ডায়মন্ড হারবার সংলগ্ন ফলতার এক মিঠে গ্রাম কমলপুর। কোম্পানির নাম ‘ওরিয়েন্টাল মিউজিকক্রাফট’। সে পাড়ায় যে-বাড়িতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম, দোরগোড়ায় একটা সরোদ বার্নিশ করছেন মোটা কাচে ঝাপসা রুগ্ণ এক বৃদ্ধ। ছোট্ট ঘেরা উঠোনের গা ঘেঁষে লাতা দেওয়া এক মেঝেয় সরোদের কাঠামো চাঁছছেন এক মহিলা। উঠোনের আরেক প্রান্তে ছোট্ট মন্দির, লক্ষ্মী-নারায়ণের পাশে বিরাজ করছেন সরস্বতী। অদূরেই শতছিন্ন এক মাদুরের শরীরে বসে একটি সরোদের ফিনিশিং টাচ দিচ্ছেন অশোক কাঞ্জী। তাঁর পাশে, সরোদটির ব্রিজ ঘষে ঘষে তৈরি করছে তাঁর একরত্তি ছেলে দীপ্তার্ঘ্য। এসব পেরিয়ে, ধীর পায়ে উদিত হলেন শুভ্র গেঞ্জি, ধুতি গায়ে এক মানুষ– দুলালচন্দ্র কাঞ্জী। কথা শুরুর আগে মা সরস্বতীকে প্রণাম করলেন। কথার মাঝেই এক প্লেট ফল এসে পড়ল, মাঝে ভাত-ডাল-কুঁদরিভাজা-মাছের আশ্চর্য আপন করে নেওয়া আতিথেয়তা। যন্ত্রের রহস্য উন্মোচিত হল কি না, দেখুন তো…
আপনার ছেলের সঙ্গে কথায় কথায় জানলাম, আপনার স্বপ্ন ছিল সংগীত শেখার। একসময় সেই স্বপ্ন নিভেও যায়। কিন্তু কীভাবে নিভে গেল সেই স্বপ্ন?
সত্যি বলতে, ভাবলে আমারও অবাকই লাগে! ছোটবেলা থেকেই আমাদের পাড়া-গাঁয়ে খুব হরিনাম সংকীর্তন হত। শুনতে ভালো লাগত। সাধ হত, আমিও যদি বেশ শিখতে পারতাম। খুঁজে খুঁজে একজন গুরুকেও পেলাম। তিনি গান শেখাতেন মূলত। কিন্তু, যে গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসলেন, তা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
বাড়িতে বলেননি তখন?
বাড়িতে কী বলব! যেখানে পড়াশোনার জন্যই আমি খরচ কুলোতে পারলাম না, সেখানে গান শেখার জন্য টাকা কোত্থেকে পাব? বলেছিলাম, কিন্তু উপায় ছিল না।
অশান্তি হয়েছিল?
হ্যাঁ। তা তো হবেই। আমি এই কাছেই হরিণা স্কুলে পড়েছি। তখনও সেটা হাই স্কুল হয়নি। ক্লাস ফোর যখন আমার, তখন জানা গেল হাই স্কুল হবে। আমরা, এই পাড়ার ছোট ছেলেপিলেরা মিলেই বাঁশ বেঁধে স্কুলের বিল্ডিং তুলতে সাহায্য করেছিলাম। একটা সময় ফাইভে উঠলাম। সিক্সে উঠে খুব অভাব-অনটন এল সংসারে। আমি মাস্টারমশাইকে বললাম, আমাকে এই বছরটা ক্লাসে রেখে দিন। আমি স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করব আবার। তা শুনে স্যর বললেন, তুমি ক্লাসে সেকেন্ড হও, আমি তোমাকে ক্লাসে বসিয়ে রেখে, বদনাম কুড়োতে যাব নাকি? অগত্যা আমাকে পড়া ছেড়ে দিতে হল। সংগীত শেখাও হল না।
কী করলেন তখন?
আমি বাড়ির একমাত্র ছেলে। আমার মাথার ওপরে একজন দিদি, আমার পরে এক বোন। বাবা ছিলেন সাধারণ একজন চাষি। খুবই কষ্টে সংসার চালাতেন। এখন যে বাড়ি দেখছেন, তখন ছিল খড়ের ছাউনি দরমা দেওয়া ছোট্ট একটা বাড়ি। তাই সংসারের চাপে কাজে লেগে পড়লাম। কাঠের কাজ ধরলাম, এই গ্রামেই। এই চেয়ার, টেবিল, তক্তপোশ বানানোর কাজ। কিন্তু, মন তো পড়ে আছে সেই সংগীতেই। শুধু ভাবতাম, আমার কি এ জীবনে সংগীত শেখা হবে না? এক বছর ধরে হাড়খাটনির কাজ শিখে শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিলাম।
এই কাঠের কাজ থেকেই কি যন্ত্রসংগীতের দিকে মোড় নিল জীবন?
