কলকাতা চলন্তিকা হলে শিয়ালদা শশব্যস্ত। যেন ছুটে চলাই ধর্ম। ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার সাইরেন থেকে অ্যানাউন্সমেন্ট, হকারদের হাকডাক থেকে যাত্রীদের ছুটোছুটি– লেগেই আছে। আর তার সঙ্গেই আছে দূর থেকে ভেসে আসা চেনা ডাক– ‘এএএএএ চায়েএএএএ…. গরমমম চায়েএএএ বোলো চায়েএএএএ…’। চা-ওয়ালা। শিয়ালদহ স্টেশনে সবকিছুর মধ্যে ওঁরা আছেন। নিজেদের মতো করে। হাতে কেটলি, চায়ের কাপ। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেককিছু পাল্টে গিয়েছে। সুসজ্জিত স্ন্যাক্সের পাশাপাশি চা-কফির স্টল এসেছে, সেখানে নিত্যযাত্রীর ভিড়ও বেড়েছে। তা সবের মধ্যেই টিকে আছেন পুরনো চা-ওয়ালারা। তাঁদেরই একজন শঙ্কর চক্রবর্তী। পেশায় চা-বিক্রেতা। শিয়ালদা স্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম তাঁর মূল আস্তানা। বাকি প্ল্যাটফর্মেও অবারিত যাতায়াত। রোজ বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা ৩০, দেখা মিলবে ‘শঙ্করদা’-র। গমগমে প্ল্যাটফর্ম হোক কিংবা ভিড়ে ভরা ট্রেন, গলা ভেজানোর ইচ্ছা জাগলেই যাত্রীর চোখ খুঁজে নেয় তাঁদের প্রিয় ‘শঙ্করদা’কে। আজ ২১ মে, ‘বিশ্ব চা দিবস’। সেই বিশেষ উপলক্ষে ‘রোববার.ইন’ খুঁজে নিল ‘চা-ওয়ালা’ শঙ্করদাকে। একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এল তাঁর জীবনের নানা কথা। শুনলেন সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়।
শঙ্কর মানে তো শিব। শিব তো অল্পেতে সন্তুষ্ট। আপনি কি চায়ে সন্তুষ্ট?
শঙ্কর: (হেসে উঠে) না, না দাদা। চা বিক্রি করি বটে, তবে চায়ের নেশা আমার নেই। আমি চা অল্পই খাই। সেই সকালে একগ্লাস লিকার চা, তা পেলেই আমার চলে যায়। সারা দিনে আর খুব একটা চা খাই না। শরীর খারাপ, মানে সর্দি-গর্মি, জ্বর-টর হলে তখন আলাদা কথা।
সে কী! নিজের বানানো চা, সেটা টেস্ট করে দেখেননি কখনও?
শঙ্কর: হ্যাঁ, তা তো করি। কাস্টমারকে যেটা বানিয়ে দেব, সেটা ভালো হল নাকি মন্দ, তা পরখ করে দেখব না, তা আবার হয় নাকি। সে তো বানানোর সময়েই দেখে নিই।
কেমন হয় চা? ভালো?
শঙ্কর: সেটা যাঁরা খাচ্ছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন। ভালো না খারাপ। আপনি খেয়ে দেখুন না? খেয়ে বলুন খারাপ না ভালো! (বলতে বলতেই এক কাপ ধূমায়িত চা বাড়িয়ে দিলেন হাতের নাগালে। অনুরোধ মেনে চুমুক দিতেই হল চায়ে। গলা ভিজিয়েই ফের শুরু হল– ‘চায়ে পে চর্চা’।)
কোথা থেকে আসছেন, সেটা তো জানা হল না?
শঙ্কর: নিউ ব্যারাকপুর থেকে। নিউ ব্যারাকপুরে আমার বাড়ি। ওখান থেকে প্রতিদিন আসি শিয়ালদা-তে। এখানে চা বিক্রি করি। বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত দশটা-সাড়ে দশটা পর্যন্ত আমায় পাবেন। এই ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই বেশি থাকি। এখানে যে-কাউকে বলবেন, ‘শঙ্করদার চা’– ঠিক চিনিয়ে দেবে।
কতদিন হল চা-বিক্রি করছেন?
শঙ্কর: তা প্রায় ৩৫-৩৬ বছর হল।
এতদিন!
