১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর দিনটি ‘সংখ্যালঘু অধিকার দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণের সংখ্যালঘু মানুষদের অধিকার সম্বন্ধে প্রচার, প্রসার ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। পরে ভিন্ন-যৌনতার মানুষ যারা, তাদের অধিকারের সংলাপও এর মধ্যে যুক্ত হয়। ভারত ইতিমধ্যে চাঁদে যান পাঠিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজও এদেশে খোলা পায়খানা-পাইপলাইনে বহু ধাঙরের প্রাণ যাচ্ছে প্রতি বছর, সাংসদে মহিলা-সংরক্ষণ বিশ বাঁও জলে, সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের বিবাহ-সন্তানপালনের আইনি স্বীকৃতি নেই, হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশ করা যাবে এমন ‘পাবলিক টয়লেট’ অপ্রতুল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য আনুভূমিক সংরক্ষণ (হরাইজন্টাল রিসার্ভেশন) নেই এবং আজও বহু ভাষাভাষীর, ১৩০ কোটির ভারতে স্বীকৃত ভাষা কেবল ২২!
একজন বাঙালি রেডিও জকি কলকাতা মেট্রোতে নিয়মিত ভ্রমণ করেন। রোজ তিনি লক্ষ করেন মেট্রোতে ‘মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন’ ফাঁকা থাকলেও অনেক মহিলাই তাতে না বসে প্রত্যেকের জন্য যেসব আসন, সেগুলোতে বসেন। এতে অনেক পুরুষ যারা সবার-জন্য-আসনে বসলেও বসতে পারত তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মহিলাদের এ-হেন সংবেদনশীলতার অভাব রেডিও জকিকে ব্যথিত করেন। তিনি তাই এমনই অসংবেদনশীল এক মহিলার ছবি তুলে, সমাজমাধ্যমে সে-ছবি ছড়িয়ে নিজের মানবিকতার পরিচয় স্পষ্ট করেন। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনেই মহিলারা আগে বসবেন– এটাই দস্তুর হওয়া উচিতের প্রচার হয়। কিন্তু এ প্রশ্ন কেউ তোলে না যে, মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত আসন যখন ভর্তি থাকে এবং বাকি আসনও পূরণ হয়ে যায় তখন কি কোনও মেয়েই বসতে পারে? দাঁড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কি তাদের উপায় থাকে আর, যেমন একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও হয়? কিংবা আমরা ভুলে যাই সবার-জন্য-আসনেও মেয়েদের সমান অধিকার আছে। মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত আসন মেট্রো বা অন্যান্য গণপরিবহণে এখনও মূল আসনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ, যেখানে এখন পুরুষ-নারীর অনুপাত ১:১। এই সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল গণপরিবহণে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে। সব সংরক্ষণেরই এই চরিত্র। সংখ্যালঘুকে সমানাধিকার দিতে সংরক্ষণের প্রয়োজন আজও অপরিসীম। ইতিহাস বলে মেয়েদের গণপরিবহণ চড়া এত সহজ ছিল না। স্তনে-হাত-পড়া, চিমটি খাওয়া, পুরুষের লিঙ্গ দ্বারা পাছায় ধাক্কা খাওয়া– এসব সহ্য করেই মেয়েদের গণপরিবহণে চলাফেরা করতে হত। এখন গণপরিবহণে মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক বেড়ে পুরুষের সমান সমান হলেও এখন যে তাদের দুর্ভোগের মাত্রা খুব কমেছে, তা নয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেয়েদের-জন্য-সংরক্ষিত আসনই মেয়েদের, বাকিগুলোতে তারা যদি বসে, তবে বহু-পুরুষের-বসার-অধিকার তারা কেড়ে নিচ্ছে, এমন একটা অপরাধবোধের বীজ-বপন।