বলা যায় তাই-ই। এরকম সময়েই কিশোরী নস্কর এলেন আমার জীবনে। তিনি সম্পর্কে আমার মামা। মায়ের খুড়তুতো ভাই। তানপুরা বানানোয় তাঁর নামডাক রয়েছে। ভবানীপুরে বাড়ি। কিন্তু দেশের বাড়ি ফলতারই পাশে কোদালিয়ায়। মামা বললেন, তুই তো কাঠের কাজ জানিস, যন্ত্র বানাতে শেখ, তাহলে বাজাতেও শিখে যাবি। আর আমি প্রাণ দিয়ে সেই কথা বিশ্বাসও করে নিলাম। মামার সঙ্গে চলে গেলাম কলকাতায়।
কীভাবে পৌঁছলেন কলকাতা?
তখন এখান দিয়ে মার্টিন রেলের ন্যারো-গেজের লাইন যেত। মাঝেরহাট অবধি। সেই ট্রেনে চেপে পৌঁছে গেলাম, তারপর পায়ে হেঁটে ভবানীপুর। সেখানে মামা আমাকে বললেন, তুই একটা কাজ আগে শেখ, তাহলেই সব কাজ শিখে যাবি। এই বলে ধরিয়ে দিলেন তানপুরার কাঠ চাঁছার কাজ। কিন্তু, কখনও একটা কাজ শিখে সব কাজ শেখা যায়? আমার যে কাজ শেখানোর গুরু ছিলেন সেখানে, তিনি অন্য কাজ খালি লুকিয়ে করতেন। কিন্তু এভাবে লুকিয়ে রাখলে আমি কাজ শিখব কী করে! তবু, এক বছর ধরে ধৈর্য ধরে কাজ করলাম। এরকম সময়েই খবর পেলাম হেমেনচন্দ্র সেনের। হেমেনবাবুর কাছে কাজ করত এক পালিশওয়ালা, আমার গুরুভাই বলতে পারেন, পাশের গ্রামের লোক। খুব ভালবাসত আমাকে। সে-ই আমাকে নিয়ে গেল হেমেনবাবুর কাছে।
কোন সাল তখন?
ওই ’৬৫ খানেক হবে। খুবই ছোট তখন আমি।
তা হেমেনবাবুর কাছে যেতে কী কথা হল?
প্রথমেই হেমেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কত টাকা দিতে হবে রোজ? আমি বললাম, আমার ওসব দাবিদাওয়া কিছু নেই। খেয়ে-পরে বাঁচতে পারলেই হল, আমাকে শুধু কাজ শেখাতে হবে, তাহলেই হবে। টাকার কথা তো কিছু বললাম না, হেমেনবাবু নিজে থেকেই আমাকে দৈনিক তিন টাকা ধার্য করলেন।
হয়ে যেত তাতে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তিন টাকায় আমার খাওয়াদাওয়া পরা হয়ে যেত। নিজে রান্না করে খেতাম।
থাকতেন কোথায় সেই সময়?
ঘুঘুডাঙায়। পাম অ্যাভিনিউর কাছে। বাহাদুর খাঁ-র বাড়ি ছিল ওখানেই। তা সেই ঘুঘুডাঙা বাজারের কাছেই একটা জায়গায় ভাড়া থাকতাম, আমার এক দাদার সঙ্গে। সে মোটর মেকানিক ছিল।
হেমেনবাবুর কাছে শেখা শুরু হল তারপর জোরকদমে? উনি সব শেখাতেন?
হেমেনদার কাছেই আমার মূলত যা কিছু শেখা। ওখানে আমি সব কাজ করতাম। কাঠের কাজ যেহেতু জানতাম, সেটা তো করতামই, এছাড়াও পর্দা বাঁধার কাজ, ব্রিজ বানানো, সবই করতাম। যেহেতু আমি কখনও কোনও কাজে ‘না’ বলতাম না। হেমেনদা আমাকে কোনও কাজে আটকাননি।
বকা খেয়েছেন কাজ শিখতে গিয়ে?
সে এক দারুণ গল্প! একদিন সরোদের ব্রিজের কাজ করছি। তখন হরিণের শিং দিয়ে ব্রিজ বানানো হত। এখন তো উটের হাড় দিয়ে বানানো হয়। তা সেই শিং কাটতে গিয়ে ভুল জায়গায় কেটে ফেলেছি। সেটা দেখে হেমেনদা আমাকে বাটাম দিয়ে মেরেছিলেন, মার মানে বেধড়ক মার! আমার পাশে যে কারিগর ছিল, সে-ও খুব রেগে গিয়েছিল দেখে, কিন্তু আমি একটা কথাও বলিনি।
কেন মারলেন, হরিণের শিং বলে?
