এরল ভ্যানগার্ড। বয়স ৭৮। পেশায় ছিলেন রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের হর্স-ট্রেইনার। গল্প বলতে ভালোবাসেন এরল। ছোট্ট আড্ডায় উঠে এল বো-ব্যারাকের পুরনো স্পষ্ট স্মৃতি, এল খানিক মরচে ধরা আত্মীয়তার বর্তমানও। তবুও ক্রিসমাস আছে, তবুও প্রার্থনা আছে। হাজার বদলে গিয়েও ফিরে আসা এই বো-স্ট্রিটে। পড়ুন, কারণ এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা। রোববার.ইন-এর তরফ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুচিস্মিতা দাস।
শীতকাল কলকাতাকে ছুঁতে চাইলে, নানাবিধ অভ্যাসের সঙ্গে আমাদের একবার মনে পড়ে বো-ব্যারাকের কেক আর হাতে বানানো ওয়াইনের কথা। বো-ব্যারাকে একটা সময় এসে থাকত কিছু গোয়ান মানুষরা। এই কেক বানানোর রেসিপি শেখা তাদের থেকেই এখানকার মানুষদের।
বো-ব্যারাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ সৈন্যদের থাকার ছাউনি। ব্রুটালিস্ট কাঠামোয় তৈরি ছিমছাম তিনমালার বাড়ি। রঙচটা লাল দেওয়াল, মেঝে ছুঁয়েছে সবুজ ফ্রেঞ্চ-উইন্ডো, পাশে একফালি ব্যালকনি। ডিসেম্বরের ম্লান রোদ্দুর বরাবরই সময়কে পিছনে ফেলতে চায়। কিন্তু সময় এগিয়েছে। আর তার সঙ্গে খানিক ঝুঁকে পড়েছে বো-ব্যারাক। বউবাজার এলাকায় তিনটে স্ট্রাইপে রয়েছে এই ব্যারাক। প্রত্যেকটি তলায় রয়েছে ৮ থেকে ৯টা ফ্ল্যাট। কয়েকটা দুই কয়েকটা এক কামরার। সব মিলিয়ে হিসেব করে যা দেখা গেল, এখন এখানে রয়েছে প্রায় ১৪৫টি অ্যাংলো পরিবার। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরেই এখানে থাকতে এসেছিলেন অ্যাংলো মানুষরা। এরপর বো-ব্যারাকের দায়িত্ব নেয় ‘ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’। তবে এখন শুধু ‘পিওর অ্যাংলো’-রাই নয়, রয়েছেন চাইনিজ অ্যাংলো, গুজরাতি অ্যাংলো ও নেপালিরাও।
আমাকে বো-ব্যারাক ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন গাই গোমস। চাকরি করেন একটি ট্রাভেল এজেন্সি-তে।
ক্রিসমাসের মিটিং-এ যদিও এখন খুবই ব্যস্ত তিনি। গাই, তাঁর ছোটবেলায় শুনেছেন, এই এলাকা নাকি ছিল পরিত্যক্ত। কাছাকাছিই ছিল গ্রেভইয়ার্ড, আর আশপাশে মুসলিম বসতি, তাই কেউই এই অঞ্চলে এসে বিশেষ থাকতে চায়নি। তখনই নামমাত্র ভাড়ায় এখানে এসে থাকতে শুরু করে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। তবে এখন অনেকেই বো-ব্যারাক ছেড়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েছেন। কারণ, বো-ব্যারাকের সংস্কারের অভাব, জলের অসুবিধা আবার কিছু-কিছু ফ্ল্যাটের জন্য আছে কমন শৌচালয়। তখন থেকেই এখানে এসে পড়েছেন কিছু অন্য সম্প্রদায়ের মানুষজন।
কথা বলতে এসেছিলাম বো-ব্যারাকের একজন পুরনো মানুষের সঙ্গে। এরল ভ্যানগার্ড। সকলে মিলে বসা হল গাই-এর বাড়িতেই। এরল-এর বয়স ৭৮। পেশায় ছিলেন রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের হর্স-ট্রেইনার। গল্প বলতে ভালোবাসেন এরল। আমি বাঙালি শুনে বললেন, তাঁর খুব পছন্দের বাঙালি খাবার ও স্পাইস। সেই আড্ডার একফালি রইল রোববার.ইন-এর পাঠকদের জন্য।
আপনার ছোটোবেলার বো-ব্যারাক বলতে কী মনে পড়ে?