এই ‘সংখ্যা’ জিনিসটা বড় গোলমেলে। আরও মারাত্মক সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠের রাজনীতি। সংখ্যাগুরু তার অধিকার ছাড়তে সব সময়ই নিমরাজি, তা স্বাভাবিক। কিন্তু যুগের পর যুগ সামাজিক ‘প্রিভিলেজ’ উপভোগ করেও তার ওপর হওয়া তথাকথিত ‘অত্যাচারের নানা ইতিহাস’ সে তুলে ধরতে চাইবে কেবল সংখ্যালঘু তার সমান অধিকার পেলে বা সেই অধিকারের সংরক্ষণ হলে, তা কেমন কথা? যেমন ধরুন, শিক্ষায় সংরক্ষণ। ভারতে ‘সংরক্ষণ’ আইন হওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের কি জানা ছিল না উঁচু জাতির মানুষেরা কত শত বছর ধরে বিশেষ সামাজিক অধিকার পেয়ে এসেছে শিক্ষা-সহ জীবনের সব ক্ষেত্রে? তাহলে কেন কেবলমাত্র যখন ‘এসটি-এসসি-ওবিসি’-রা সংরক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে প্রথমবার প্রবেশের সুযোগ পেল, তখন ‘জেনারেল’-রা ভাবল ‘সমানাধিকারের কথা’? এখনও সেই ‘জেনারেল’-রা মনে করে ‘এসটি-এসসি-ওবিসি’-রা তাদের আসন কেড়ে নিচ্ছে। অথচ, তারা সরকারের কাছে জানতে চাইছে না কেন সমগ্র আসন সংখ্যাই বাড়ানো হচ্ছে না, যাতে সংরক্ষণ দেওয়ার পরেও বহু ‘জেনারেল’ আসন পেতে পারে? কিংবা ধরুন, উৎসবের মরশুমে কলকাতার রাস্তা সাত-আটদিন আটকে সংখ্যাগরিষ্ঠের দুর্গাপুজো চলে, ট্যাগলাইন হয় ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ কিন্তু ইদ-মহরমে একবেলা ট্রাফিক এদিক-ওদিক হলে আমরা বলে উঠি, ‘ওদের সারা বছর প্রচুর ফেস্টিভ্যাল আর ছুটি। ওসব আমরা পাই না। ওরা খুব বেড়ে যাচ্ছে!’ সংখ্যালঘুর উৎসবের দিন আমরা বলি, ‘আমার অনেক মুসলিম বন্ধু আছে।’ আমরা বিরিয়ানি-ফিরনি কেউ খাওয়াও বলে হাঁকুপাকু করি সমাজমাধ্যমে, কিন্তু ‘মুসলমানের উৎসব’-এ গিয়ে শামিল হই খুব কম। বা আমাদের জলাশয়গুলোতে দুর্গাবিগ্রহ ভাসিয়ে আমরা আবেগ প্রদর্শন করি, শ্রদ্ধাবনত হই। তখন কোনও কেমিক্যাল আমাদের চোখে পড়ে না কিন্তু ছটপুজোর তেল-সিঁদুর কোনও পুকুরে মিশলেই হঠাৎ বৈজ্ঞানিক হয়ে পড়ে এই পুজোর ফলে জলাশয়ে কত রকমের রাসায়নিক ক্রিয়া হতে পারে, তা একে অপরকে বোঝাই!
সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর পট পরিবর্তন একটি সূক্ষ্ম চলাচলের ঘটনা। দেখা যায় যে-সংখ্যালঘু সমাজে অত্যাচারিত, সে-ই তার বলয়ে সংখ্যাগুরু হয়ে পড়ে যখন, তখন তার সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচারে সেও পিছপা হয় না। এ বিষয়ে প্রয়াত ফিল্মপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি টিভি সাক্ষাৎকার অনেকের মনে আছে হয়তো। ঋতুপর্ণ জনৈক কৌতুকাভিনেতাকে সংখ্যা-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বুঝিয়েছিলেন। অভিনেতা ব্যক্তিগত ধর্মের দিক থেকে সংখ্যালঘু হয়েও যৌনসংখ্যালঘু যারা সেইসব দুর্বল, অসুরক্ষিত গোষ্ঠির মানুষকে মারাত্মক গ্লানির দিকে ঠেলে দিতেন নারীসুলভ ঋতুপর্ণকে টিভির পর্দায় নকল করে। সংখ্যালঘু হয়েও তিনি অন্য সংখ্যালঘুর ব্যথা উপলব্ধি করতে পারতেন না। এখানেই ‘ইন্টারসেক্সশনালিটি’-র কথা এসে