না, তখন হরিণের শিং যে খুব দুষ্প্রাপ্য ছিল, তেমন নয়। কিন্তু, আমি ভুল করেছি, ওটারই শাস্তি। মারতে মারতে আমাকে দোকান থেকে ফুটপাতে নামিয়ে বললেন, তুই এবার থেকে ফুটপাতে বসে কাজ করবি। ওরকম সময় বিমলবাবু এসেছেন দোকান। পুরো নাম মনে নেই। তিনি ছিলেন সেই সময়কার পুলিশ কমিশনার। সেতার বাজাতেন দারুণ। আমাকে হেমেনদা মারছেন দেখে তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, এ কী হেমেনদা, এরকম একটা বাচ্চা ছেলেকে আপনি মারছেন! হেমেনদা খুবই কড়া লোক ছিলেন। পুলিশ বলে এতটুকু ভয় না পেয়ে, উত্তর দিয়েছিলেন, চোরকে আপনি মারেন না? কেন মারেন? তখন বিমলবাবু বলছেন, ও তো চুরি করেনি, কাজে ভুল করেছে মাত্র। হেমেনদা তখন বললেন, ভুল করেছে বলেই তো। ও তো শিখতে এসেছে। ভুল করতে তো শাস্তি পেতেই হবে। তা এই শুনে বিমলবাবু এমন রাগ করেছিলেন যে, প্রায় ১৫ বছর আর আসেননি হেমেনদার দোকানে। অন্য জায়গায় যন্ত্র সারাতে দিতেন, তবু হেমেনদার কাছে আসতেন না। কিন্তু, একটা সময় তো রাগ পড়েই যায়। তিনি এসেছিলেন আবার।
প্রায়ই এরকম মার খেয়েছেন? কিছু বলেননি কখনও?
না, এটা খুব মনে আছে, বিমলবাবুর কারণেই। তেমন মার খাইনি। বকাবকি খেতাম খুব। আসলে উনি আমায় খুব ভরসা করতেন। ভালোও বাসতেন খুব। ওঁর স্ত্রী, মানে বউদিও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। হেমেনদা কিন্তু কোনও দিনও আমাকে বলেননি, এই কাজটা কেন হল না? কিংবা ওই কাজটা বাকি থেকে গেল। আমার কাজের খামতি হলে বলেছেন, কিন্তু কাজে কোনও দিনই কমতি ছিল না। সেটা হেমেনদা বুঝতেন। হেমেনদা বলতেনও যে, দুলাল দোকানে আছে মানে, একটু হলেও বেশি কাজ হবেই। দুলালকে নিয়ে চিন্তা নেই। আর হেমেনদার মুখে মুখে কথা বলিনি কোনও দিন, কোনও প্রতিবাদও করিনি। কারণ, উনি আমার গুরু। গুরু যা বলছেন, ভালোর জন্যই বলছেন, সেই বিশ্বাস ছিল। তাই গুরুর কথা, গুরুর দণ্ডকে আমি মাথা পেতে নিতাম। ওঁর কাছেই তো শিখছি। দারুণ কাজ জানতেন। মাপজোখে তাঁর কোনও জুড়ি ছিল না।
হেমেনবাবু কার কাছে কাজ শিখেছিলেন?
হেমেনদা কাজ শিখেছিলেন মহেন্দ্রবাবুর কাছে। তিনি ছিলেন বাহাদুর খাঁ-র মামাতো ভাই। মামাতো ভাই বলতে, বাংলাদেশে ওঁদের একই পাড়ায় বাড়ি ছিল। হেমেনদাও বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন। তবে, তাঁর শেখার বাইরেও, তিনি নিজেও অনেক নতুন ভাবনা এনেছিলেন যন্ত্র তৈরিতে।
হেমেনবাবুর আপনার প্রতি ভরসা তো নিশ্চয়ই রাতারাতি আসেনি। কোনও একটা ঘটনা নিশ্চয়ই আছে, যা হেমেনবাবুকে এতটা আস্থা জুগিয়েছিল।
আঃ, সেটা ইতিহাস হয়ে থাকার মতো ঘটনা! একদিন সকালে কাজ করছি। হেমেনদা খুব চিন্তিত। আমি তখন হেমেনদার পাশেই বসে কাজ করতাম। হেমেনদা আমাকে হঠাৎ ডেকে বললেন, দুলাল, আলি আকবর খাঁ সাহেবের অর্ডার এসেছে আমেরিকা থেকে। তিনমাসে ৭৫টা সরোদ বানিয়ে পাঠাতে হবে। কাজটা ধরলে অনেক লাভ তো হবে, কিন্তু ভুল হলে একদম বদনাম হয়ে যাবে, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। কী করি বল তো?
এ তো অসম্ভব প্রায়! কী হল তারপর?
আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর বললাম, লোকে সহজে অর্ডার পায় না, আর আপনি পেয়ে ছেড়ে দেবেন? দাঁড়ান ভিতরে সবার সঙ্গে আগে কথা বলে আসি। তখন আমরা মোট ১৬ জন কারিগর। কারখানায় ঢুকে বললাম সবটা। কম সময়, কিন্তু অনেক অর্ডার। সবাই বলল, হ্যাঁ পারব। কিন্তু, এখন যা পাই, তার ডবল মাইনে দিতে হবে। সেখানে একজন মুসলিম কারিগর ছিল। সে বলল, আর দুলাল, কাজ শেষ হয়ে গেলে, ডেলিভারির দিন খাওয়াতে হবে। আর সামনেই দুর্গাপুজো, সবাইকে পুজোর জামাকাপড় দিতে হবে।
ব্যস, এটুকুই চাওয়া ছিল?