দেখো, আমি তো ‘বো-ব্যারাক’ বলি না। আমি এখনও বলি ‘বো-স্ট্রিট’– যা ছিল আমার বাড়ির ঠিকানা। তখন বো-স্ট্রিটে কেউ ঘরের ভিতর থাকত না। এখন যেমন এসেছ, দেখছ ফাঁকা-ফাঁকা রাস্তা, তখন এলে দেখতে, প্রায় সারাক্ষণই সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে। খেতামও বাইরে,– রোজ রাত ৯টার আড্ডা হত বাইরে। তখন পুরো বো-স্ট্রিট মিলিয়ে ছিল আমাদের ‘হোম, আ স্যুইট হোম’।
আচ্ছা, রিটায়ারমেন্টের পর কী করে সময় কাটছে আপনার?
জীবন থেকে রিটায়ারমেন্ট মধুর। তবে ক্লান্তিকর। আমি টার্ফ ক্লাবে ছিলাম বহু বছর। আমি জানি, বাচ্চা ঘোড়াগুলোকে কী করে দৌড়ের জন্য তৈরি করতে হয়। তাদের খাদ্যাভ্যাস। ঘোড়াগুলোও তো আমার সঙ্গে বাচ্চা থেকে বুড়ো হল।
…………………………………………..
চিনুন কলকাতার চিনাপাড়া পর্ব এক : চিনাপাড়ার প্রতিটা মানুষের মধ্যে একটা ইতিহাস-মেশানো গল্প আছে, যা আমি পড়তে চেয়েছিলাম
……………………………………………
আপনার পরিবার? কবে থেকে বো-ব্যারাকে?
আমার মা এসেছিলেন বো-ব্যারাকে। মায়ের নাম মারটিল মেডিরা। ‘মেডিরা অ্যান্ড কোম্পানি আন্ডারটেকারস’। আন্ডারটেকারদের সম্পর্কে জানো? খ্রিস্টান মৃত্যুর পর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল এঁদের। মৃতদেহকে কফিনে রাখা, বেরি করার আগে জায়গা রেডি করা– এইসব ছিল আন্ডারটেকারদের কাজ। খুবই পুরনো পেশা। সম্ভবত মেডিরা-রাই কলকাতায় শেষ করেছে এই কাজ। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আর্মিতে। বাবা ব্রিটিশদের হয়ে বর্মা জঙ্গলে ছিলেন। বরাবরই ডিসিপ্লিনে থাকা পছন্দ করতেন, কিন্তু সেরকমই ছিলেন চটপটে। আমাদের বিভিন্ন দেশের শাস্তির কথা শোনাতেন।
আপনি তো বললেন কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আপনার অনেক বন্ধু কানাডা কি মেলবোর্নে চলে গেছে। আপনার কোনও দিন ইচ্ছে হয়নি দূরে কোথাও চলে যেতে?
না। ‘আই লাভ বো-স্ট্রিট। আই লাভ মাই লিভিং টু’। শহরকে ভালোবাসতে গেলে ভালো-খারাপ দুই মিলিয়েই ভালোবাসতে হবে। কলকাতার এই বাজ, ঘিঞ্জি অনিয়মের মধ্যে একটা ছন্দ আছে। আমার বন্ধু কি শুধুই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা? আমার কত বাঙালি বন্ধু আছে। আমাকে কেউ অ্যাংলো বললে আমি তো বলি, ‘ফার্স্ট কল মি অ্যান ইন্ডিয়ান, দেন কল মি হোয়াটেভার ইউ উইশ ট্যু’। আসলে এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নামটা নিয়েই আমার কিছু সমস্যা আছে। আমার মনে হয় এই নামের মধ্য দিয়ে আমাদের পরিচিতি সঠিকভাবে প্রকাশ পায় না।
আপনার স্কুলজীবনের কথা কিছু বলুন।
আমাদের সময়ে এই অঞ্চলে দুটো ভালো স্কুল ছিল। সেন্ট জর্জ’স স্কুল এবং সেন্ট জোসেফ’স স্কুল। প্রথম স্কুলটায় পড়তে পয়সা লাগত না, যেটায় আমি পড়েছি। পরেরটায় আমার দাদা পড়েছে। এবার তুমি জিজ্ঞাসা করতেই পারো, আমি ভালো স্কুলটা বাদ দিয়ে খারাপ স্কুলে পড়তে গেলাম কেন? আমার অ্যাংলো বন্ধুরা সব ছিল ওই স্কুলে। আসলে আমাদের সময়, জীবনকে চিন্তা করতে কেউ শেখায়নি। আমরা বরাবরই ছিলাম প্রাণখোলা, ‘লাইক লিভিং লাইফ কিং সাইজ’। তুমি বলছিলে না, বো-ব্যারাক ছেড়ে আমরা চলে যাচ্ছি কেন? এ-প্রজন্মের অনেকে বিয়ে করছে, বিয়ে করার আগেই তারা ভাবে, ভালো থাকার কথা। আমরা এত কিছু ভাবিনি। আমাদের সময় বিয়ে ব্যাপারটা পুরোটাই ছিল অ্যাডভেঞ্চার আর এনজয়মেন্ট। আর বললামই তো, বো-স্ট্রিট পুরোটা মিলিয়েই ছিল আমাদের পরিবার। শুধু ঘরের ভিতর পরিবার ছিল না, তার বাইরেও ছিল।
…………………………………………..