শঙ্কর: হ্যাঁ। অনেক দিনই হল। সেই ছোটবেলায় শিয়ালদা-তে চা-বিক্রি শুরু করেছিলাম। তখন আরও অনেকে ছিল। আমার বাবাও এখানকার হকার ছিল। বাবার সঙ্গেই আসতাম। তখন আরও অনেকে ছিল, চা-বিক্রি করত। এখন সংখ্যাটা কমতে কমতে চার-পাঁচজনে এসে ঠেকেছে। এখন যারা আছে, তাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে পুরনো। বাকিরা কেউ নয়-দশ, কেউ চোদ্দো-পনেরো বছর হল বেচছে চা।
প্ল্যাটফর্মে বসেই চা বিক্রি করেন? রানিং ট্রেনে করেন না?
শঙ্কর: আগে করতাম। হাসনাবাদ, বনগাঁ, রানাঘাট লাইনের ট্রেনে চা-বিক্রি করেছি। তবে এখন আর করি না। এখন প্ল্যাটফর্মেই আমায় পাবেন। এই ১ থেকে ১০। ওর বাইরে আমরা যারা ঘুরে ঘুরে চা বেচি, তারা কেউ যাই না। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে চা-বিক্রির করার অনুমতি দিয়েছে শিয়ালদার অফিসাররা (পড়ুন কর্তৃপক্ষ)। সেই মতো আমাদের বিক্রিবাটা হয়। এই চা-বিক্রির টাকাতেই আমাদের সংসার চলে। রুজিরোজগার যা হয়, তা দিয়ে চলে যায়।
বাড়িতে কে কে আছেন আপনার?
শঙ্কর: আমার মা আছেন। বাবা গত হয়েছেন। স্ত্রী আছে। দুই ছেলে। বড়জন কাজ করে। আর ছোটটা পড়াশোনা করছে, ইশকুলে পড়ে। আমার বাবাও এই লাইনে ৪০-৪৫ বছর হকারি করেছে। বাবা বাদাম বিক্রি করত। সল্টেট বাদাম। সে অনেকদিন আগের কথা বলছি। কত দাম ছিল তখন, চার আনা, আট আনা। তারপর চায়ের ব্যবসা ধরল। বাবার পর এখন আমি সামলাচ্ছি।
শুরু থেকে তাহলে আপনি চায়ের ব্যবসাই করছেন?
শঙ্কর: না। প্রথমদিকে, মানে তখন আমার বয়স অল্প, তখন ট্রেনে বাদাম, লজেন্স বিক্রি করতাম। চায়ের এত ভারী কেটলি, বালতি টানার ক্ষমতা ছিল না। টানা দু’বছর বাদাম-লজেন্স এসব বিক্রি করেছি ট্রেনে। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে মনে হল, ওসব করে কিছু হবে না। বরং চায়ের ব্যবসায় মন দিই। তাই করলাম। দেখতে দেখতে এত বছর হয়ে গেল, চা-ই বেচচ্ছি। সারা জীবন চা-বিক্রি করেই গেলাম, অন্য কিচ্ছু আর মন চাইল না।
জানেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনিও চা বিক্রি করেছেন একসময়?
শঙ্কর: (হেসে) শুনেছি। ওসব নেতামন্ত্রীদের ব্যাপার। আমরা আর কী বলব।
কোভিডের সময় চা-বিক্রি হত?
শঙ্কর: না, দাদা। ওই সব তো সব কিছু বন্ধ ছিল। সে আর বলবেন না। ভয়ংকর দুর্দিন গিয়েছে আমাদের। ট্রেনে হকারি করতে পারতাম না। বিক্রিবাটা পুরো বন্ধ। বাড়িতে বসে। কী যে হবে, ভেবে কুল পেতাম না। সে একদিন গিয়েছে আমাদের! উফ্! ভাবলেই ভয় হয়। বাড়ি থেকে বেরনোর উপায় নেই। ঘরে বসে আছি দিনের পর দিন। আয় নেই। তারপর একটু একটু করে সব স্বাভাবিক হল। গাড়িঘোড়া, ট্রেন চালু হল। আমরা সেসময় রাত ন’টা-সাড়ে নয়টা পর্যন্ত চা-বিক্রি করতাম। তারপর বাড়ি ফিরতাম।
বিক্রি হত?