হ্যাঁ। গিয়ে সব বললাম হেমেনদাকে। পাশে তখন একজন গানের মাস্টারমশাই বসেছিলেন। তিনি বললেন, আরে, দুলাল ভরসা দিয়েছে যখন হয়ে যাবে। হেমেন তুমি অর্ডারটা নিয়ে নাও। হেমেনদা চুপ করে ছিলেন। কিছু বলেননি। আমাদের কাজ শুরুও হয়ে গেল। দিন-রাত এক করে আমরা প্রচুর খেটেছিলাম। শেষমেশ, হপ্তা খানেক আগেই ৭৫টা সরোদ বানিয়ে ফেলেছিলাম আমরা। দারুণ আনন্দ হয়েছিল। ডেলিভারির জন্য সব যন্ত্র বেরিয়ে যাওয়ার পর খাইয়েছিলেন হেমেনদা। আর সেবারে পুজোয় নতুন পোশাকও দিয়েছিলেন আমাদের।
কত বছর কাজ করলেন হেমেনবাবুর কাছে?
প্রায় ২০-২৫ বছর।
কাদের কাদের দেখেছেন সেই সময়?
বিলায়েত খাঁ আসতেন, রবিশঙ্কর, আমজাদ আলি, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বিলায়েত খাঁ, রবিশঙ্কর– এঁরা এসে আমাদের মিষ্টি খাওয়ার টাকাও দিয়ে যেতেন। সামনে বসে সেতার বা সরোদ চেক করতে করতে বাজাতেন, সেসবও শুনেছি।
আচ্ছা, এই যে চেক করতেন যন্ত্র, সেই অসুবিধেগুলো বুঝতেন কী করে?
শ্রুতি দিয়ে। কাজের সঙ্গে সঙ্গে কানটাও তৈরি হয়ে যেত। তবে সেটা শিখতেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
কেন হেমেনবাবু শেখাননি?
না, ওই একটা জায়গাতেই হেমেনদা কার্পণ্য করেছেন। কিছুতেই শ্রুতি শেখাতেন না। লুকিয়ে রাখতেন। তবে আমিও তেমনই ছিলাম। যখনই শিল্পীরা এসে যন্ত্র দেখতেন, বাজাতেন, বা চেক করতেন, আমি হেমেনদার কাছে বা উল্টোদিকে গিয়ে বসে যেতান। মাথা নিচু করে হয়তো ঘষছি ব্রিজ, কিংবা অন্য কোনও কাজ করছি। কিন্তু, কান থাকত আমার ওখানেই। এভাবেই শেখা শুরু হয়েছিল।
তার মানে, লুকিয়ে শিখে নিয়েছেন ঠিক!
হ্যাঁ, এভাবেই তো শিখতে হয়। কেউই পুরোটা কখনও শিখিয়ে দেবে না। কখনও কখনও এভাবেই ছিনিয়ে নিতে হবে জ্ঞানকে, নাহলে শিল্পী কীসের। যন্ত্র মানে শ্রুতিটাই তো আসল। হেমেনদা সেটা আমাকে না শেখালেও, হাতে ধরে আমাকে শিখিয়েছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।
কীভাবে সেই সুযোগ এল?
এ এক দারুণ ইতিহাস। বলতে পারেন, এখান থেকেই আমার জীবনের মোড় ঘুরল। একদিন হেমেনদার কাছে বসে কাজ করছি। বুদ্ধদা এবং সঙ্গে জয়দীপের (জয়দীপ ঘোষ, বিশিষ্ট সরোদিয়া, সুরশৃঙ্গার ও সুরবাহার বাদক) বাবা এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একটা সেগুন কাঠ। হেমেনদাকে সেটা দেখিয়ে বললেন, জয়দীপের জন্য একটা সরোদ বানিয়ে দিতে হবে এই কাঠ দিয়ে। কিন্তু হেমেনদা নারাজ। তাঁর বক্তব্য, এটা সিপি টিক, বার্মা টিক হলে করতাম। করতে গিয়ে কোয়ালিটি নিয়ে গন্ডগোল পাকবে কোথায়, এই জন্য তিনি করতে চাইলেনই না কোনওভাবে। বুদ্ধবাবু কোনওভাবেই তাঁকে রাজি করাতে পারলেন না। যা হোক, হেমেনদার থেকেই একটা সরোদ বানাতে দেওয়া হল। আর, সেই সেগুন কাঠ ৭ বছর পড়ে রইল বুদ্ধদার বাড়িতে।
এই ঘটনা ঘটছে যখন, ততদিনে আপনার কত বছর চলছে হেমেনবাবুর কাছে?