চিনুন কলকাতার চিনাপাড়া পর্ব দুই : পরিবার মানেনি, তবুও বাঙালি মেয়ে ও চাইনিজ ছেলেটি বিয়ে করেছিল প্রেম করেই
……………………………………………
এই যে পরিবার, কীভাবে হয়ে উঠেছিলেন, আরেকটু যদি বিস্তারে বলেন।
আমরা খেলতাম, হাসতাম, আড্ডা দিতাম। এখন সব অ্যাংলো ছেলেমেয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কিংবা লা মার্টিনিয়ারে পড়ে। আমাদের অত আর্থিক ক্ষমতা ছিল না। তাই আমরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা বেশিরভাগই ছিলাম বোর্ডারস। তখন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা নয় কি এগারো ক্লাসের পর থেকেই কাজ শুরু করত। কাজ পাওয়ার একটা কারণ হিসাবে বলতেই পারো ইংরেজি ভাষায় আমাদের দক্ষতা। আর যে-কোনও ধরনের কাজের প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়ার কারণ হল যে, আমরা বরাবর দেখতে অভ্যস্ত এই কর্মপ্রবণতা। আমাদের হেরিটেজ নেই, কারও রেখে যাওয়া জিনিস নেই, পুরোটাই এভরি-ডে বেসিস।
কী খেলা হত এই বো-ব্যারাক জুড়ে?
খেলাধুলায় আমরা বরাবরই ভালো ছিলাম। অনেক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরাই এই স্পোর্টসের জন্য চাকরি-বাকরিও পেয়েছে। আমাদের বো-ব্যারাকে খুবই জনপ্রিয় ছিল হকি খেলা। মে মাস নাগাদ খুব বড় করে হত হকি টুর্নামেন্ট। হকি স্টার লেসলি ক্লডিয়াস তো আমাদেরই লোক। তিনি এসেওছেন এখানে। বাচ্চা থেকে শুরু করে এখানকার মেয়েরা, প্রত্যেকেই খুব ভালো করে জানত আমাদের খেলার নিয়ম। কিন্তু প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে বো-স্ট্রিটে এই হকি টুর্নামেন্ট আর হয় না। আর আমাদের পড়াশোনার কথা যদি বলো, আমি বলব খ্রিস্টান মিশনারি আর আইরিশ ব্রাদারদের কথা। আমাদের কথা এ দেশের লোকরা কতটা ভেবেছিল জানি না, তবে ভেবেছিলেন তাঁরা। আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছিলেন ‘নান’-রা। বিশেষ করে, ‘অক্সিলিয়াম নান’ আর ‘লোরেটো নান’-রা।
আপনাদের সঙ্গে এখনকার প্রজন্মের তফাত কোথায়?
আমরা ছিলাম ছন্নছাড়া, ব্যাকবেঞ্চারস। শিক্ষকরা ধরেই নিতেন ‘নাথিং গুড উইল কাম ফ্রম আস’। আমরা কোনও কিছুরই কেয়ার করিনি। কিন্তু এখনকার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করছে, তারা তাঁদের কর্মজীবন নিয়ে সিরিয়াস। আজকে বো-ব্যারাক ছেড়ে তুমি যদি অন্য কোথাও থাকতে চাও, তাহলে পরিবারের পুরুষ ও মহিলা দু’জনকেই ওয়ার্কিং হওয়া জরুরি।
…………………………………….
