াজে (Jean Piaget), তা জানিয়েছিল ১২ বছর বয়স থেকে শুরু হয় ফর্মাল অপারেশনাল স্তর, যে বয়সে কোনও শিশুর বিমূর্ত এবং যৌক্তিক– উভয়প্রকার চিন্তার ক্ষমতা তৈরি হয়। ফলে এই স্তরেই কোনও শিশু প্রথম নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা দার্শনিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করে, অন্তত তা নিয়ে ভাবার ক্ষমতা সেই সময় থেকেই তার মধ্যে সহজাতভাবে বিকশিত হয়। দেখা যাচ্ছে, সেই সহজাত অর্জনের আগেই এই কিশোরীর মস্তিষ্কে পুরে দেওয়া হচ্ছে কিছু বাঁধা বুলি এবং তার সঙ্গে মানানসই হাবভাব। অর্থাৎ কোনও রকম নিজস্ব বিশ্বাস তৈরির আগেই তার মধ্যে পছন্দমতো বিশ্বাস বুনে দিচ্ছে কোনও কর্তৃপক্ষ। প্রতিস্পর্ধাকে মূলে বিনাশ করার লক্ষ্যে যেমনটা ক্ষমতা করেই থাকে। আলথুজারের বলা সেই ‘আইডিয়াল স্টেট অ্যাপারেটাস’-এর একটা বড় কাজই তো শিশুপাঠ্যকে শাসকের পছন্দসই করে তোলা। এখানে সেই শাসক আবার বহুমুখ। সে একদিকে শিশুকে নিজের সৈনিক করে তোলার ক্ষমতাকাঠামো, আরেকদিকে নারীকে গণ্ডিবেঁধে দেওয়ার পিতৃতন্ত্র, আরও একদিকে নিয়ন্ত্রণকামী ধর্মের আধিপত্য কায়েম করার নেপথ্য ছক।
সেই ছক যে পুরোপুরি ব্যর্থ, এ কথা ভাবার জায়গা নেই। কারণ কিশোরীর চ্যানেলটির তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিটি ভিডিওর হাজার হাজার দর্শকসংখ্যা, আর তার একটা বড় অংশই একই আদর্শ কিংবা আদর্শহীনতার শরিক। কিন্তু উল্টোদিকে, শিশুর মুখে এ জাতীয় কথা শুনে ব্যঙ্গবিদ্রুপেও ফেটে পড়েছেন অনেকেই। একটি কিশোরী, যার বয়স ন’-দশ বছর বলে ধরে নিচ্ছি, তাকে তার বাবা-মা হাজার হাজার লোকের সমালোচনার দাঁত নখের নিচে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। কেন? ভিউ হবে বলে। যে ভিউ এখন আর ধরাছোঁয়ার বাইরে কোনও বিমূর্ত বস্তু নয়, তা হাতভর্তি টাকার জোগান দিতে পারে। এবং এই ভিউ-ও আর কোনও ধরাবাঁধা বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে নেই, তা রাঁধা থেকে চুল বাঁধা থেকে চুলোচুলি করা যে কোনও কিছুতেই হতে পারে। যে কারণে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য নারী এবং পুরুষ আজকাল নিজেদের সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার বলতে পছন্দ করছেন। সেই ইঁদুর দৌড়েই এবার নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই নেহাত শিশুদেরও। কেউ তর্ক করতে পারেন, ইঁদুর দৌড় কি আগে ছিল না? কেবল পড়াশোনা কেন, বাচ্চার প্রতিভা বিকাশের জন্য তাকে অষ্টপ্রহর কোনও না কোনও প্রতিভা প্রক্ষালন/নিষ্পেষণ যন্ত্রে জুতে দেওয়া হত না কি? বাড়িতে অতিথি এলেই তাঁর সামনে বাবুকে দিয়ে ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিট্ল স্টার’ আওড়াতে কিংবা দু’-কলি ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গাওয়াতে না পারলে অনেক মা-বাবা যারপরনাই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যেতেন। সেও