তা প্রায় ১৪-১৫ বছর। আর হেমেনবাবুর কাছে আসার সূত্রেই বুদ্ধদার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। আমার কাজ খুব ভালোবাসতেন বুদ্ধদা, স্নেহও করতেন খুব। তা, এভাবে আরও অনেকগুলো বছর পেরিয়েছে। হেমেনদা নেই সেদিন, কোনও একটা সেমিনারে গিয়েছিলেন। আমি দোকানে আছি। যেন সুযোগ বুঝেই বুদ্ধদা আর জয়দীপের বাবা আবার এসেছেন। এসে আমাকে বললেন, হ্যাঁ রে, তুই তো যন্ত্র বানানো শিখে গেছিস। ওই সেগুন কাঠটা দিয়ে সরোদ বানিয়ে দে না। আমি তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। বললাম, গুরুকে অমান্য করে আমি কী করে বানাব? গুরু রাগ করবেন। কিছুতেই আমি রাজি হচ্ছি না। শেষমেশ আমাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে গেলেন, চিনাপাড়ায় চাইনিজ হোটেলে খাওয়াতে। সেখানে খেতে খেতে অনেক বোঝানোর পর আমি শেষমেশ এক শর্তে রাজি হলাম, আমার গুরু হেমেনদা যেন কোনওভাবে জানতে না পারেন। বুদ্ধদা বললেন, ও তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই কাজটা ধরে নে। দিয়ে একদিন পৌঁছে দিলেন সেই সেগুন কাঠ আমার কাছে। আমি তারপর, কখনও একদিন কামাই করে, কখনও বা রাত জেগে, কখনও ভোরে উঠে একটু একটু করে সেই কাঠে কাজ শুরু করলাম। এক বছর ধরে আস্তে আস্তে শেষমেশ তৈরি হল সরোদ।
আর আপনিই একদিন তিনমাসে ৭৫টা সরোদ বানানোর অর্ডার নেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন! সেই সরোদ আছে এখনও? কেমন হয়েছিল?
হ্যাঁ, জয়দীপের কাছেই আছে। ওরই তো যন্ত্র। ভালো হয়েছিল যন্ত্রটা। এই যন্ত্র পাওয়ার পর বুদ্ধদা-রা প্রেরণা জাগিয়েছিল, এবার তুই নিজে হাতে কাজ কর।
তাহলে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কাছেই আপনার স্বয়ম্ভু কারিগর হয়ে ওঠার হাতেখড়ি বলতে গেলে? গুরুর ছায়া থেকে বেরিয়ে এলেন কী বলে?
হ্যাঁ। বলতে গেলে, গুরুর ছায়া তো কখনও ছাড়া যায় না। আমি কোনও দিনই বলিনি হেমেনদাকে যে, আমি আর আসব না। বুদ্ধদার থেকে সাহস পাওয়ার পর থেকে, আস্তে আস্তে আমার কাছে অর্ডার আসতে থাকল। জয়দীপের বাবা আমাকে অনেক অর্ডার দিয়েছিলেন। আমাকে অনেক জায়গায় নিয়েও গিয়েছিলেন। ওঁদের সাহসে আমি বাড়িতে থেকে কাজ করা শুরু করলাম। কলকাতায় তো আর আমার জায়গা ছিল না, অত টাকাও ছিল না। মাসে দশ-পনেরো দিনের জন্য চলে আসতাম। আবার হেমেনদার কাছে ফিরে যেতাম। কিন্তু হেমেনদা আমাকে কখনওই তার জন্য প্রশ্ন করেননি। কোনও দিনও বলেননি, আসিসনি কেন? কিংবা পরের দিন হয়তো আসব না, তাতেও জিজ্ঞেস করেননি, আসবি তো? উনি কী বুঝতেন বা ভাবতেন, আমি কখনও জানতে চাইনি। উনিও আমাকে কখনও জিজ্ঞেস করেননি কেন আসছি না। ফলে, হেমেনদার থেকে আমি কখনওই কাজ ছেড়ে দিইনি। হয়তো মাসে একটাদিনের জন্য গেছি। তখনও গিয়ে বসে কিছু না কিছু কাজ করেছি। উনি কখনও আমাকে আসতে বারণও করেননি। যে ক’দিনের কাজ করতাম, তার টাকাও দিয়ে দিতেন। আমি চাইওনি। আর এমনিতেও, আর বাকি কারিগররা টাকা বাড়ানোর কথা বলত, কিন্তু আমি কোনও দিন বলিনি আমার টাকা বাড়িয়ে দাও। উনি যেমন দিয়েছেন, আমি নিয়েছি। এভাবে বাড়তে বাড়তে আমার দৈনিক ১১ টাকা অবধি হয়েছিল। মারা যাওয়ার আগে অবধি বলেছেন, তুই যখনই পারবি চলে আসবি। কিন্তু, মোটামুটি আমার কাজ থেকে সরে আসা ’৮৫ সাল নাগাদের কথা।
আর ওদিকে বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে তখন কাজ চলছে।
হ্যাঁ, উনি একদিন আমাকে বললেন, দুলাল, এই সেতার-সরোদ তো সব বড় যন্ত্র। একটা বয়সে না পৌঁছনো অবধি এগুলো ধরা যায় না। বাচ্চারা এগুলো শিখতে চাইলে কী করি বল তো। ব্যস, এই শুনে আমি লেগে পড়লাম। খেটেখুটে আমি প্রায় ৫ ফর্মায়, ৫ ধরনের ছোট সাইজের সরোদের ডিজাইন করেছিলাম। বয়সের ভিত্তিতে। ৩ বছরের জন্য, ৫-৭ বছরের, ৭-৯, তারপর ৯-১২, তারপর ১২-১৬। এরপর একদম ফুল সাইজ। বুদ্ধদা বললেন, তুই বানিয়ে এনে দেখা। আমি একদম সবক’টার একটা করে স্যাম্পেল বানিয়ে বুদ্ধদাকে খুব কম সময়ের মধ্যেই গিয়ে দেখালাম। বুদ্ধদা তো স্তম্ভিত, আনন্দে আত্মহারা। বললেন, এবার আমাকে আর কে আটকাবে বাচ্চাদের শেখানোর থেকে। ক্রমশ খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। আলি আকবর খাঁ সাহেবের ছেলে ধ্যানেশদা, আশিসদা সবাই আমাকে ছোটদের জন্য সরোদের অর্ডার দিলেন।
তাহলে, আপনিই প্রথম ছোটদের জন্য সরোদ বানালেন?