শঙ্কর: হাতেগোনা। সামান্য বিক্রিবাটা হত। তবে ঘরে বসে থাকার চেয়ে দু’পয়সা আসবে। সে’সব ভেবেই বের হতাম কাজে। জানতাম, ঝুঁকি আছে। চারিদিকে যা চলছিল সেসময়, কত লোক মারা গেল! দেখেছি তো। কিন্তু কী করব, করে তো খেতে হবে। আমাদের জীবনটাই ওইরকম. ভয় পেলে চলবে না। রোজগার না করলে খাব কী! তাই বেরোতাম। যা আয় হত, তাতে পেট চালানোর খরচ জুটে যেত। এই যা!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমরা যখন চা বেচতাম শুরুর দিকে, এসব (স্টল) কিছুই ছিল না। এখন এসব স্টল হয়েছে। কিন্তু লোকে কী সত্যি ভালো খায় ওই চা? জিজ্ঞাসা করে দেখুন? আমাদের বানানো চায়ের যে টেস্ট, তার ধারেকাছেও নয় ওই চা। লোকে একবার খেয়ে দ্বিতীয়বার খেতে চায় না স্টল থেকে। আমাদের কাছ থেকে কিনে খায়। ট্রেনে আমাদের বাঁধাধরা কাস্টমার আছে, যারা অফিস থেকে ফেরার সময় ট্রেনে আমাদের কাছ থেকে চা কিনে খায়। টেস্টটাই আসল। বাইরের চাকচিক্য দিয়ে কী হবে!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
চা-ওয়ালা না হয়ে অন্যকিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি কখনও?
শঙ্কর: স্বপ্ন!
হ্যাঁ, স্বপ্ন। দেখেননি?
শঙ্কর: সে বয়স তো পেরিয়ে এসেছি (হেসে)। ছোটবেলায় ওসব ভাবতাম। কিছু করতে হবে, বড় হয়ে। স্বপ্ন তো সবাই দেখে, ক’জনের সেটা পূরণ হয় বলুন। চা-বিক্রি করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করব, তা আর আমার হয়ে ওঠেনি। আমার বাবার আশা ছিল, আমি বড় হয়ে কিছু করি, মানে চাকরি-বাকরি। কিন্তু তা পূরণ করতে পারিনি। বাবার বড় সংসার ছিল। অনেক দায়দায়িত্ব। নানা কারণেই হোক, সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বাবার মতো হকারির কাজটাই বেছে নিয়েছি। তাতেই চলে যাচ্ছে।
এই স্টেশন (শিয়ালদহ) আগের চেয়ে তো অনেক বদলে গিয়েছে। এখন এত চায়ের স্টল চারিদিকে। আপনাদের বিক্রিবাটা হয় ঠিকঠাক?
শঙ্কর: লোকসান তো হয়েছেই। তা আর কী করা যাবে! আমরা যখন চা বেচতাম শুরুর দিকে, এসব কিছুই ছিল না। এখন এসব স্টল হয়েছে। কিন্তু লোকে কী সত্যি ভালো খায় ওই চা? জিজ্ঞাসা করে দেখুন? আমাদের বানানো চায়ের যে টেস্ট, তার ধারেকাছেও নয় ওই চা। লোকে একবার খেয়ে দ্বিতীয়বার খেতে চায় না স্টল থেকে। আমাদের কাছ থেকে কিনে খায়। ট্রেনে আমাদের বাঁধাধরা কাস্টমার আছে, যারা অফিস থেকে ফেরার সময় ট্রেনে আমাদের কাছ থেকে চা কিনে খায়। টেস্টটাই আসল। বাইরের চাকচিক্য দিয়ে কী হবে!
কাস্টমারদের জিজ্ঞাসা করেছেন কখনও চা কেমন লাগে?
শঙ্কর: করি তো। কেউ আজ অবধি খারাপ বলেনি। লেডিস স্পেশালের যারা নিত্যযাত্রী, সেই দিদিদের অনেকেই আমার কাছ থেকে চা কিনে খান। ভালো চা পান বলেই না তাঁরা আমায় চেনেন। আমার কাছ থেকে চা কিনে খাচ্ছেন প্রতিদিন। বলেন, ‘শঙ্কর তুমি খুব ভালো চা বানাও।’
কী ধরনের চা বেশি বিক্রি হয়? কড়া না লিকার?