গাই-এর কাছ থেকে শুনেছি, গত কুড়ি বছর ধরে বো-ব্যারাকে রেন্ট দিতে হয় না তাঁদের। শেষ এখানকার রেন্ট ছিল আঠারো টাকা। ‘…সরকার আর কত ভাড়া বাড়াবে?’ গাই জানিয়েছিলেন, বো-ব্যারাকের ক্রিসমাস তাঁদের কম্যুনিটি ক্রিসমাস। কোনও ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা চার্চের নয়।
…………………………………….
আপনাদের ক্রিসমাস উদযাপন আমরা বাইরে থেকে জানি, আপনি ভেতরের একজন হয়ে সে কথা বলুন, শুনি…
এখন উদযাপন করা হয় ‘ক্রিসমাস উইক’। ২৩ তারিখ থাকে আমাদের নানারকম ‘শো’। ২৭ তারিখ আমরা পালন করি এখানকার প্রবীণ নাগরিকদের নিয়ে। তাঁদের জন্য উপহার থাকে, ডান্স করতে ডাকি। আসলে বো-ব্যারাকে রিটায়ার্ড মানুষদের জীবন তো খুব একঘেয়ে। আমাদের আসল উৎসব হল ২৪ তারিখ রাতে। যদিও ‘হাইপ’ হয় ২৫ তারিখকে নিয়ে। সেদিন আসলে, বো-ব্যারাকের ভিড় তুমি লক্ষ করতে পারবে। নানা-জায়গা থেকে ছেলেমেয়েরা এসে জুড়ে যায় আমাদের সঙ্গে। অনেক রাত অবধি চলে অনুষ্ঠান। ডান্স করতে গিয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি কিন্তু ওই ছেলেমেয়েগুলো ক্লান্ত হয় না। ৩১ তারিখে আবার সব ডান্স করতে আসে। অথচ, আমাদের আসল উদযাপনের সময় হল ২৪ তারিখ রাতে। সেদিন আমরা সকলে মিলে চার্চে যাই। আমাদের বো-ব্যারাকের কাছাকাছি চার্চ হল সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স চার্চ। সেদিনের রাত্রিটা আমাদের খুব কাছের, ‘শান্ত, গম্ভীর’। উদযাপনের আড়ালে আসলে তো থাকে প্রার্থনা।
আপনাদের সময়ের ক্রিসমাস কি কিছু অন্যরকম ছিল?
আমাদের তো এক কি দেড় মাস আগে থেকে শুরু হত প্রস্তুতি। সবথেকে বেশি যা মিস করি, তা হল আমাদের সময়ের শীতকালের ‘ব্লাডি কোল্ড ক্যালকাটা’। কী শীত পড়ত তখন! ক্রিসমাস ট্রি লাগানো, কেক, উপহার– সবই শিশিরে ভিজে যেত। উপহার বলতে বিশেষ কিছুই নয়। অনেক সময় পারস্পারিক উষ্ণতা ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার থাকত না আমাদের। সব বাড়িতেই কেক বানানো হত। বো-স্ট্রিটের রাস্তায় চেনা-অচেনা সকলকেই কেক খাওয়াতাম তখন। “গুড, ওল্ড জলি ডে’স”। মায়ের কেক বানানোর কিছু ‘সিক্রেট সামগ্রী’ ছিল, যেইগুলো ক্রিসমাসের সময় বেরত। রঙিন বয়ামে সেইসব রাখা থাকত। মায়ের কিচেনে কেকের গন্ধে থেকেই প্রথম বুঝতে পারতাম ক্রিসমাস আসছে। আমি মিস করি ক্রিসমাস ডিনার। সপরিবার সেই ডিনার । ঝাল ফ্রেজি, ইয়োলো রাইস, পর্ক ভিন্ডালু, মিট বল– সবই বানানো হত বাড়িতে। এখনও হয়, তবে এখন সবাই আসতে পারে না। আসবে কী করে? কেউ কানাডায় থাকে, কেউ অস্ট্রেলিয়ায়। আর এখন তো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খাবারের জন্য প্রচুর রেস্তরাঁও খুলে গেছে। পাড়াতেই কতগুলো বেকারি হল।
আচ্ছা আপনি যে বল্লেন, পালটে গেছে আপনাদের কম্যুনিটি সেন্টিমেন্ট। সেটা কীভাবে?