হ্যাঁ। ওটাই আমার লক্ষ্য হয়ে উঠল। ওটাই আমার বিশেষত্ব। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের যন্ত্র যেন আরও ছোট বয়স থেকে শিখতে পারে। ফুল সাইজের সরোদ বা সেতার বানাতে যা সময় লাগে, এখানেও সেই সময়ই লাগে। কারণ, কাঠকে সেই একই সময় ধরেই সিজন করতে হয়। তারপর তার কাজেও খাটনি সেই একই। তবু, বাচ্চারা আনন্দে শিখবে, এই ভেবে আমি দাম কমিয়েই বিক্রি করেছি। লাভ করার কথা ভাবিনি। এছাড়াও, যে শিখবে, তার শরীর বুঝে, তার যন্ত্র ধরার ক্ষমতা বুঝে আমরা সরোদের ওজন বাড়াই বা কমাই। যাঁর কাছে শিখবে, সেই ঘরানা, সেই গুরুর কেমন টোন পছন্দ, সেই সবও আমরা মাথায় রেখে সরোদ বানাই। অন্যান্য কারিগর নিজের মতো করে যন্ত্র বানিয়ে দেয়, ওতে হয় না। যে শিল্পী, যে বাজাবে, যন্ত্রটা তো তার। তারই তো অঙ্গ হবে। ফলে, আমাকে তার কথাই ভাবতে হবে। আমার তাই প্রত্যেকটা যন্ত্র স্বতন্ত্র, প্রত্যেকটা সেই শিল্পীর মতো করে, সেই শিল্পীর কথা ভেবে, শিল্পীর শ্রুতির পছন্দ-অপছন্দ ভেবে তৈরি করা।
আচ্ছা, কখনও অর্ডার না এলে কী করেন?
সেই যে আমার অর্ডার আসা শুরু হয়েছিল, আমার কখনও অর্ডারের অভাব হয়নি। আর ফুল সাইজের সরোদ বানানোর চেয়ে এখনও অবধি আমরা ছোটদের সরোদই বানিয়েছি সবচেয়ে বেশি, এবং এখনও তারই অর্ডার সবচেয়ে বেশি আসে। যে যে শিল্পী বা যে মাস্টারমশাইরা আমার থেকে অর্ডার নিয়েছেন, তাঁদের থেকে অর্ডার ক্রমশ আমার বেড়েইছে। বরং, এখন কাজ করে শেষ করতে পারি না। আর আগের মতো কারিগরও পাওয়া যায় না।
কেন পাওয়া যায় না? এত অর্ডার বেড়েছে, চাহিদা বেড়েছে, তাহলে কারিগর কম কেন?
এখন শেখার ইচ্ছা বড় কম দেখি। শেখার হুজুগ আছে। হয়তো এল দু’-তিনদিনের জন্য, দিয়ে হাওয়া। কাজ শেখা হয় না, তার আগে থেকেই টাকা নিয়ে ভাবতে বসে। কাজ শেখাব বললে আগে প্রশ্ন করে, কত টাকা পাব? এভাবে কি শেখা হয়? এ কি যে সে কাজ? ঠিকমতো শিখলে তো খাওয়া-পরার অভাব হবে না। সেটা কেউ বুঝতে চায় না। আমি যেভাবে মন দিয়ে, লেগে থেকে শিখেছি, যেভাবে দিনের পর দিন কষ্ট করেছি, যন্ত্রণা সয়েছি, সেই ধৈর্য আর দেখি না। হেমেনদার কাছে আর যে কারিগর ছিল, তাদেরও কেউ আর আমার মতো যন্ত্র বানায়নি। কারণ, ওই একটা কাজে মন দিয়ে, সেখান থেকে ঠিকঠাক আয় হয়ে গেলে, তাতেই দেখেছি অনেকে খুশি হয়ে যেতে। নতুন কিছু করার ভাবনা, চেষ্টা, জেদ খুব কম মানুষেরই হয়। সেভাবে বললে, চিরকাল এরকমই হয়ে এসেছে। নতুন কিছু করার জেদ, কষ্ট করার মানসিকতা কমজনেরই থাকে। তারাই পারে বদলাতে।
আচ্ছা, আপনি যে এভাবে ছোটদের সরোদ-সেতার নিয়ে ভেবেছেন, আপনার কাজ যাতে আরও অনেকে শিখতে পারে, তার জন্য শিল্পীরা ভাবেননি?