পড়ে। সংখ্যালঘু কি আদৌ কখনও বোঝে সংখ্যাগরিষ্ঠের পৃথিবীতে তার নিজের বা অন্য সংখ্যালঘুর স্থানাঙ্ক যে এক– সেই বিষম সত্যটি? সে বার বার কেন সংখ্যাগরিষ্ঠই হয়ে উঠতে চায়? যে-কারণে আদিবাসী নারীর যন্ত্রণার ইতিহাস আমাদের জানা হয় না, রামধনু আন্দোলনে লেসবিয়ান ও রূপান্তরকামী-পুরুষের অবদানের কথা ততটা প্রতিভাত হয় না, মানসিক প্রতিবন্ধীর সরকারি চাকরি পাওয়ার যুদ্ধ সম্বন্ধে কম আলোচনা হয় এবং বাংলা সাহিত্য আলো করে বসে থাকেন কেবল মুখার্জি-চ্যাটার্জি-ব্যানার্জি-চক্রবর্তী-ভট্টাচার্যরা কিংবা খুব বেশি হলে ঘোষ-বোস-সেন-দাশগুপ্তরা। দাস-মণ্ডল-হালদার-ওঁরাও-মালেদের লেখা পূজাবার্ষিকীগুলোয় কমই চোখে পড়ে।
১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর দিনটি ‘সংখ্যালঘু অধিকার দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় পৃথিবীময় বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণের সংখ্যালঘু মানুষদের অধিকার সম্বন্ধে প্রচার, প্রসার ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। পরে ভিন্ন-যৌনতার মানুষ যারা, তাদের অধিকারের সংলাপও এর মধ্যে যুক্ত হয়। ভারত ইতিমধ্যে চাঁদে যান পাঠিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজও এদেশে খোলা পায়খানা-পাইপলাইনে বহু ধাঙরের প্রাণ যাচ্ছে প্রতি বছর, সাংসদে মহিলা-সংরক্ষণ বিশ বাঁও জলে, সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের বিবাহ-সন্তানপালনের আইনি স্বীকৃতি নেই, হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশ করা যাবে এমন ‘পাবলিক টয়লেট’ অপ্রতুল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য আনুভূমিক সংরক্ষণ (হরাইজন্টাল রিসার্ভেশন) নেই এবং আজও বহু ভাষাভাষীর, ১৩০ কোটির ভারতে স্বীকৃত ভাষা কেবল ২২! এর পাশাপাশি শিশুশ্রম, বয়স্ক মানুষদের অর্থনৈতিক অসঙ্গতি, জাতিগত অস্পৃশ্যতা, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সুযোগ না পাওয়া, ভিন্ন ধর্মের হলে কিংবা বিশেষ লিঙ্গ-যৌনতার কারণে এমনকী, ঘর ভাড়া পর্যন্ত না পাওয়া– এগুলো তো জলভাত হয়ে গেছে। এছাড়া, সংখ্যালঘুর বোধ আমাদের তৈরি হয়নি, সংরক্ষণকে আমরা ঘৃণার চোখে দেখেছি এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত– কোনও উদ্যোগই চোখে পড়ার মতো গড়ে ওঠেনি। আমরা ‘মোল্লা’, ‘খোট্টা’, ‘হোমো’, ‘লেডিস’ শব্দগুলোকে গালিতে পরিণত করেছি। আর আমাদের গালিগালাজের বেশিরভাগ জুড়ে আজও মহিলারাই– সে বোন-বেটি-মা-মাসি যাই হোক না কেন! আজ মেয়েরা কেন ‘লেডিস সিট’-এ না বসে ‘জেনারেল সিট’-এ বসছে, সেই নিরীক্ষায় মজে আমরা ওই মহিলারই ছবি তুলে রাখছি। অথবা তার গোপনীয়তার অধিকারের তোয়াক্কা না করে সমাজমাধ্যমে সে-ছবি ছেড়ে দিচ্ছি। এ বাংলারই এক মহিলা-কবি কোনও একদিন লিখেছিলেন, ‘সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ কামিনী রায়ের এই পঙক্তিগুলো প্রতি ‘সংখ্যালঘু অধিকার দিবস’-এ আমরা স্মরণ করব নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই রাজ্য, সেই রাষ্ট্র আর সেই পৃথিবী কবে গড়ে উঠবে জানি না যেদিন সংখ্যালঘু কোনও সমানাধিকার থেকে আর কখনও বঞ্চিত হবে না।