আসলে নিজস্ব গুছিয়ে নেওয়ার চিন্তা তখন আসেনি আমাদের। আমরা ছিলাম নোম্যাড, ওয়ার্কিং নোম্যাড। আমরা একসঙ্গে থেকেছি, বেঁচেছি। ক্রিসমাসে একসঙ্গে গান গেয়েছি, পিকনিক করেছি। এখনও ক্রিসমাসের সময় বো-স্ট্রিটের সকলে এক হই। তবে ওই, একটু ভালো পরব, একটু ভালো খাবর একটা রেষারেষি চলে এসেছে। আমাদের পুঁজি ছিল না, ওইসবের। পুঁজি বলতে ছিল ওই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা। আমরা ছোটবেলা থেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তাম বলে অনেকে আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বও করতে চাইত। ওহ, আর ব্রিটিশ ওয়ার্কফোর্সকে তো সাজিয়ে তুলেছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরাই।
ব্রিটিশ কলকাতা সম্পর্কে কী বলবেন?
আমি বড় হচ্ছি যখন তখন ব্রিটিশরা সবে সবে কলকাতা ছেড়ে গেছে। তবে, এই কথাও বলব, ব্রিটিশদের ছাড়া কলকাতা তৈরিই হত না। সে সময়ের কলকাতা ছিল ‘ফ্রি, জলি’। শীতকালে পার্টিস হত। ক্লাবে ব্রিটিশ আদব-কায়দার কথা শুনেছ তো? সে সময়ের কলকাতা ছিল ‘বেস্ট প্লেস ট্যু লিভ ইন’। আমার কিছু সাহেব শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের থেকে সবথেকে বেশি যা শেখার, তা হল সময়ানুবর্তিতা। ইংরেজি ভাষার ওপর দারুণ ‘কম্যান্ড’ ছিল তাঁদের। আর এক সার্বিক নিয়ম মেনে চলার প্রবণতা তো ছিলই। বাঙালিরা মানুষ ভালো তবে খুব বেশি ‘ডিসিপ্লিন্ড’ বলে তো মনে হয় না।
……………………………….
পুরনো-নতুন নানা কথা নিয়ে গল্প চলতে থাকে। উঠে আসে দেশভাগ, জাতীয় কংগ্রেস ও তাঁদের লিডার ফ্যাঙ্ক অ্যান্থনির কথা। দেশভাগের সময় ফ্যাঙ্ক অ্যান্থনির সমর্থন ছিল কংগ্রেসের প্রতি। ১৯৫২ সাল থেকে লোকসভায় দু’টি আসন সংরক্ষিত ছিল অ্যাংলো প্রতিনিধিদের জন্য। ২০২০ সালের পর থেকে তা আর নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুযোগ-সুবিধাও প্রায় কিছুই পায়নি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। অনেক পুরনো দিনের অ্যাংলো মানুষকেই দেখেছি ‘গ্লোরিয়াস হোয়াইট পাস্ট’ থেকে বেরতে পারেননি। তাঁরা নিজেদের মনে করেন পশ্চিমি। উড়ে যেতে চান সাদা-মানুষদের দেশে। মিস করেন সাদা-সময়ের ডিসিপ্লিন। আসলে, কলকাতা কি তাঁদের দিয়েছে অনেক কিছুই? নাকি ফাঁক থেকে গেছে অনেককিছুতে? আসলে বুড়ো শহরের সঙ্গে পুরনো হয়েছে তাঁদের কম্যুনিটি সেন্টিমেন্টও। শীতকালে সঙ্গে খানিক উষ্ণতা বাড়ে বো-ব্যারাকের। আলোয় সেজে ওঠে অ-ইউরোপীয় জেসাসের মন্দির। স্থানীয় ডায়ালেক্টেই হয় ক্যারোল। নস্টালজিয়া আর গল্পের মধ্যে হারিয়ে যায় ‘বো-স্ট্রিট’। তবুও তো, এই সময়ই ঘরে ফেরেন এদিক-ওদিক ছিটকে-ছাটকে যাওয়া মানুষরা। পুরনো বয়ামে উঁকি দেয় কেক বানানোর লাল-সবুজ সিক্রেট। ডিসেম্বরের উষ্ণতায় এখনও দিন বড় হয় এখানে।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………