হ্যাঁ, একবার একটা সেমিনার হয়েছিল বম্বেতে, তিনদিনের। ১৯৮৬ সালের কথা। সেখানে বড় বড় সব শিল্পী এসেছেন, আবার দেশ জুড়ে কারিগররাও এসেছেন। আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধদা। কারিগর আর শিল্পীদের মধ্যে কথা, আলোচনার সভা ছিল সেটা। তা গিয়ে আমাকে বক্তব্য রাখতে বলা হয়। আমি তো পড়াশোনা করিনি। বাংলা ছাড়া কথা বলতেই পারি না। খুবই কুণ্ঠিত রয়েছি। সেখানে হঠাৎই প্রশ্ন আসে বিশিষ্ট সেতারবাদক অরবিন্দ পারিখের মেয়ের থেকে– ‘মাতাল লাউ’-এর কতটা গুরুত্ব, সেই বিষয়ে। জিনিসটা সেতারের মাথায় থাকে। অনেকে টোনের জন্য, কিংবা রিভার্বের জন্য ওটা রাখেন। সরোদে যেমন পেতলের থাকে। তা আমি বলেছিলাম, এ তো শিল্পীদের পছন্দের ব্যাপার। যাঁর কানে যেমন পছন্দ। কিন্তু, আমরা কারিগর জানি, আদপে ওটা যন্ত্রের ব্যালেন্সের জন্য। আমার যদিও কোনও তফাত লাগে না। বিলায়েত খাঁ সাহেব তো ওটা ছাড়াই সেতার বাজান, কই দারুণ তো লাগে শুনতে। এই কথা শুনে আশিস খাঁ হঠাৎই রেগে গেলেন। খুবই মেজাজি লোক ছিলেন। আমি তো ঘাবড়ে গেলাম। এরপর আশিস খাঁ আমার সঙ্গে প্রায় কয়েক বছর কথাই বলেননি। কিন্তু সেই সভায় বিলায়েত খাঁ আমাকে এসে একেবারে পাঁজা করে জড়িয়ে ধরেছিলেন আনন্দে, আর গলায় ফুলের মালা দিয়েছিলেন। সেই সেমিনারের যে পত্রিকা বেরিয়েছিল পরে, সেখানে আমার বক্তব্য পুরোটাই ছাপা হয়েছিল। তর্ক-বিতর্কটাও উঠে এসেছিল। সদ্য তিরিশ ছুঁয়েছি হয়তো তখন। এখনও সেই জড়িয়ে ধরা মনে পড়ে।
এখন আপনার কাছে তাহলে কারা কাজ শিখছে?
এই তো আমার ছেলে। আর নাতিও দেখে দেখে শিখছে। আরেক নাতি আছে। নয়ন (নয়ন কাঞ্জী)। ও-ও বেশ কাজটাকে আয়ত্ত করেছে। অনেকেই মাঝে এসেছে, দিয়ে কয়েক দিন কাজ করে পালিয়ে গেছে। শেখার ইচ্ছে নেই। এছাড়া আমার বউমা আছে। অনুরূপা (অনুরূপা নস্কর)। ও কয়েকটা বাড়ি পরে থাকে। ছ’-সাত বছর হয়ে গেল ও শিখছে। দিল্লি, বম্বে নিয়ে গেছি ওকে বিভিন্ন সেমিনারে। সংগীত নাটক অ্যাকাডেমির মিউজিয়ামেও নিয়ে গেছি। হাতে ধরে শেখাচ্ছি আমি ওকে। মন দিয়ে শেখে। অন্য অনেকের থেকে মনোযোগী।
বলা হয়ে থাকে, সরোদ বাজাবে মরদ। এখন তো মেয়েরাও সরোদ বাজাচ্ছে গতানুগতিকতা ভেঙে। আর আপনার কাছে দেখলাম সরোদ বানানোর কাজও শিখছেন একজন মেয়ে। এও তো কম পরিবর্তন নয়! তা অনুরূপাদির হাতে বানানো সরোদ নিশ্চয়ই পাব আমরা শুনতে শিগগির কোনও শিল্পীর হাতে?
হ্যাঁ, ওসব ফারাক বুঝি না। কাজ শিখলে সবাই পারবে কাজ করতে। অনুরূপা অবশ্যই পারবে। আমার ছেলের হাতে সরোদ অনেকেই বাজায়। অনুরূপার বানানো সরোদও একদিন নিশ্চয়ই উঠবে কোনও শিল্পীর হাতে।
আচ্ছা, কলকাতায় থাকার সময় কোথাও ফেস্টিভ্যালে যেতেন না, শুনতে যেতেন না শিল্পীদের?
হ্যাঁ, যেতাম তো। রাত জেগে ভোর অবধি শুনতাম। তখন তো ডোভার লেনের মিউজিক তো কোনও হলে হত না। খোলা মাঠে প্যান্ডেল বেঁধে হত। আমরা তো আর টিকিট পেতাম না বসার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনতাম। একবার তো বুদ্ধদা আমাকে স্টেজেও তুলে নিয়েছিলেন, বলেছিলেন এই যে যন্ত্রটা দুলালের বানানো। খুব আনন্দ হয়েছিল। ভালোও লেগেছিল। স্বপ্নের মতো লাগে দিনগুলো।
সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি পেলেন যখন, তখন কি মনে হয় এই জার্নিটা একটা উচ্চতা পেল? আনন্দ হয়?