তো একরকম ভিউ-এর জন্য ছুট-ই বটে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, প্রথমত সেইসব গান শেখা, আঁকা শেখা, নাচ শেখা ইত্যাদিকে প্রাথমিকভাবে শিশুর অবকাশ যাপন বলেই দেখে থাকেন অনেক অভিভাবক, দ্বিতীয়ত সেখানে অর্থ উপার্জনের কোনও গল্প নেই। এখানে দ্বিতীয় শর্তটি প্রবলভাবেই বর্তমান। আর ইউনিসেফ স্পষ্টই বলছে, শিশুর ৫ থেকে ১১ বছর বয়সের মধ্যে, যদি সে দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা উপার্জন সংক্রান্ত কোনও কাজ করে, তাহলে তাকে শিশুশ্রমিক বলেই গণ্য করতে হবে। সাজসজ্জা, বক্তব্য অভ্যাস করা, এবং ভিডিও শুট, সব মিলিয়ে এই শিশুটির যে পরিমাণ সময় ব্যয় হয়, তা আন্দাজ করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আর সোশাল মিডিয়ায় একাধারে বিপুল জনপ্রিয়তা এবং ট্রোলের লক্ষ্য হয়ে ওঠার পর, তার জন্য পড়াশোনা এবং স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ কতখানি বহাল রয়েছে, তা নিয়েও সংশয় জাগে।
ক্ষমতাতন্ত্রে একটি শিশু কোনও নারী কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের চেয়েও ক্ষমতাহীন। ‘শিশু’ নামে একটি গল্পে মহাশ্বেতা দেবী বোঝাতে চেয়েছিলেন, আদিবাসী জনতা কীভাবে নাগরিক মূল স্রোতের কাছে শিশুসুলভ হয়েই থেকে যাচ্ছে। ভেবে দেখতে গেলে, যা মূলস্রোত, ক্ষমতার লাগাম যার হাতে, সে সবসময়েই অপর বা ‘আদার’-কে একরকম করে ‘ইনফ্যান্টালাইজ’ করেই চলে। পরিবার হোক কি রাষ্ট্র, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যখনই অপর পক্ষের স্বার্থের কোনও রকম সংঘাত বাধে, অথবা কোনও নির্ধারক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সন্ধিক্ষণ এসে উপস্থিত হয় আর সেই সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায় কর্তৃপক্ষের ভাবনার পরিপন্থী, তখনই সেই শিশুকরণের সুরে ক্ষমতাবান বলে, অপর পক্ষ নিজেদের ভালো বুঝছে না। আর প্রায় অপত্যস্নেহের ভানেই, সেই ভালো বোঝার দায় নিজের হাতে তুলে নিতে চায় সে। কথা হচ্ছে, আলোচ্য ক্ষেত্রেও কি একভাবে তেমনটি ঘটছে না? এই ভিডিওগুলির উপভোক্তা যাঁরা, ধর্মের নীতি ও ন্যায্যতা অনুযায়ী কী করণীয় এবং কী নয়, সে কথা তাঁরা জানেন না বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। ধরে নেওয়া হচ্ছে যে সেই নির্দেশিকাটি না জানলে তাঁদের জীবন বিপন্ন। অর্থাৎ ওরা নিজেদের ভালো বুঝতে পারছে না, প্রায় এই সুরেই তাঁদের বুঝিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে সেই নীতি ও নিয়ম। কাহিনির টুইস্ট কিংবা প্যারাডক্স এখানেই যে, সেই নীতি বেরিয়ে আসছে যার মুখ থেকে, সে বয়সের দিক থেকে সত্যিই শিশু। এক্ষেত্রে মেঘনাদপ্রতিম কর্তৃপক্ষ যে-ই হোক, ধর্ম কিংবা পিতৃতন্ত্র, একটি শিশুকে নিজের রাজনীতির ফুট সোলজার হিসেবে নির্বাচন করে কি সে আসলে দর্শককে শিশু হিসেবে গণ্য করার সেই বার্তাটিই জারি রেখে গেল?