শঙ্কর: সেটা কাস্টমারের ওপর নির্ভর করে। তবে নিত্যযাত্রীরা কড়া চা বেশি পছন্দ করে। সবার পছন্দ আবার এক হয় না। কেউ কম চিনি, হালকা চা পছন্দ করে। যে যেমন চায়, তেমনটাই বানিয়ে দিই।
প্রতিদিন কত চা বিক্রি হয়?
শঙ্কর: শীতে আর বর্ষায় চা বিক্রিটা বাড়ে। তবে গরমে কম। এখন সারা দিনে ১২০টা মতো কাপ বিক্রি হয়। কখনও কখনও বেশি হয়।
এই এক কেটলিতে হয়ে যায়?
শঙ্কর: না, না। এই এক কেটলি বানানো চায়ে ঘণ্টাদুয়েক হবে। এর মধ্যে প্ল্যাটফর্মে আর ট্রেনে যা বিক্রি করার করব। তারপর আবার চা তৈরি করতে হবে।
কোথায় বানাবেন? প্ল্যাটফর্মেই?
শঙ্কর: না। শিয়ালদা স্টেশনের ভেতর স্টোভ জ্বালানোর অনুমতি নেই। স্টেশনের বাইরে আমাদের একটা গুমটি আছে। ওখানে আমার মা বসেন। গুমটিতে স্টোভ, চা-পাতা, দুধ রাখা থাকে। দরকার মতো বানিয়ে নিই। সেটা দিয়ে বাকি সময় চলে। তারপর রাতে ফিরি।
কতদিন করবেন এই ব্যবসা? ক্লান্ত লাগে না?
শঙ্কর: (হেসে) ক্লান্তির কী আছে। অসুখ-বিসুখ হলে আলাদা কথা। কিন্তু যতদিন শরীর দেবে ব্যবসা চালিয়ে যাব, বুড়ো না হওয়া পর্যন্ত।
এই চা-ওয়ালার জীবন পেয়ে আপনি খুশি?
শঙ্কর: হ্যাঁ, খুশি। যারা খাচ্ছেন তারা আমার চা খেয়ে খুশি হলেই আমি খুশি। দেখুন, আমরা বলি তেষ্টা, পিপাসা। জল সেই তেষ্টা মেটায়। আর জলের পরে তেষ্টা মেটায় চা। পানীয়র দৌড়ে জল-তেষ্টা প্রথম, আর চা-তেষ্টা দ্বিতীয়। আমার চা খেয়ে কারও যদি তেষ্টা মেটে, মন ভরে, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
(কথার মধ্যে হঠাৎ ছেদ পড়ে! দূর থেকে আরেক সঙ্গী চা-ওয়ালা হাক দেয়, ‘শঙ্করদা, পাঁচে হাসনাবাদ!’ এতক্ষণ থিতু হয়ে জীবনের গল্প বলে চলা মানুষটা সেই ডাকে শশব্যস্ত হয়ে পড়ে। বুঝতে পারি, কর্মের ডাক এসেছে। শঙ্করদাকে আর বসে থাকলে চলবে না। নিজেই বলে ওঠেন, ‘চলি তাহলে। পাঁচে হাসনাবাদ। পরে আবার কথা হবে…’। ঘোর কাটতে কিঞ্চিৎ সময় লাগে। খেয়াল হয়, হাতে ধরা সেই চায়ের কাপ। চা শেষ হলেও কাপটা ফেলা হয়নি। দ্রুতপায়ে তখন অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন চা-ওয়ালা। অথচ কথায় কথায় দাম মেটানো হয়নি। জোরে ডাক দিই– ‘শঙ্করদা…’, ডাক শুনে ফিরে তাকান। বলি, ‘চায়ের দাম…’ একগাল হেসে শঙ্করদা জবাব দেন– ‘ধরে নিন, দাদা খাওয়ালো। তার আবার দাম দিতে হয় নাকি!’)
চিত্রগ্রাহক: সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন ময়দান-এর চা-বিক্রেতা কামেশ্বর যাদব–এর সাক্ষাৎকার: চা দিবসে কি ছুটি মিলবে?
পড়ুন সংবাদ প্রতিদিন-এর চা-বিক্রেতা নারায়ণ নন্দী-র সাক্ষাৎকার: চা বানালে আমি শুধু এই অফিসেই বানাব, আর কোথাও না
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….