আনন্দ বলতে আমার ওই যন্ত্র বানানোতেই। পুরস্কার পেলেও, আমাকে তো সেই যন্ত্রটাই বানাতে হবে। ফলে, আমি ওসব ভাবি না। মন দিয়ে কাজ করেছি, চিরকাল গুরুদের শ্রদ্ধা করেছি, তাঁদের সম্মান করেছি, আর সংগীতকে ভালোবেসেছি। আর কী চাই।
আচ্ছা, এই যে যন্ত্র বানিয়ে গেলেন, সংগীত শেখাটা তো সেই অধরা রয়ে গেল। কষ্ট হয় না?
কখনও কখনও ভাবি। কিন্তু, কষ্ট হয় না। আজ আমার যন্ত্র দেশ-বিদেশে কত শিল্পী বাজাচ্ছেন, ভালোবাসা পাচ্ছেন বাজিয়ে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, এতেই আমার আনন্দ। এখনও স্বপ্ন দেখলে, নিজের কোনও আক্ষেপ চোখে ভাসে না। বরং ওই রবিশঙ্কর, বিলায়েত খাঁ, বুদ্ধদার বাজানোর দিনগুলো, চোখের সামনে দেখা, সামনে থেকে শোনার স্মৃতিগুলোই মনে পড়ে। অনেক ভালোবাসা পেয়েছি এঁদের থেকে। বুদ্ধদার বাড়ির যে কোনও অনুষ্ঠানে আমরা আমন্ত্রিত হয়েছি। আমার ছেলেদের বিয়েতে উনি সপরিবার এসেছেন। এমনিতেও প্রায়ই চলে আসতেন আমার বাড়িতে। খুব আনন্দের দিন সেসব।
আচ্ছা, আগের সংগীতচর্চার সঙ্গে এখনকার সংগীতচর্চায় আপনি কী তফাত দেখতে পান?
অনেক তফাত। আগে গুরুর কাছে নিবেদিত হয়ে শেখার ধরনটাই ছিল আলাদা। এখন খুব যান্ত্রিক হয়ে গেছে। শেখার আনন্দের চেয়ে শিখে কেরিয়ার করার চিন্তা তৈরি হয়ে গেছে অভিভাবকদের। উদ্দেশ্য নিয়ে কখনও কি শেখা হয়? শেখার আনন্দে শিখতে হয়। এইজন্যই দেখবেন, এখনকার কোনও গানই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আগেকার গান একটা প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে যেত। তার কারণ, প্রাণ ছিল। সেই প্রাণ আর নেই। তাড়াহুড়ো লেগে গেছে বড্ড। সমাজের বদলটা এর কারণ হয়তো। তবু, মানুষকে তার নিজের মনের জোরেই চেষ্টা করে যেতে হবে।
আচ্ছা, আপনি কি মনে করেন আরেকজন দুলাল কাঞ্জী তৈরি হবে এই মাটিতে?
কেন হবে না। শেখাচ্ছি তো ছেলেকে। ছেলে তার ছেলেকে শেখাচ্ছে। এছাড়াও দূরে কেউ আমার মতোই হয়তো জেদ ধরে শিখে চলেছে বিভিন্ন কাজের মধ্যে। আমি কেন, আমার থেকেও ভালো হয়তো কেউ আসবে যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে আরও উদ্ভাবনী যন্ত্র দেবে।
আপনি ছোটদের যন্ত্র ছাড়াও আর কী বানিয়েছেন?
সুর-শৃঙ্গার যেমন কোলে নিয়ে বাজানো হয়। সেটা এখানে বাহুতে নিয়েও বাজানো যায়। জয়দীপ বাজায় দেখবেন। ওটা আমারই বানানো। যে কোনও ভারতীয় তারের যন্ত্র আমি বানাতে পারি। এসরাজ, সেতার, সরোদ, সুরবাহার, দোতারাও। কিন্তু, সরোদটাই বেশি অর্ডার আসে।
আচ্ছা, কী রাগ সবচেয়ে পছন্দ আপনার?
ভালো বাজানো যে কোনও রাগই শুনতে ভালো লাগে আমার। কিন্তু ইমন শুনতে একটু বেশিই ভালো লাগে।
শেষ প্রশ্ন, আপনি তো সংগীতশিল্পীই হবেন স্বপ্ন দেখতেন, এখন কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন আপনি নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন?
একথা সত্যিই আমি বহুবার ভেবেছি। স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করেছি জোর করে। কিন্তু আমি স্বপ্নেও দেখতে পাই রবিশঙ্করের কিংবা আলি আকবর খাঁর পাশে বসে আছি। ওঁরা বাজাচ্ছেন, আমি চুপ করে শুনছি মাত্র। এটুকুতেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। এ-ও তো কম বড় স্বপ্ন নয়।
ঋণ: পণ্ডিত রণজিৎ সেনগুপ্ত
দুলালচন্দ্র কাঞ্জী, ওঁর পরিবার এবং কারখানার সমস্ত ছবি তুলেছেন সুপ্রিয় মিত্র।
স্কুল গড়ার কাজে উমাদির সঙ্গে নিরঞ্জনবাবু ছিলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্কুল নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হত খুব। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝতেন স্কুল নিয়ে কতখানি প্যাশন ছিল দু’জনের মধ্যে সেসব তর্কে। স্কুলের কাজে চিনুদা প্রত্যক্ষভাবে জড়াননি, কিন্তু তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল।
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।